মহানবী (সাঃ) নূরের তৈরি ছিলেন না










ইন্টারনেটের এই যুগে হাতের কাছে রয়েছে তথ্য ভান্ডার। যা জানতে চান, সেই বিষয়ে সার্চ করলেই শত শত লেখা খুজে পাবেন। ইসলাম নিয়ে হাজার ওয়েব সাইট রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ওয়েবসাইট তো সরাসরি কোরআন ও হাদিসের ওয়েবসাইট। ইংরেজী জানতে হবে না।বাংলাতেই রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, বেশির ভাগ মানুষই সেগুলো না দেখে, না পড়ে, কবে কোন হুজুর বা পীর সাহেব কি বলেছেন সেটা বিশ্বাস করে বসে রয়েছে।
মুল বিষয়ে আসার আগে আমি দুটি বিষয় স্পস্ট করে নিতে চাই।

১ | আমরা কি জানি বা পালন করি - বা কোন লেখক কি বলেন - সেগুলো দেখে ইসলামের সম্পর্কে ধারনা করা ঠিক নয়। ইসলাম নিয়ে সঠিক ধারনা পেতে কোরআন ও সহী (সঠিক) হাদিস পড়ুন। আমাদের দেশে প্রচলিত অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো ইসলামিক নয়। তাই ইসলামিক লেবাসধারী ব্যাক্তিরা বললে বা পালন করলেই সেটি ইসলাম হয়ে যায় না - ইসলামিক হতে হলে অবিশ্যই কোরআন বা হাদিসে থাকতে হবে।

২| সারা বিশ্বে অনেক জাল হাদিস প্রচলিত রয়েছে। জাল হাদিস বলতে সেই সব বানীকে বোঝানো হয় যেগুলো হয়ত ভালো কথা কিন্তু মহানবী (সাঃ) কখনো সেটা বলেননি। সেটা মানুষের বানানো কথা, সেটা হাদিস নয়। এছাড়া কিছু হাদিস আছে যার যেগুলো দুর্বল হাদিস। তার মানে এগুলো মহানবী (সাঃ) এর কথা কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। সহী হাদিস বলতে সেইসব হাদিসকে বোঝায় যেগুলো সঠিক মহানবী (সাঃ) এর বানী। জাল হাদিস সনাক্তকরনে ইসলামিক পন্ডিতদের বিভিন্ন পদ্ধতি ও গবেষনা রয়েছে। এর উপরে বিশবিদ্যালয়ের কোর্স রয়েছে। দুঃখের বিষয় আমাদের এই উপমহাদেশে এমন কোন কোর্স নেই। সহী হাদিসের সংকলন তো রয়েছেই। এমনকি জাল হাদিস এর সংকলন এর বই পর্যন্ত রয়েছে যা আপনি বিনামুল্যে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করতে পারেন। যাতে আপনি এগুলো এড়িয়ে চলতে পারেন। তাই বিভ্রান্ত না হয়ে নিজেই সত্য যাচাই করুন।

এবার মূল বিষয়ে আসি। মহানবী (সাঃ) নাকি নুরের (আলো) তৈরি। অনেকে এটাকে মানে, অনেকে মানে না। তবে বাংলাদেশের প্রায় সব লোক এটা মানে যে আল্লাহ নুরের তৈরি। মহানবী (সাঃ) কে নুরের তৈরি বানানোর জন্য বহু জাল হাদিস তারা উপস্থাপন করে। সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বছর পেরিয়ে যাবে। কিন্তু অকাট্য প্রমান হিসাবে তারা কোরআনের একটি আয়াতও উপস্থাপন করে। আয়াতটি নীচে দেওয়া হল।

- হে কিতাবীগন, আমার রাসুল তোমাদের নিকট আসিয়াছে, তোমরা কিতাবে যাহা গোপন করিতে সে উহার অনেক কিছু তোমাদের নিকট প্রকাশ করে এবং অনেক কিছু উপেক্ষা করিয়া থাকে। আল্লাহর নিকট হতে এক আলো ও স্পস্ট কিতাব তোমাদের নিকট আসিয়াছে। (সুরা মায়িদা - ১৫)

