ইয়াবা প্রতিরোধে গাজাখুরি ভাবনা

গত কয়েক দশকে নেশার উপকরন বিভিন্নভাবে বদল হয়েছে। প্রথমে শোনা যেত গাজা, ফেন্সিডিলের নাম। এর পরে শোনা গেছে হিরোইন। এখন শুরু হয়েছে ইয়াবা। এখনকার যুগকে ইয়াবার যুগ বলা চলে। এখন দেশে ইয়াবার দাপটে অন্য নেশা পাত্তাই পাচ্ছে না। এটা একেবারে তারকা নেশা। আমার কাছে সত্যিই অবাক লাগে যে ইয়াবা কিভাবে সবচেয়ে বড় নেশার সামগ্রীতে পরিনত হল। আসুন দেখে নেই এটা আসলে কি।

বার্মার শান নামক এক প্রদেশে ঘোড়ার জন্য এক প্রকার ওষুধ উতপন্ন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ঘোড়াকে দিয়ে শক্তিশালী কাজ (যেমন খাড়া পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ী টানা) করানো। ওরা এই ওষুধ এর নাম দেয় - “ইয়া মা”। যার অর্থ হল - ঘোড়ার ওষুধ। পরে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত ইত্যাদি দেশের শ্রমজ়ীবি মানুষেরা শক্তি যোগানোর জন্য ও দীর্ঘ সময় কাজ করার জন্য এই ঘোড়ার ট্যাবলেট খাওয়া শুরু করে। শক্তি জোগায় বলে অনেক যৌনকর্মীও এই ট্যাবলেট তাদের পেশার জন্য সুবিধাজনক মনে করে। পরবর্তিতে বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই ইয়ামা এখন ইয়াবা নামে পরিচিত। এই ধরনে শক্তি যোগানোর জন্য বিশ্বে অনেক দামী ড্রাগ রয়েছে। অনেক আন্তঃজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন খেলোয়াড় এমন অনেক ড্রাগ গ্রহন করে সমালোচিত হয়েছে। যার অমন দামী ড্রাগ কেনার সামর্থ্য নেই সেই সব শ্রমিকেরা এই ঘোড়ার ট্যাবলেট ইয়বা সেবন করে। যেমন একজন ট্রাক ড্রাইভার যে ২৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাবে। যেমন একজন নির্মান শ্রমিক যে ২২ ঘন্টা কাজ করবে। যেমন একজন নিরাপত্তা কর্মী যে ১৪ ঘন্টা জেগে থাকবে। এরা তো আর তারকা খেলোয়াড়ের মতন দামী ড্রাগ কিনতে পারে না তাই তারা ঘোড়ার ট্যাবলেট দিয়ে কাজ চালায়। এটা হল থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন সহ অন্যান্য দেশের ইয়াবা সেবীদের অবস্থা। একমাত্র ব্যাতিক্রম বাংলাদেশ। এখানে ইয়াবা সেবন করে ধনী আলালের ঘরের দুলালেরা যাদের কাজ করে খেতে হয়না। এছাড়া ইয়াবা বাংলাদেশে এক প্রকারের ফ্যাশনও বটে।

অন্য্যান্য দেশ আর বাংলাদেশের মানুষের নেশার কারন একেবারেই আলাদা। অন্য দেশের তরুনেরা নেশা করে মুলত কোন অঘটনের শিকার হয়ে বা বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। কেউ আবার বেআইনী কাজে জড়িয়ে গিয়ে মাফিয়া চক্রের সাধে জড়িত হয়। বাংলাদেশে এসব নেই। আমাদের দেশে মানুষ নেশা করে মুলত দুটি কারনে। ১। কোন কিছু করার নেই ২। সামাজিক স্টাটাস বজায় রাখার জন্য। উন্নত দেশে বাবা ধনী হলেও দেখা যায় ছেলে ছোট খাটো কাজ করে আয় রোজগার করে নিজেকে ব্যাস্ত রাখে। বাংলাদেশে তেমন হয় না। বাবা ধনী হলে, ছেলে হয় আরো বড় ধনী। তাছাড়া সামাজিক মর্জাদা রক্ষার জন্যই ছেলেটি যে কোন  কাজ করতে পারে না। এমন ধনী বাবাদের বেশীর ভাগই অবৈধ টাকার মালিক। ছেলেটি কোন কাজ না করেই প্রতি মাসে হাত খরচের জন্য যে পরিমান টাকা পায় তা দিয়ে কয়েকটি মধ্যবিত্ত পরিবার চালানো যাবে। কাজও করে না আবার প্রচুর টাকাও পায়। এই টাকা দিয়ে ছেলেটি কি করবে? এর সদব্যাবহারের জন্য নেশা, জুয়া ও পতিতা গমন ছাড়া আর কোন উপায় নেই। এর মধ্যে (টাকা থাকলে) সবচেয়ে সজলভ্য বলে আলালের ঘরের দুলালেরা নেশাকেই বেছে নেয়।

