জাহেলিয়াত এর যুগ আসলে কোনটা?

রাসুল (সাঃ) এর নবুয়তের আগের যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়াত (অজ্ঞতার যুগ) বলা হয়। সেই সময় দুই ধরনের অজ্ঞতা ছিল। একে তো তাদের জ্ঞান বিজ্ঞান একেবারে অনুন্নত ছিল। তারা মনে করত যে সমতল দুনিয়া চারিদিকে পাহাড় পর্বত দিয়ে ঘেরা। আর আকাশ এই পাহাড়ের উপর ভর দিয়ে রাখা। অনেকে কন্যা সন্তান জীবন্ত কবর দিত। এটা বুঝত না যে, অমানবিক এই কাজ করতে করতে একদিন তারা নারী শুন্য হয়ে যাবে। তখন তাদের পছন্দের পুত্র সন্তান এর জন্ম দেওয়ার মতন নারী আর থাকবে না। এগুলো ছিল তাদের অজ্ঞতা। আর এক প্রকার অজ্ঞতা তাদের ছিল আর তা হল আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাস করত না। তারা তাদের আসল সৃস্টিকর্তার ব্যাপারে অজ্ঞ ছিল।

এসব নিয়ে ইসলামিক বই তো বটেই, অন্যান্য বই পত্রে বিভিন্ন লেখা পড়ে আমাদের ওই সময়ের লোকের সম্পর্কে একটা ধারনা হয়। আর তা হল - তারা ছিল ভয়ঙ্কর ও অমানবিক। তারা সব সময় মারামারী কাটাকাটি করত। এক কথায়, ওই সময়ের মানুষকে আমরা মধ্যযুগীয় বর্বর বলে জানি। আসুন দেখে নেই আসল বর্বর কারা।

মিথ্যা বলাঃ রাসুল (সাঃ) এর বাল্যকালেই তাকে সবাই “আল-আমীন” বলে ডাকত। এই নামটির অর্থ “বিশ্বস্ত”। রাসুল (সাঃ) এর উপরে সবাই আস্থা রাখতে পারত। যেমন কেউ কোন জিনিস তার কাছে জমা রাখলে তা সঠিক সময়ে ফেরত দিতেন। অন্য অনেকেই সেই জিনিস আত্মসাদ করত। সবাই রাসুল (সাঃ) কে “বিশ্বস্ত” নাম দিয়েছে, কিন্তু “সত্যবাদী” নাম দেয়নি। এর কারন হল, সেই যুগে সত্য কথা সবাই বলত। সবচেয়ে বড় কাফের যে ছিল, সেও পারতপক্ষে মিথ্যা বলত না। কথাটা শুনে হয়ত আপনার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

এটা বোঝার জন্য দেড় হাজার বছর পেছনে যেতে হবে না, আপনার দাদার দাদার আমলে গেলেই বুঝতে পারবেন। আপনি, আপনার বাবা ও দাদা উত্তরাধিকার সুত্রে যে সম্পত্তি পেয়েছেন অথবা যে সব সম্পত্তি কিনেছেন তার দলিল আছে। কিন্তু আপনার দাদার দাদা কোন দলিল পত্র ছাড়াই শুধু মুখের কথার উপরে ভরসা করে টাকা দিয়ে সম্পত্তি কিনেছেন। তিনি শুধু মুখের কথা অনুযায়ী উত্তরাধিকার সুত্রে সম্পত্তি পেয়েছেন। দাদার দাদা একজনকে টাকা দিলেন আর সেই ব্যাক্তি মুখে বলে দিল “আজ থেকে এই জমির মালিক আমি নই, উনি” । ব্যাস, বেচাকেনা শেষ।

এমন সমাজ ব্যাবস্থায় একজন মিথ্যা বলা লোক একঘোরে হয়ে যাবে। সে কেনা বেচা করতে পারবে না, তার সাথে কেউ আত্মীয়তা করবে না। সহজ কথায় এখন যেমন সব ক্ষেত্রে দলিল পত্রের ব্যাবহার রয়েছে, প্রাচীন আমলে সব ক্ষেত্রে মুখের কথা ব্যাবহার করা হোত। কাজেই সবাই মুখের কথার মুল্য বজায় রাখার জন্যই সত্য বলত। সমাজের উচু শ্রেনীর ও নেতাদের মুখের কথার দাম ছিল আরো বেশী। প্রাচীন যুগে এমন উদাহরনও পাওয়া যাবে যে, মুখের কথার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য সমাজের উচু শ্রেনীর কোন ব্যাক্তি নিজের জীবন পর্যন্ত উতসর্গ করেছে।