এই আয়াতে বলা হয়েছে যে আলাহর নিকট থেকে আলো ও কিতাব এসেছে। কিতাবটি নিঃসন্দেহে কোরআন আর আলো হলেন রাসুল (সাঃ)। এই আয়াতে রসুল (সাঃ) কে নূরের তৈরি বলা হয়েছে এর সমর্থনে সেদিন এক লেখা পড়লাম। সেখানে অন্তত দশজন ইসলামিক চিন্তাবিদ তাদের তাদের সমর্থন ব্যাক্ত করেছেন। এদের বড় বড় টাইটেল আছে এদের লেখা তাফসিরের বই আছে। আরো কত কি। ওদিকে আবার বিশ্বের বেশির ভাগ ইসলামিক পন্ডিত বলেছেন - রাসুল (সাঃ) নুরের তৈরি নন। এই দুই রকমের কথা শুনে আপনি যাতে বিভ্রান্ত না হন সেজন্যই তো আল্লাহ আমাদেরকে কোরআন দিয়েছেন যা চিরকাল অপরিবর্তিত থাকবে। আসুন দেখে নেই - কোরআনে নুর (আলো) বিষয়ে কি বলা আছে। (কিছু আয়াত বড় হওয়ায় অংশ বিশেষ দেওয়া হয়েছে - আপনি নিজে কোরআন দেখে মিলিয়ে নিতে পারেন)

১। নিশ্চই আমি তাওরাত অবতীর্ন করেছি; উহাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো ___ (আয়াতের আংশিক) (সুরা মায়িদা - ৪৪)

২। মরিয়াম পুত্র ঈসাকে তাহার পুর্বে অবতীর্ন তাওরাতের প্রত্যায়নকারীরূপে উহাদের পশ্চাতে প্রেরন করেছিলাম এবং তাহার পুর্বে অবতীর্ন তাওরাদের প্রত্যায়নকারীরূপে এবং মুত্তাকীদের জন্য পথনির্দেশ ও উপদেশরূপে তাহাকে ইঞ্জিল দিয়েছিলাম। উহাতে ছিল পথনির্দেশ ও আলো। (সুরা মায়িদা - ৪৬)

৩। যাহারা ঈমান আনে আল্লাহ তাহাদের অভিভাবক, তিনি তাহাদের অন্ধকার হইতে বাহির করিয়া আলোতে লইয়া যান। __ (আংশিক) (সুরা বাকারা- ২৫৭)

৪। এইভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি রূহ তথা আমার নির্দেশ; তুমি তো জানিতে না কিতাব কি এবং ঈমান কি। পক্ষান্তরে আমি ইহাকে করিয়েছি আলো যাহা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাহাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি; তুমি তো প্রদর্শন কর কেবল সরল পথ। (সুরা শূরা - ৫২)

উপরের আয়াতগুলি ভালোভাবে পড়ুন। না বুঝলে কয়েকবার পড়ুন। আল্লাহ আমাদেরকে কোরআন দিয়েছেন তা মেনে চলার জন্য, কাজেই এতে এমন কোন কঠিন কথা নেই যা আমরা বুঝব না। তার পরেও আমরা ভালোভাবে না বুঝলে এর জন্য হাদিস/তাফসির রয়েছে। বিভ্রান্ত হওয়ার কোন সুযোগ নেই।

রাসুল (সাঃ) কে নুরের তৈরি দাবী করে যারা, তাদের দেওয়া আয়াত আর আমার দেওয়া আয়াত ১,২ মিলিয়ে দেখুন। ওই আয়াতে কিতাব (কোরআন) সম্পর্কে যা বলা হয়েছে আমার দেওয়া আয়াত দুটিতেও তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে সেই একই কথা বলা হয়েছে। উনাদের আয়াতটি পড়ে যদি রসুল (সাঃ) কে নুরের তৈরি মনে করতে হয় তবে তো এই দুটি আয়াত পড়ে মুসা (আঃ) ও ঈসা (আঃ) কে নুরের তৈরি বলতে হবে।

একটি আয়াত পড়ে আপনি হয়ত স্পস্ট নাও বুঝতে পারেন, কিন্তু এই পাচটি আয়াত পড়ার পরে আপনার কাছে "আলো" এর অর্থ পরিস্কার হয়ে যাবে। আল্লাহ "আলো" বলতে মোমবাতির আলো বা কোন নবী আলোর তৈরি এটা বোঝান নি। তিনি আলো বলতে বুঝিয়েছেন ইমানের আলো, বুঝিয়েছেন সঠিক পথ। আমরা যেমন বলে থাকি জ্ঞানের আলো, সত্যের আলো।

এতক্ষনে আশা করি বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন – না পারলে সমস্যা নেই। আপনার জন্য নীচের আয়াত।

- বল, আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ , আমার প্রতি ওহী হয় যে তমাদের আল্লাহই একমাত্র ইলাহ (মাবুদ) অতএব তোমরা তাহারই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তাহারই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের (যারা শিরক করে) জন্য। (সুরা হা-মিম আস-সিজদা -৬) - [সুরা ৪১ আয়াত ৬]

এই আয়াতে, আল্লাহ রাসুল (সাঃ) কে নির্দেশ দিয়েছেন এটা বলতে যে তিনি (রাসুল) আমাদের মতন একজন মানুষ।

