স্যার, প্রশ্ন কমন পড়ে নাই !!


অনেক বছর আগের কথা। তখন টিভিতে টক শো এর প্রচলন হয়নি, ছিল সাক্ষাতকার অনুস্টান। এমনই এক অনুস্টানে কোন এক শিক্ষা বোর্ডের উর্ধতন কর্মকর্তার সাক্ষাতকার নেওয়া হচ্ছিল। এর একটি প্রশ্ন এখনো আমার মনে রয়েছে।
প্রশ্নঃ (বোর্ড পরিক্ষায়) অনেক সময় আমাদের ছাত্ররা বলে প্রশ্ন কমন পড়েনি। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কি?

উত্তরঃ ছাত্রদের বোর্ডের থেকে একটি সিলেবাস দেওয়া হয় এবং এই সিলেবাসের বাইরে প্রশ্ন করা হয়না। তারা ওই সিলেবাস ফলো করলে প্রশ্ন অবশ্যই কমন পরবে।

উর্ধতন কর্মকর্তা যথাযত উত্তর দিয়েছেন - সিলেবাসের ভেতরেই প্রশ্ন হয় তাই সিলাবাস ফলো করলে প্রশ্ন অবশ্যই কমন পড়বে।

আসুন আমরা দেখে নেই কমন ও আনকমন প্রশ্ন কাকে বলে।

সবার জানা একটি গল্প দিয়ে উদাহরন দিচ্ছিঃ একবার খরগোশ ও কচ্ছপ এক দৌড় প্রতিযোগীতার আয়োজন করল। বনের সব পশু পাখী সেই দৌড় দেখতে এসেছে। দৌড় শুরু হল। খরগোশ এক দৌড়ে প্রায় অর্ধেক চলে আসল। ওদিকে কচ্ছপ এক পা দুপা করে আস্তে আস্তে হাটছে। এই দেখে খরগোশ ভাবল একটু ঘুমিয়ে নেই, কচ্ছপের আসতে আরো অনেক সময় বাকী। সে ঘুমিয়ে পড়ল। কিছু সময় পরে হটাত হৈ চৈ শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখল, কচ্ছপ ইতিমধ্যে দৌড় শেষ করে ফেলেছে। বেশী আত্মবিশ্বাসী ও অহঙ্কারি খরগোশ পরাজিত হল। ওদিকে, না থেমে ধীরে ধীরে লক্ষ্যে চলতে থাকা কচ্ছপই জয়ী হল।

সম্ভাব্য প্রশ্নসমুহ-

১। কারা দৌড় এর প্রতিযোগীতে করেছিল?

২। কে কে এই দৌড় দেখতে এসেছিল?

৩। কচ্ছপ কিভাবে দৌড়াচ্ছিল?

৪। দৌডের মাঝে খরগোশ কি করল?

৫। প্রতিযোগীতায় কে জিতল এবং কেন?

৬। কে হারল এবং কেন?

ভালো করে ঠান্ডা মাথায় উপরের প্রশ্নগুলো পড়ুন। এবার অনেক ভেবে চিন্তে আমাকে বলুন - এই ৬ টি প্রশ্নের মধ্যে কোনটি আপনার কাছে কমন আর কোনটি আনকমন মনে হয়েছে? আসলে, প্রশ্ন কখনো কমন বা আনকমন হয়না। বিষয়বস্তুর ভেতরে জিজ্ঞেস করা যে কোন প্রশ্নই স্বাভাবিক (কমন)। তাহলে আমাদের দেশে "প্রশ্ন কমন বা আনকমন" কথাটা ছাত্র, শিক্ষক, অবিভাবক এমনকি শিক্ষাবিদও বলে থাকে। ঘটনাটা আসলে কি?

