ঈদে মিলাদুন্নবী - বিদাত থেকে সাবধান

ইসলামের পরিভাষায় "বিদাত" বলে একটি কথা রয়েছে। এর অর্থ হল এমন কোন কাজ যা ইসলামিক মনে করে করা হলেও সেটা আসলে ইসলামে নেই। হতে পারে এটি ভালো কাজ কিন্তু এটি ইসলামে নেই। এই ধরনের কাজ সাওয়াব (পুন্য) বাড়ায় না বরং পাপ বাড়ায়। আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত একটি বিদাত হল মিলাদ পড়া। বছরে একবার হয় এমন একটি বিদাত হল এই "ঈদে মীলাদুন নবী"।
হয়ত দেখবেন বড় দাড়ীওয়ালা, বড় ডিগ্রীধারী হুজুরেরা এটা পালন করছে বা সমর্থন করছে। কিন্তু যেই এটা করুক না কেন - এটা ইসলামে নেই। “ঈদে মীলাদুন নবী” হল রাসুল (সাঃ) এর জন্মদিন। রাসুল (সাঃ) যখন জন্মেছিলেন তখন তিনি কোন বিশেষ ব্যাক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন আর দশটা শিশুর মতন সাধারন শিশু। মানুষের জন্ম তারিখ মনে রাখার প্রচলন প্রাচীন যুগে ছিল না। বেশিদুর যেতে হবে না, আপনার দাদা নানা কিংবা উনাদের বয়সী মুরব্বীরা নিজেদের জন্ম তারিখ জানেন না। ঠিক তেমনি, দেড় হাজার বছর আগে আরবের অনুন্নত মরূভুমিতে সাধারন একজন শিশুর জন্ম তারিখ কেউ মনে রাখেনি। রাসুল (সাঃ) চল্লিশ বছর বয়েসে নবী হন। তখন তিনি হন বিশেষ সন্মানিত ও বিখ্যাত ব্যাক্তি। তাই এই সন্মানিত ও বিখ্যাত বাক্তির মৃত্যুর তারিখ সবাই মনে রেখেছে। ইতিহাসে এই তারিখ লেখা রয়েছে । কিন্তু তার জন্মের তারিখ সঠিক জানা যায়নি।

আসলে আমাদের দাদা নানার মতন, রাসুল (সাঃ) নিজেই তার জন্ম তারিখ জানতেন না। জানলেও এই তারিখটি তার এবং তার উম্মতের জন্য বিশেষ কোন দিবস নয়। অনেকে বলে থাকেন রাসুল (সাঃ) এর জন্ম ও মৃত্যু একই তারিখে হয়েছে। এটা একটা অনুমান ভিত্তিক তথ্য যা আমরা সঠিক মনে করে যুগে যুগে বিশ্বাস করে আসছি। জন্ম ও মৃত্যু এর তারিখ এ ধর্মীয় উতসব বা আয়োজন করার পদ্ধতি অন্যান্য ধর্মে রয়েছে। এটাই বিভিন্ন কায়দায় আমাদের ধর্মে ঢুকে গেছে। আমরা এট পালন ও সমর্থন করে পাপের বোঝা ভারী করছি। ইসলামে বিশেষ ধর্মীয় দিবস আছে যেমন ঈদ, লাইলাতুল কদর ইত্যাদি। কিন্তু কারো জন্ম ও মৃত্যু এর উপরে ভিত্তি করে কোন দিবস নেই।

রাসুল (সাঃ) এর জন্ম বা মৃত্যুর দিনে বিশেষ কোন ইবাদত (নামাজ, রোজা, দোয়া ইত্যাদি) করার কথা উনি নিজে কখনো বলেননি। উনার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরে শত শত বছর কেউ "ঈদে মীলাদুন নবী" পালন করেনি। এটা যদি ইসলামিক কাজ হতো তবে রাসুল (সাঃ) অবশ্যই এটা করার নির্দেশ দিতেন। রাসুল (সাঃ) এর আনুমানিক জন্ম তারিখ বের করে "ঈদে মীলাদুন নবী" পালন করা একটি নতুন আবিস্কার। এটা বিদাত - যা পাপ বয়ে আনে।

এই মিলাদুন্নবীতে অনেক এলাকায় মিলাদ পড়ানো হয় যা একটি বিদাত। আপনি অন্য দেশীয় কোন মুসলমানকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন। তারা “মিলাদ” কি জিনিস তা জানে না। এ ছাড়াও রয়েছে বিদাতী কথা বার্তার ছড়াছড়ি। যেমন আশেকে রাসুল, আল্লাহর হাবিব, আশেকে ইলাহী , নুরের তৈরি নবী ইত্যাদী। আমরা অজ্ঞতা বসত এই সব সথা বার্তা শুনে বেশ ভক্তি সহকারে মাথা নড়াই আর “সুবহান আল্লাহ” বলি। এই কথাগুলো শুধু ভুলুই নয়,এগুলো আমাদের পাপ বাড়ায়।

দুঃখের বিষয়, এসব ভুল সধারন লোক তো বটেই, ইসলামিক ডিগ্রীধারী বড় হুজুরেরাই অবলিলায় করে যাচ্ছেন। একবার তারা বিষয়টি চিন্তা করেও দেখেন না।