“অমুক গাজা খায়” কথাটা শুনলেই আমরা সেই ব্যাক্তিকে নিম্ন শ্রেনীতে ফেলে দেই। কারন এটি সন্তা ও সহজলভ্য। অপরদিকে “অমুক ইয়াবা খায়” শুনলে আমরা তাকে ভালো মনে করি না ঠিকই কিন্তু সে যে স্টাটাস ওয়ালা লোক তা আমরা ঠিকই বুঝতে পারি। এর কারন একটাই - ইয়াবার দাম অনেক বেশী। আর এটি যেন তেন লোক সংরহ করতে পারে না। মজার ব্যাপার, থাইল্যান্ডে বা ফিলিপাইনে যদি শোনা যায় “অমুক  ইয়াবা খায়” তবে লোকে মনে করে - ওই লেবার (শ্রমিক) তো ঘোড়ার ট্যাবলেটই খাবে। ওখানে কোকেন সেবনকারীকে স্টাটাস ওয়ালা লোক মনে করা হয়।

আসলে ইয়াবা কোন নেশা নয়। মানুষ নেশা করে স্বপ্নের জগতে থকার জন্য। বসে বসে ঝিমানোর জন্য। ইয়াবা এর কিছুই করে না। এটা বরং মানুষকে সাময়িকভাবে শারিরিকভাবে শক্তিশালী - এক কথায় স্টামিনা বাড়িয়ে দেয়। যদিও পরে এটি শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করে। বাংলাদেশে এটাও প্রচলিত আছে যে ইয়াবা যৌনশক্তি বাড়িয়ে দেয়। এটা আসলে ডাহা মিত্থ্যা কথা। ইয়াবা সাময়িকভাবে স্টামিনা বাড়ায়। এখন এই স্টামিনা দিয়ে সে মাটি কাটুক, দৌড় ঝাপ করুক আর যৌনকর্ম করুক, একই কথা। প্রতি বছরে বাংলাদেশের যুব সমাজ ৭০০ কোটি টাকা ফেন্সিডিলের পেছনে খরচ করে। ইয়াবার পেছনে খরচ এর চেয়ে বেশীই হবে। ভারতে ফেন্সিডিল এর বোতলের মুল্য ৭৫ রুপী। কিন্তু বাংলাদেশে তা ৮০০-১০০০ টাকায় বিক্রী হয়। এর কারন হল, এটি বিভিন্ন হাত ঘুরে পদে পদে টাকা দিয়ে অবশেষে গ্রাহকের হাতে পৌছে। ইয়াবা এর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বাংলাদেশে একটি ট্যাবলেট ৫০০ টাকায় বিক্রী হলেও বার্মাতে ঐ ঘোড়ার ওষুধ এর মুল্য ১০-২০ টাকার বেশী হবে না।

নিচের দুটি উদাহরন দেখলে আমার গাজাখুরি ভাবনাটা বুঝতে সুবিধা হবে।

উদাহরন একঃ ২০-২৫ বছর আগে একবার ঢোল কলমি গাছের এক প্রকার পোকার আভির্ভাব হয়েছিল। এই পোকা গায়ে স্পর্শ করলেই নির্ঘাত প্রান হারাতে হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অন্তত ৩০ জনের নিহত হবার খবর পত্রিকাতে আমি নিজ়ে পড়েছি। এরপরে একদিন টেলিভিশনে দেখলাম একজন ডাক্তার সেই পোকা নিজের হাতে ডলে প্রমান করছে যে পোকাটি মোটেও ক্ষতিকারক নয়। পরে জানা গেল এত লোক মারা যাওয়ার ঘটনা আসলে পত্রিকার বিক্রী বাড়ানোর জন্য বানিয়ে বানিয়ে ছাপানো হয়েছে। কিছু লোক অবশ্য মারা গিয়েছিল আর এর কারন ছিল তারা ভয়ে হার্টফেল করেছিল।