৬স্ট শ্রেনীতে পড়ার সময় আমার একটি অভিজ্ঞতা হয়। পাঠ্যবইয়ের এক গল্প ছিল "নাক কাটা রাজা"। এক পাখিকে জব্দ করতে গিয়ে কিভাবে রাজার নিজের নাক কাটা পড়ল তার এক মজাদার শিশুতোশ কাহিনী। স্কুলের শিক্ষক আমাদেরকে সেই গল্প থেকে এক প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিলেন।

প্রশ্নঃ নাক কাটা রাজা গল্পের নামকরনের স্বার্থকতা বর্ননা কর।

আশা করি, প্রশ্নটা শুনেই আপনাদের কাছে বেশ কমন মনে হচ্ছে। যাই হোক - আমরা সবাই উত্তর লিখতে বসলাম। আমি মাঝারী ধরনের ছাত্র। লেখার সময় চিন্তা করলাম যে গল্পটা আমার মজার লেগেছে এবং আমি বেশ কয়েকবার (আগে) পড়েছি। গল্পে ভেতরে দেখেছি সবখানে বাদশাহ লেখা রয়েছে, রাজা নয়। এটুকু ভেবে আমি আমার উত্তর লিখতে শুরু করলাম

"গল্পের ভেতরে সবখানে বাদশাহ লেখা রয়েছে। কোথাও রাজা লেখা নেই। নাক কাটা গিয়েছে বাদশাহর। তাই গল্পের নাম নাক কাটা রাজা ঠিক হয়নি। নামটা হওয়া উচিত ছিল নাক কাটা বাদশাহ।"

খাতা জমা দিলাম। শিক্ষক একে একে খাতাগুলো পড়ে দেখছেন। আমারটা যখন হাতে নিলেন তখন তিনি অন্য ছাত্রদের বিভিন্ন ছেলেমানুষি লেখা ও বানান ভুল দেখে রীতিমতন বিরক্ত। আমারটা হাতে নিয়ে তিনি আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলেন না। আমাকে ডাক দিলেন। ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। আমাকে কোন সুযোগ না দিয়েই মারতে থাকলেন আর বললেন - স্কুলে কি লেখাপড়া করতে আসো নাকি ফাইজলামী করতে আস? আপনারা আবার ভাববেন না যে আমি গ্রামের স্কুলে পড়েছি। আমি শহরের একটি নামকরা স্কুলে পড়েছি।

আমি সত্যই সেদিন বুঝতে পারিনি যে কেন আমাকে মার খেতে হল। উত্তর ভুল হয়েছে এমন আরো ছাত্র ছিল। তাদেরকে শুধু বকাঝকা করলেন আর আমাকে মারলেন কেন। এখন কারনটা বুঝি। আমাকে মার খেতে হয়েছে কারন আমি শিক্ষকের সামনে এমন এক জিনিস এনে দিয়েছি যা পুরো পদ্ধতির বাইরে। এমন জিনিস তিনি কখনো দেখেননি। ওই লেখাতে আমার যুক্তি উনি অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। আবার আমার যুক্তি মেনে নিলে পুরো স্ক্লাসের সবার উত্তর ভুল বলে মেনে নিতে হয়। এমনকি এটাও মানতে হয় যে পাঠ্যবইয়ের লেখক একটি গল্পের ভুল নাম দিয়েছেন। এমন অবস্থায় মেরে আমাকে দমিয়ে দেওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ ছিল না।

"অমুক গল্পের নামকরনের স্বার্থকতা বর্ননা কর" এটি বাংলাদেশের শিক্ষা জগতে খুব কমন(!) প্রশ্ন। সবাই এই প্রশ্নের উত্তর কয়েক শত বার লিখেছেন। একবার ভেবে বলুন তো - এই প্রশ্নের অর্থ কি? এই প্রশ্নে আসলে কি জানতে চাওয়া হয়েছে?