আশিক ও মাশুক কথা দুটি ইসলামিক আলোচনা কারী ও লেখকদের মধ্যে বেশ প্রচলিত। এই কথা দুটির বাংলা অর্থ হল “প্রেমিক”। বাংলায়, প্রেম ও ভালবাসা নাম দুটি শব্দ রয়েছে। এ দুটো যে এক নয় তা বুঝতে বুদ্ধিজীবি হতে হয়না। আল্লাহ বা তার রাসুলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য “প্রেমিক” শব্দটি শুধু ভুলই নয় বরং এটি চরম বেয়াদবী। হাবিব শব্দটির অর্থ বন্ধু, দোস্ত। রাসুল (সাঃ) কে আল্লাহর হাবিব (বন্ধু) বলা হচ্ছে। অথচ ইসলামের স্তম্ভ আমাদের কলেমাতেই আছে “আব্দুহু ওয়া রাসুলুহু” অর্থাৎ বান্দা ও রাসুল। বান্দা কথাটি খাস বাংলায় বললে হয় দাস, চাকর। একজন দাস কিভাবে মনিবের বন্ধু হয়। এছাড়া রাসুলকে নুরের তৈরি, অমর, গায়েবী খবর জানেন বা অতীমানব ইত্যাদী বানানোর অভ্যাস তো আমাদের অনেক আগে থেকেই আছে।

ইসলামের সম্পর্কে আমাদের ধারনা হল অন্ধের হাতি দেখার মতন। আমরা হাতির কান, শুড় ,লেজ ইত্যাদি কেমন দেখতে তা জানি কিন্তু হাতিটা দেখতে কেমন সেটা ঠিকমতন বুঝতে পারছি না। আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন পরীক্ষা করার জন্য। সেই পরিক্ষার সঠিক উত্তর কেমন হবে তা দেখানোর জন্য রয়েছে নবী ও রাসুল। তারা তাদের জীবন যাপন করেছেন আল্লাহর দেওয়া পদ্ধতি অনুযায়ী। আমরা তেমনটা করতে পারলে দুনিয়ার এই পরীক্ষায় উত্তির্ন হতে পারব। হাশরের ময়দানে এই পরীক্ষারই সঠিক মুল্যায়ন (সঠিক বিচার) করা হবে। রাসুল (সাঃ) এর মতন জীবন যাপন করতে পারাটা আমাদের জন্য পরীক্ষা। এখন রাসল (সাঃ) আমাদের মতন মানুষ না হয়ে যদি অতীমানব বা নুরের তৈরি হন তবে এটা তো সঠিক বিচার হল না। বিষয়টি এমন হল যে একটি কবুতরকে ময়ুরের মতন চলতে, পেখম তুলতে বলা হচ্ছে। আর না পারলেই শাস্তি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ এমন অন্যায় বিচার করেন না। তাই রাসুল (সাঃ) কে আমাদের মতন মানুষ বানিয়েছেন। পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে উনাকে আপনার মতন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হত। শয়তান উনাকে ধোকা দেবার চেস্টা করত। উনি অতীমানব ছিলেন না। উনি অমর নন।

রাসুল (সাঃ) এর প্রতি আমাদের ওই “আশিক” (প্রেমিক) মনোভাবই আমাদেরকে উনার সম্পর্কে এমন ভুল ভাবতে শিখিয়েছে। প্রেমিক প্রেমিকারা পার্কের গাছে ও বিভিন্ন যায়গায় (অমুক + তমুক) নাম লিখে রাখে। এ নজর দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু বিয়ের পরে দায়িত্ব পালনের সময় আসলে দেখা যায় কত ধানে কত চাল। ইসলামের প্রতি আমাদেরও তেমনি শুধু আবেগটাই রয়েছে, পালন করাটা এখনো শিখে উঠতে পারিনি। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখানোর একমাত্র উপায় আল্লাহর ইবাদত করা। রাসুল (সাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা দেখানোর একমাত্র উপায় হল (রাসুলের মাধ্যমে) আল্লাহর দেওয়া ধর্ম ও রাসুলের জীবনী অনুযায়ী জীবন যাপন করা। আবেগ কোন কাজে আসে না।

আল্লাহ আমাদের সৃস্টিকর্তা ও পালনকারী। দুনিয়াতে তিনি আমাদের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন। এই পরীক্ষার সঠিক উত্তর পাওয়া যায় আল্লাহর বানীতে (কোরআন) ও রাসুলের জীবনীতে (হাদিস)। এই পরীক্ষার উপরেই আমাদের পরোকালের অনন্ত জীবনের ফলাফল নির্ভর করছে। রাসুল (সাঃ) আমাদের মতনই একজন আল্লাহর বান্দা যাকে আল্লাহ ইসলাম প্রতিস্টার জন্য মনোনীত করেছেন। রাসুল (সাঃ) আমাদের গুরু, শিক্ষক, ওস্তাদ। আমরা তার শিষ্য, ভক্ত ও অনুসারী। এক্ষেত্রে বাড়া বাড়ি করা ইসলামে নিষেধ রয়েছে। এসব বাড়াবাড়ি আমাদেরকে ধীরে ধীরে ইসলামের রাস্তা ছেকে বিচ্যুত করে দেয়। আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের সঠিক পথে থাকার তওফিক দান করুন।

Comments