কোরআনের কথা তো শুনলেন, এখন যুক্তির কথা শুনুন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সৃস্টি করেছেন তার ইবাদত করার জন্য। দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তার দেওয়া নিয়মাবলী (যা কিতাবে অবতীর্ন হয়েছে) মেনে চলার জন্য। দুনিয়া আমাদের জন্য একটি পরীক্ষা। এই যুগের লোকদের জন্য কিতাব হল কোরআন আর এর নিয়ম কিভাবে মেনে চলতে হয় তার উদাহরন রাসুল (সাঃ) নিজে। আমরা জানি, পরকালে আমাদের বিচার করা হবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজে এই বিচার করবেন, কাজেই এর ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ থাকবে না। এখন আপনিই বলুন এটা কেমন ন্যায়বিচার হল? আপনাকে ও আমাকে বলা হয়েছে রাসুল (সাঃ) এর মতন জীবন যাপন করতে - যিনি কিনা নুরের তৈরি। আর আমরা হলাম মাটির তৈরি। উনার সৃস্টি আমাদের থেকে আলাদা। বিষয়টি এমন হল যে, একটি কবুতরকে একটি ময়ুর এর মতন চলতে বলা হচ্ছে আর না পারলে শাস্তি। এরকম অন্যায় বিচার আল্লাহ করেন না।

মহানবী (সাঃ) এর সাথে আমাদের পার্থক্য শুধু একটা - উনি আল্লাহর নির্বাচিত বান্দা ছিলেন, উনার কাছে অহী আসত। এছাড়া আমাদের মতন মানুষ ছিলেন তিনি। পাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে আপনার যেমন কস্ট হয়, ঠিক তেমনি কস্ট হত উনার। আপনাকে শয়তান যেমন ধোকা দেয় ঠিক তেমন ধোকা তাকে শয়তান দিতে চেস্টা করত। পরোকালে আমাদের বিচার ন্যয়বিচার তখন হবে যখন জিজ্ঞেস করা হবে, রাসুল (সাঃ) একজন মানুষ হয়ে (আমাদের মতন প্রতিবন্ধকতা স্বত্তেও) কোরআন মেনে চলতে পারলে আমরা মানুষ হয়ে কেন পারিনি।

(উনার উপরে আল্লাহর বিশেষ রহমত ছিল - আমাদের দ্বারা উনার মতন পারা সম্ভব নয় - যেটুকু কোরআন মানলে দোজখের আগুন থেকে বাচা যায়, সেটুকু মানতে পারলে চলবে)

একজন মানুষ হিসাবে আমাদের মতন মানুষ তিনি - তাকে অতিমানব বানাতে এবং এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে ইসলামে নিষেধ করা আছে। এই বাড়াবাড়ি করতে করতে এক পর্যায়ে লোকেরা নবীকে আল্লাহর পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে, যেমন ঈসা (আঃ) কে নিয়েছিল। এটাকে শিরক বলে। শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ।

আমাদের দেশের বেশিরভাগ বইতে লেখা আছে আল্লাহ নুরের তৈরি। নীচের আয়াত দেখুন।

- সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি সৃস্টি করেছেন মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবী, আর তিনি তৈরি করেছেন অন্ধকার ও আলো। তবুও যারা অবিশ্বাস পোষন করে তারা প্রভুর সাথে সমকক্ষ দাড় করায় (সুরা আনআম-০১)

আয়াতে একটা কথা স্পস্ট, আল্লাহ নুর (আলো) ও অন্ধকার সৃস্টি করেছেন। আলো উনার একটা সৃস্টি। সেই আলো দিয়ে আবার কিভাবে স্রস্টা নিজেই তৈরি হলেন? উনার আগে তো আলো ছিল না। আসলে আল্লাহ দেখতে কেমন, কি দিয়ে তৈরি এসব জানার বা বোঝার কোন ক্ষমতা আমাদের নেই। উনি আমাদের জ্ঞান ও বোঝার সীমার বাইরে। তাই এ বিষয়ে কিছু চিন্তা করতে গেলে ভুল চিন্তা হবে আর পাপ বাড়বে। আমাদের এসব প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে - আল্লাহ তেমনই, যেমন তার (আল্লাহর) হওয়ার কথা। এর বেশি কিছু জানার বা বোঝার ক্ষমতা মানুষের নেই।

আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের সঠিক পথে থাকার তওফিক দান করুন।

|| আমার এই লেখাটি পড়ে যদি একজন ভাইও ভুল ধারনা বাদ দিয়ে (কোরআন ও হাদিসের) সঠিক পথ খুজে - সঠিক পথ ও মত গ্রহন করে তবে নিজেকে ধন্য মনে করব। || 

Comments