ওই প্রশ্নটির সঠিক অর্থ হল - অমুক গল্পের নাম অবশ্যই স্বার্থক হয়েছে। এর সপক্ষে তোমার মতামত দাও। (স্বার্থকতা বর্ননা কর - এখানে ব্যার্থতার কোন স্থান নেই। নামটি অবশ্যই সঠিক। এবার এর পক্ষে তোমার সাফাই গেয়ে যাও।) আপনার কাছে কিছু জানতে চায়নি। আপনাকে ওদের পক্ষে গুনগান গাইতে বলা হয়েছে)

যে প্রশ্নের দাবী হল গল্পের লেখকের পক্ষে সাফাই গাওয়া - সেই প্রশ্নের উত্তরে আপনি আপনার মেধা, সৃজনশীলতা, মতামত, এসব কিছুই ব্যাবহার করতে পারবেন না। এধরনের প্রশ্নকে কমন প্রশ্ন বলে। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে যেটা ব্যাবহার করতে হবে তা হল - চাটুকারীতা। ব্যাবহার করতে হবে অন্যকে খুশি করে স্বার্থসিদ্ধির কৌশল। স্কুল জীবন থেকেই আমাদেরকে এসব শেখানো হয়। তাই আমারা এসবেই ওস্তাদ।

সঠিক শিক্ষা পদ্ধতি হলে (যা বিদেশে রয়েছে) একই প্রশ্ন অন্যভাবে করা হত। যেমন "অমুক গল্পের নামকরন কি সঠিক হয়েছে? এ ব্যাপারে তোমার মতামত লিখ"। প্রশ্নটি এমন হলে তখন আপনি মেধা ও মতামত কাজে লাগাতে পারবেন, চাটুকারিতা করতে হবে না। তেমন শিক্ষা পদ্ধতি হলে আমাকে "নাক কাটা রাজার" জন্য মার খেতে হোত না। বরং বাহবা পেতাম। আমাদের মন্ত্রী ও শিক্ষাবিদেরা এগুলো বোঝেন। তাই তাদের নিজেদের ছেলে মেয়েদের বিদেশে পড়ান।

আমার সুযোগ হয়েছে কয়েক বছর এমনই এক স্কুলে শিক্ষকতা করার। আবার তিনটা দেশে লেখাপড়া করারও সুযোগ হয়েছ। তাই পার্থক্য বেশ ভালো বুঝতে পারি। আরেক ধরনের কমন প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষকতার সময় একবার স্কুল পরীক্ষার সময় ছাত্ররা অভিযোগ করল

ছাত্ররাঃ স্যার, এটা কি জ্যামিতি দিয়েছেন। ত্রিভুজের দুই বাহুর সমস্টি তৃতিয় বাহু থেকে বৃহত্তর। এটা তো পারিনা।

আমিঃ কি বলছ? এটা ক্লাশে কতদিন বুঝিয়েছি। এটা বইয়ের ১১ নম্বর উপপাদ্য।

ছাত্ররাঃ ১১ নম্বর। তাহলে পারি স্যার।

এখানে লক্ষ্য করুন। প্রশ্নটি পড়ে উত্তর দিতে পারে না কিন্তু বইয়ের ১১ নম্বর বললে উত্তর দিতে পারে। এর মানে সে প্রশ্নটি বোঝে না। শিক্ষক হিসাবে ব্যর্থতা আমারও রয়েছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির কারনেই সে কিন্তু না বুঝে উত্তর দিতে পারছে। কারন সে কমন প্রশ্ন ১১ নম্বর মুখস্ত করে এসেছে। সেই কমন প্রশ্ন আমাকেও প্রশ্নপত্রে দিতে হয়েছে। না বুঝে সেই ছাত্র উত্তর লিখে এসেছে। পাশ করেছে। এভাবেই সে একদিন পাশ করা ডিগ্রীধারী হবে। সঠিক পদ্ধতি হলে সে ওটি না বুঝে পাশই করতে পারত না।

