নীরব বিজ্ঞান - পর্ব ১


সেদিন আমার এক চিত্রশিল্পী বন্ধু কথায় কথায় আমাকে বলল, সে আল্লাহ বিশ্বাস করে না। সে বিশ্বাস করে বিজ্ঞান। কারন জিজ্ঞেস করতে সে বলল "আমার কয়েকদিন আগে জ্বর হয়েছিল। সেই জ্বর আর কমে না। আমি ডাক্তার এর কাছে যাই। ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করে ওষুধ দেয়। সেগুলো খেয়ে আমি সুস্থ হই। এখানে আল্লাহ কি করল? আমি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে ঘরে বসে আল্লাহর নাম নিলে সুস্থ হতে পারতাম না।" ডাক্তার, ওষুধ এগুলো সবই বিজ্ঞানের দান। তাই সে বিজ্ঞান বিশ্বাস করে। বিজ্ঞান ও তার অবদান সে হাতে কলমে দেখতে পাচ্ছে। আল্লাহ তো দেখা যায় না। তার ধারনা আল্লাহ মানুষের কল্পনা মাত্র। হয়ত তার কাছে এমন আরো অনেক উদাহরন রয়েছে।
তার মতন এমন বন্ধু হয়ত আপনারও রয়েছে যারা বিজ্ঞান বিশ্বাস করে। এ ছাড়াও এমন বন্ধু তো অবশ্যই আছে যারা আল্লাহ বিশ্বাস করে আবার বিজ্ঞানও মেনে নেয়। আর আল্লাহর প্রতি এই বিশ্বাস এর সমর্থন নেয় বিজ্ঞান থেকে। বিশ্বের সব দেশে বিভিন্ন বই পাওয়া যায় যাতে বিজ্ঞান দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব সমর্থন করা হয়েছে। আমার এই লেখা পড়ে দেখুন, বিজ্ঞান কতটা নিরূপায় হয়ে নীরব ভুমিকা পালন করে।

প্রথমে চিত্রশিল্পীর কথায় আসি। বিজ্ঞানেই তার উত্তর রয়েছে। সে জানে না, কিভাবে তার জ্বর হয়েছিল, কিভাবে ডাক্তার রোগ সনাক্ত করলেন, কিভাবে ওষুধ নির্বাচন করলেন, কিভাবে এই ওষুধে সে সেরে উঠেছিল।

জ্বর কোন অসুখ নয়। এটা তখনই হয় যখন শরীরের কোন অংশ ঠিক ভাবে কাজ করছে না। বন্ধুটির মতন এমন অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছিল। একবার প্রচন্ড কানে ব্যাথা নিয়ে আমি ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে ইনফেকসন হয়েছে। ওষুধ দেওয়ার পরে আমি সেরে উঠি। আমি যদি ডাক্তারের কাছে না যেতাম তাহলে ধীরে ধীরে এই কানের ইনফেকসন আরো মারাত্বক আকার ধারন করত। এটা থেকে টিউমার, ক্যান্সার হতে পারত। আমি মারা যেতে পারতাম। আমার প্রান রক্ষা করতে পেরেছি সময় মতন ডাক্তারের কাছে যেতে পেরে। কে আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য করেছিল? উত্তরঃ আমার প্রচন্ড ব্যাথা। এই ব্যাথা জিনিসটা আমাদের শরীরে না থাকলে আমি আমার কানের সমস্যা বুঝতেই পারতাম না। ডাক্তারের কাছেও যেতাম না, আমার জীবন রক্ষাও হত না। চিত্রশিল্পী বন্ধুর ক্ষেত্রে তেমনই হয়েছে। তার শরীরে কোন এক সমস্যা দেখা দিয়েছে যা তাকে জানান দিয়েছে জ্বরের মাধ্যমে আর বাধ্য করেছে ডাক্তারের কাছে যেতে। এই জ্বর হয়ত তাকে আরো বড় বিপদ থেকে বাচিয়ে দিয়েছে। এতক্ষন যা বললাম তা সবই বিজ্ঞানের কথা। এবার বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করি "আমাদের শরীরের এই আত্বরক্ষামুলক জ্বর ও ব্যাথা কোথা থেকে আসল? কে এই বিষয়ে চিন্তা করেছিল যে আমাদের এটা দরকার হবে?" বিজ্ঞান এখানে নীরব। বিজ্ঞান মতে তো ইস্বরের অস্তিত্ব নেই। সব কিছুই তো এমনি এমনি হয়েছে। তো এমনি এমনি হওয়া জিনিসে কিভাবে এমন সুচিন্তিত আত্বরক্ষামুলক ব্যাবস্থা থাকে?