এবার দেখুন বর্তমান (সভ্য!) যুগ। আপনি যদি সর্বদা সত্য কথা বলেন তবে আপনি ভদ্রতা জ়ানেন না অথবা বোকা। মিথ্যা বলা এখন ক্ষেত্র বিশেষে ভদ্রতা ও স্মার্টনেস। একজন আপনাকে বেসুরো গলায় একটা গান গেয়ে শোনালো। আপনি তার এই গানটিকে খুব অপছন্দ করেছেন। এরপরেও ভদ্রতা রক্ষার সার্থে আপনাকে বলতে হবে “আপনার গানটি খুব ভালো হয়েছে”। এটুকু মিথ্যা বলার অভ্যাস না থাকলে আপনি এই সমাজে মিশতে পারবেন না বা অভদ্র বিবেচিত হবেন। মিথ্যা বলার কায়দা না জানা থাকলে চাকুরী, ব্যাবসা সবই কস্টকর হয়ে পড়বে। লক্ষ্য করে দেখবেন, যে সুন্দর কায়দা করে মিথ্যা বলতে পারে তাকে আমরা চালু বা স্মার্ট বলে থাকি। যে এটা পারে না সে বোকা। আর কেউ যদি সমাজের উচু শ্রেনীতে নাম লেখাতে চায় তবে তাকে প্রত্যেক কথায় মিথ্যা বলতে হবে। এমন মিথ্যা না বলতে পারলে রাজনীতি করা যায় না। এমন মিথ্যুক না হলে তাকে আমরা নেতা মানি না।

মোট কথা জাহেলি যুগে সত্য না বললে সমাজে মেশা যেত না। নেতারা হতো সবচেয়ে বড় সত্যবাদী। আর এই যুগে মিথ্যা না বলে সমাজে মেশা যায় না। বড় নেতা হতে গেলে বড় মিথ্যুক হতে হয়।

অবাধ যৌনচারঃ জাহেলী যুগ সম্পর্কে আমাদের একটি ধারনা হল, সেই সময়ে অবাধ যৌনচার (যেনা, ব্যাভিচার) ছিল। কথাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু এই কথাটা এই যুগের মানুষের মুখে শোভা পায় না। উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন দেশে সংসদে আইন করে সমকামীতা বৈধ করা হয়েছে। সমকামীরা অনেক দেশে বিশাল ব্যায়বহুল অর্ধনগ্ন সমাবেশ করে। কে কার সঙ্গে যৌনচার করে সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। অনেক বিখ্যাত ব্যাক্তি রয়েছে যাদের বাবা মা কখনো বিয়ে করেনি। উন্নত বিশ্বে প্রায় ৫০% লোকের বাবা মা কখনো বিয়ে করেনি। অনেকে নিজের বাবা কে তা জানে না। নারী পাচার হচ্ছে। কেনা বেচা হচ্ছে , কৃতদাসীর মতন। অনেক সমাজে পরিবারের ঘনিস্ট সদস্যের মধ্যেই যৌনচার এখন ফ্যাশন হয়েছে। আমাদের দেশো কোন অংশে পিছিয়ে নেই। লিভ টুগেদার (বিয়ে না করে একত্রে থাকা) এখন দেশে আধুনিক ফ্যাশান হয়েছে। গভীর রাতে বাশ বাগানে প্রেম হয়না এমন গ্রাম খুজে পাওয়া দুস্কর। তারকা মহলে তো এটা একটা সাধারন ব্যাপার। তারকাতের যৌনচারের একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রকাশ হয়ে যায়। বেশির ভাগই অপ্রকাশিত থাকে। ধর্ষনে সেঞ্চুরী বা শত ছাত্রীর সঙ্গে যৌনচার, এগুলোর কথা নাইবা বললাম।

জাহেলি যুগে অবাধ যৌনচার ছিল কিন্তু সেটাকে কেউই ভালো চোখে দেখত না। সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা এসব করত না। অবাধ যৌনাচার মুলত ছিল দাসী, বাদী, বন্দী ইত্যাদী নারীদের সঙ্গে। সেটা আসলে সামাজিক ভাবে বৈধও ছিল। কিন্তু অমুকের ছেলে অমুকের মেয়ে হোটেল রুমে গিয়ে রাতভর প্রেম এমন ছিল না। কারন সামাজিক মর্জাদার ভয়েই কোন মেয়ে এমন ক্ষেত্রে রাজী হতো না। আর যারা এমন করত তাদেরককে সমাজে কেউ ভালো চোখে দেখত না।

জাহেলি যুগের যৌনচার এর তুলনায় বর্তমান যুগে অবাধ যৌনচার আরো অনেক বেশী হয়। উন্নত বিশ্বে বিষয়টা হয় খোলামেলা, আমাদের দেশে হয় গোপনে। জাহেলি যুগে যে ছেলেটি একসাথে পাচটি প্রেম করেছে তাকে সবাই (প্রতারক জেনে) ছি ছি করতো। আর এই যুগে এমন কাজ করতে পারা ছেলেকে বন্ধুমহলে প্রতিভাবান বলা হয়।  

জাহেলি যুগে যা ছিল নাঃ

- নিজেদের সমাবেশে বোমা মেরে অন্য দলের নাম দেওয়া
- সকাল বিকাল কথা পরিবর্তন করা
- ধর্ষনে সেঞ্চুরী
- ফেন্সিডিল, হেরোইন ও ইয়াবা
- শেয়ার বাজার লুট
- মিথ্যুক নেতা
- দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তা
- অবিচারকারী বিচারক
- ভুমি দখল
- ঘুষখোর কর্মচারী
- মিছিলে গুলী
- দলীয় পুলিশ
- নেতার কাছের লোকের সাত খুন মাফ
- দেশব্যাপী হরতাল
- দেশের সম্পদ আত্মসাধ
- খুন করে, লাশ টুকরো টুকরো করা

আমরা আসলে জাহেলি যুগের চেয়েও আরো বেশী বর্বর যুগে বাস করছি। 


--

Comments