উদাহরন দুইঃ বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যেখানে পরীক্ষায় নকল করার অপরাধে ১৬ বছরের ছেলে জেলে যেতে পারে। তার পরেও নকল কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। কারন বোর্ডের প্রশ্ন এমনভাবে করা হয় যে সবাই জানে এই বছর পরীক্ষায় কি প্রশ্ন আসবে। শিক্ষা ব্যাবস্থা আধুনিক করলে (উন্নত দেশের মতন) তখন নকলবাজী অকার্জ হয়ে পড়বে। তা না করে আমরা একদিকে শিক্ষা ব্যাবস্থায় নকলের সুযোগ করে দিচ্ছি আর অপরদিকে নকলের জন্য শাস্তি দিচ্ছি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমার এক লেখা রয়েছে - স্যার, প্রশ্ন কমন পড়ে নাই

গাজাখুরি সেই ভাবনাঃ ইয়াবার ব্যাপারে বাংলাদেশে এটাই হয়েছে। একদিকে আমাদের দুর্নীতগ্রস্ত ব্যাবস্থাতে আলালের ঘরের দুলালের কাছে মাসে মাসে লাখো টাকা তুলে দিচ্ছি। আবার সেই টাকা খরচ করার জন্য ইয়াবা কিনতে গেলে তাকে শাস্তি দিচ্ছি। আবার ওই ঢোল কলমী পোকার মতন এটাও ছড়িয়ে গেছে যে ইয়াবা যৌনশক্তি বাড়ায়। আর পায় কে - এ তো আলাউদ্দিনের চেরাগ হাতে পাওয়া।

যে ট্যাবলেট বার্মার মতন এক দেশ ঘোড়ার জন্য বানিয়েছে সেই ট্যাবলেট ফ্যাক্টরীতে বানানো বাংলাদেশের জন্য মোটেই অসম্ভব নয়। কোটি কোটি ট্যাবলেট বানিয়ে ইয়াবা দেশে ছড়িয়ে দেওয়াটা কয়েক মাসের মধ্যেই সম্ভব। গ্যাস্টিকের ট্যাবলেট যেমন মুদির দোকানেও পাওয়া যায়। ঠিক সেভাবে ঘোড়ার ট্যাবলেট ইয়াবা মুদির দোকানে পাওয়া যাওয়াও বিচিত্র নয়। এমন হলে একটি ট্যাবলেটের মুল্য হবে ৫-১০ টাকা।

এমনটি হলে দুটি ঘটনা ঘটবে। ১। আলালের ঘরের দুলাল ১০ টাকার ইয়াবা কিনে তার লাখ টাকা খরচ করতে পারবে না। ২। কেউ ইয়াবা খেলে লোকে আর তাকে স্টাটাস ওয়ালা লোক মনে করবে না। সবাই বলবে - ওই ঘোড়ার ট্যাবলেট তো ছোটলোকের ট্যাবলেট। এতে করে ইয়াবা একেবারে অপদার্থে পরিনত হবে। ওই পশুর ট্যাবলেট আর কেউ ছুয়েও দেখবে না।

এই কাজটি করতে সরকারের হয়ত অনেক টাকা খরচ হবে। কিন্তু এর চেয়ে হাজার গুন বেশী টাকা প্রতি বছরে ইয়াবার ফাদে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। একবারে শতকোটি টাকা খরচ হলে বাংলাদেশ সারা জীবনের জন্য ইয়াবার অভিশাপ থেকে বেচে যাবে। আর দেশ বেচে যাবে প্রতি বছরে হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়া থেকে।

------------------------
এমনই গাজাখুরী পদক্ষেপ নিয়েছিল একটি দেশ ২০০১ সালে। দেশটির নাম পর্তুগাল। এখন তাদের দেশে নেশার ব্যাবহার ৭০% কমে গেছে। এভাবেই একদিন হয়ত তাদের দেশ থেকে নেশা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমাদের দেশে তো বটেই, বিশ্বের আরো অনেক দেশে একই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। 
বিস্তারিত দেখুন এখানে -  Portugal's radical drugs policy is working    




Comments