রোগ নির্নয় বা ওষুধ নির্বাচন ডাক্তার তার জ্ঞান থেকে করে। আমরা, আমাদের জ্ঞান থেকে কিভাবে কোন জিনিস সনাক্ত করি তার ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে রয়েছে। আপনি কম্পিউটার কিভাবে কাজ করে এটা জানলে বিষয়টা আরো সহজে বুঝতে পারবেন। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন।





এই ছবিটা দেখুন - ছবিতে ৩টা ভিন্ন জিনিস রয়েছে। আপনি ছবি দেখে কিভাবে চিনেন? ছবি থেকে আলো এসে আপনার চোখে লাগে। চোখ তখন মস্তিস্কে সংকেত পাঠায়। মস্তিস্ক তখন খুজে বের করে জিনিসটি কি। সারা জীবনে আপনি যা দেখেছেন তার বেশীর ভাগই আপনার মস্তিস্কে সংরক্ষন করা আছে। এই বিশাল তথ্য ভান্ডার থেকে খুজে বের করে তারপর আপনাকে জানায় আপনার দেখা জিনিসটা কি। এই ছবির ১ নম্বর বস্তুটি আপনার মস্তিস্ক খুব সহজেই খুজে বের করতে পেরেছে কারন গ্রামীন ফোনের লোগো রয়েছে আর এ জিনিসটা আপনি অনেকবার দেখেছেন। এটি গ্রামীন ফোনের ইন্টারনেট মডেম। ২ নম্বর বস্তুটি চিনতে ১ নম্বরের চেয়ে একটু বেশী সময় লেগেছে তারপরেও এটি খুব অল্প সময়ে চিনেছেন। এটি মরিচের মতন দেখতে একটি পেন ড্রাইভ। লক্ষ্য করুন এটি মরিচের মতন দেখতে হলেও আপনার মস্তিস্ক একে মরিচ না বলে পেন ড্রাইভ বলেছে। ৩ নম্বর বস্তুটির ক্ষেত্রে চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। মেয়েটির হাতের ওটি কি? আপনারা একেক জন এটাকে একেক জিনিস মনে করতে পারেন। কম্পিউটার, এমপ্লিফাইয়ার, প্রজেক্টর আরো কত কি। আশা করি এই জিনিসটি আপনি কখনো দেখেন নি। তাই আপনার মস্তিস্ক এটি খুজে পাচ্ছে না। এটি আসলে একটি ইন্টারনেট মডেম। ৭০ সালে মডেম দেখতে এমনই ছিল। আশা করি কোন কিছু সনাক্ত করার জন্য আমাদের মস্তিস্ক কেমন জটিল প্রদ্ধতির মধ্য দিয়ে যায় তার কিছুটা ধারনা হয়েছে। আমার এই লেখা পড়তেও (অক্ষর চিনতে) আপনার মস্তিস্ক এভাবে প্রতি মুহুর্তে তার মেমরী থেকে সার্চ করছে। একই ধরনের পদ্ধতিতে কম্পিউটার সার্চ করে। আমাদের মস্তিস্ক, কম্পিউটার থেকে লক্ষগুন বেশী দ্রুত কাজ করে। আপনার সারা জীবনের সমস্ত মেমরী থেকে সার্চ করে একটি পেন ড্রাইভ বা মডেম সনাক্ত করতে আপনার আধা সেকেন্ডও সময় লাগেনি। একই মেমরী কম্পিউটার এ রাখতে হলে হার্ড ডিস্ক হতে হবে লক্ষ গিগা বাইটের আর এর থেকে সার্চ করতে কয়েক ঘন্টা সময় লাগবে। এছাড়া কম্পিউটার এর আরো রয়েছে সফটওয়ার, যাতে রয়েছে লক্ষ লক্ষ লাইন কোডিং।

মুল গল্পে ফিরে আসি- ডাক্তার রোগ সনাক্ত করে ও ওষুধ নির্বাচন করে একই পদ্ধতিতে। এসব বিজ্ঞানই আমাদের জানিয়েছে। বিজ্ঞানকে প্রশ্ন করুন এমনি এমনি হওয়া আমাদের এই শরীরে আধুনিক কম্পিউটার এর থেকেও উন্নত এমন জটিল পদ্ধতি কিভাবে হাজার বছর ধরে চলে আসছে? আমাদের এই মস্তিস্কের মেমরী সেল, প্রসেসর, সফটওয়ার এগুলো সব এমনি এমনি কিভাবে হল। কম্পিউটার এর ক্ষেত্রে তো এগুলোর ব্যাবস্থা করতে শত লোকের ঘাম ঝরে যায়। আমাদের শরীরের বেলায় এটা কিভাবে এমনি এমনি হল? বিজ্ঞান এখানে নীরব।