যে কোন বোর্ড পরিক্ষার দুই দিন আগে আপনাদের পাড়ার একজন মাঝারী নামকরা শিক্ষকের কাছে যাবেন। তকে বলবেন কিছু গুরুত্তপুর্ন প্রশ্ন দাগিয়ে দিতে। উনি সারা বই থেকে ১৫টি প্রশ্ন দাগিয়ে দিবেন। এর থেকে কপমক্ষে ৭-৮ টি প্রশ্ন পরীক্ষাতে পাওয়া যাবে যা কিনা উক্ত পরীক্ষায় ৮০% উত্তর দেওয়ার জন্য যথেস্ট। ওই ১৫টি প্রশ্ন পড়লেই ছাত্র পাশ করবে। এগুলোই কমন (!) প্রশ্ন। যখন ওই ১৫টি প্রশ্নের ভেতরে মাত্র ২-৩ টি পরীক্ষায় পাওয়া যাবে তখন বলা হবে প্রশ্ন আনকমন হয়েছে। যদিও সব প্রশ্ন সিলেবাসের ভেতরেই করা হয়। এই প্রশ্ন করার এক ধারা রয়েছে - সেই ধারাটা বজায় রেখেই প্রশ্ন করা হয়। অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা সেই ধারাটা জানেন তাই তারা সফলভাবে বলতে পারেন কোন প্রশ্নটা পরীক্ষায় আসার সম্ভাবনা বেশী।

এমন অভিজ্ঞ শিক্ষক আপনার পাড়াতে একাধিক রয়েছে। একবার চিন্তা করেছেন - এমন শিক্ষক সারা দেশে কতজন রয়েছে? এমন শিক্ষকের ছাত্র কতজন রয়েছে?। তার মানে, কোন বোর্ডের পরীক্ষার কয়েকদিন আগে থেকেই কয়েক লক্ষ লোক জানে যে পরিক্ষায় কি প্রশ্ন আসবে। এই পরীক্ষায় ছাত্ররা নকল নিয়ে যাবে না তো কি করবে? একদিকে আমরা এমন পদ্ধতি বানিয়ে রেখেছি যাতে বোঝা যায় কোন প্রশ্ন পরীক্ষাতে আসবে। অন্যদিকে আমরা নকল প্রতিরোধে কত কি না করছি। যারা নকল না করে সৎ থাকতে চাইছে, তাদের জন্যও বিষয়টা তেমন কঠিন নয়। ১৫-২০টা প্রশ্নের উত্তর জানলেই পাশ করা যাচ্ছে। এর ফলে - আমরা ডিগ্রীধারী লোক পাচ্ছি কিন্তু শিক্ষিত পাচ্ছি না। এমন ডিগ্রীধারীকে একটি ব্যাবসায়ীক চিঠি লিখতে বলুন। পারবে না। কারন আপনি যে চিঠিটি লিখতে বলবেন সেটি কখনো তার শিক্ষকের দাগিয়ে দেওয়া প্রশ্নের মধ্যে ছিল না। তার মানে, চিঠিটি তার জন্য কমন নয়। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, মাস্টার্স পাশ করা লোকের ইংরেজী দরখাস্ত লিখে দেওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। ইংরেজী শিখতে সময় লাগার কথা ৬ মাস থেকে ২ বছর। সেখানে আমাদের দেশে সারা জীবন ইংরেজী পড়েও ইংরেজী শিখতে পারে না। এর কারন ভুল পদ্ধতি।

মোট কথা আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের চিন্তা করতে শেখায় না। বরং চিন্তা করার ক্ষমতা নস্ট করে দেয়। সারা বই না পড়ে বাছাই করা প্রশ্নের উত্তর জানলেই পাশ করা যায়। কিছু শিক্ষা প্রতিস্টানে এর ব্যতিক্রম রয়েছে, কিন্তু তা হাতে গোনা। শিক্ষা ব্যাবস্থা যথেস্ট উন্নতি হয়েছে তার পরেও আমাদের অভ্যাসের কারনে আমরা ওই পুরাতন ধাচেই শিক্ষা চালাচ্ছি। এর ফলে শিক্ষিত লোকেরাই দুর্নীতি, চাটুকারীতা করছে। যেদিন আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যাবস্থা ছাত্রদেরকে চিন্তা করতে শেখাবে সেদিন আমাদের দেশে সঠিক শিক্ষিত লোক পাওয়া যাবে।

Comments