আসলে বিজ্ঞান খুব সত্যবাদী। যা দেখে, যা বোঝে, তাই বলে। কিছুটা শিশুদের মতন। উদাহরন সরূপ, দুই বছর বয়সের একটি শিশুকে একবার এক স্কুলের বারান্দায় এক ঘন্টা বসিয়ে রাখুন। এরপরে বাড়িতে এনে তাকে প্রশ্ন করুন, তুমি স্কুলে কি দেখলে? সে বলবে "প্রথমে টং টং ঘন্টা বাজে। সবাই ঘরে ঢুকে বেঞ্চে বসে। একজন লাঠি নিয়ে ঘরে ঢুকে। একটি খাতা হাতে নিয়ে নাম বলে আর এক এক জন উপস্থিত বলে চেচিয়ে উঠে। এরপরে লোকটি বোর্ডে কি সব লিখে আর সবাইকে বুঝায়। মাঝে মাঝে কেউ কেউ কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কাউকে আবার লাঠি দিয়ে বাড়ি দেয়। আবার টং টং ঘন্টা বাজে। লাঠিওয়ালা লোকটি চলে যায়। এরপর আরেকজন আসে।" লক্ষ্য করুন, এখানে কোন মিথ্যা নাই, কোন ভুল তথ্য নাই। সবই সঠিক। এখন শিশুটিকে প্রশ্ন করুন স্কুলে আসলে কি হয়? সে বলবে "কি হয় তা তো তোমাকে বললাম"। আবার জিজ্ঞেস করুন, স্কুলে পাঠদান, শিক্ষা, এগুলো হয় না? তার উত্তর হবে "শিক্ষা কি জিনিস?" শিশুটি সব দেখেছে এবং হুবহু বলতে পেরেছে স্কুলে কি হয়। কিন্তু তার পক্ষে স্কুলের আসল জিনিস, "শিক্ষা" বোঝা সম্ভব নয়। এটা বোঝার ক্ষমতাই তার নেই।

বিজ্ঞানের দেখা ও বোঝাটা ওই শিশুর মতন। যা দেখে, যা বোঝে, তাই বলে। বিজ্ঞানকে জিজ্ঞেস করুন গাছ কিভাবে হয়। উত্তরঃ "বীজ মাটিতে বপন করে, তাতে পানি দিতে হয়। এর পরে এর থেকে চারা গজায়"। বীজের তো প্রান নেই, আবার গাছের প্রান আছে। তো এই প্রান কখন কিভাবে কোথা থেকে আসে ? এর উত্তর বিজ্ঞানে নেই। প্রান কি জিনিস, এর সঠিক সংগা বিজ্ঞানে নেই, আপনি খুজে দেখতে পারেন। দুই বছরের শিশু যেমন স্কুল দেখেও শিক্ষা বোঝে না ঠিক তেমনি বিজ্ঞান, সারা দুনিয়ার প্রানী দেখেও প্রান বোঝে না। বিজ্ঞান এখানে নীরব।

বিজ্ঞানের অনেক ছাত্রই একটি যন্ত্র বানাতে পারবে, যা বাতাস থেকে অক্সিজেন শোষন করে তা কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিনিত করে বের করে দিবে। কিন্তু এই যন্ত্রটা কত ছোট করে বানানো সম্ভব? বিজ্ঞানের এই স্বর্নযুগেও এই যন্ত্র একটা কলমের সমান বানানো সম্ভব নয়। এবার দেখুন এই যন্ত্র কোথায় রয়েছে। এই যন্ত্র হল আমাদের ফুসফুস। একটি বাচ্চা ইদুর এর ফুসফুসও এমন এক যন্ত্র। সেই ফুসফুস এর আকার একটি সিমের বিচির সমান হবে। যে যন্ত্র আমরা এত প্রযুক্তি দিয়েও ছোট করে বানাতে পারি না, সেই যন্ত্র এমনি এমনি এত ছোট করে লাইফ গ্যারান্টি সহকারে কিভাবে এল? বিজ্ঞান এখানে নীরব।

আমাদের চারপাশে প্রকৃতিতে ছড়িয়ে আছে এমন হাজারো বিস্ময়কর প্রযুক্তি যা কিভাবে কাজ করে তা হয়ত বিজ্ঞান বলতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান এটা বলতে পারে না যে এই প্রযুক্তি আবিস্কার হয়েছে কিভাবে। বিজ্ঞানের প্রত্যেকটি প্রযুক্তির আবিস্কারক থাকে। কিন্তু লক্ষ বছর ধরে চলে আসা প্রকৃতিতে এইসব প্রযুক্তির আবিস্কারক কে? বিজ্ঞান প্রানই বোঝে না, প্রানের আবিস্কারককে বুঝবে কিভাবে? তাই বিজ্ঞান এখানে নীরব থাকে।

আল্লাহকে বিশ্বাস করা না করা একজনের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। সয়ং আল্লাহই এ বিষয়ে জোর করেন নি। কিন্তু এই সীমিত জ্ঞানের বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আল্লাহকে বিশ্বাস করা বা না করা হচ্ছে - এক ধরনের অজ্ঞতা।

পরের পর্ব এখানে - নীরব বিজ্ঞান - পর্ব ২

Comments