মহাকাশ বা মহাশুন্য কত বড়


মহাবিশ্ব বা মহাশুন্য কথাটির ইংরেজীটি (Space) আরো বেশী যুক্তিগ্রাহ্য। স্পেস হল ফাকা যায়গা। একেবারে মহাফাকা যায়গা, মহাবিশ্ব। আমরা সবাই জানি যে এটা অনেক বড়। কিন্তু আসলে যে কত বড় সেটা আমাদের সাধারন জ্ঞানে আমরা বুঝতে পারিনা। বিষয়টা কিছুটা ওই কুয়ার ব্যাঙ্ এর মতন যে কখনো কুয়ার বাইরেই যায়নি। কাজেই সমুদ্র যে কুয়ার চেয়ে কত বড় সেই ধারনাটা তার নেই। আমাদের এই সীমিত জ্ঞানেই মহাশুন্যের বিশালতার ব্যাপারে একটা ধারনা পাবার চেস্টা করব।
সৌরজগতে আমাদের পৃথিবীর অবস্থান
এর আগে সাধারন কিছু বিষয় জেনে নেই। মহাশুন্য হল সীমাহীন ফাকা যায়গা। এর কোন কেন্দ্র নেই। এর কোন সীমানা নেই। নেই কোন উত্তর দক্ষিন, নেই কোন ডান বাম, নেই কোন উপর নিচ। সীমাহীন ফাকা যায়গা। মহাশুন্যে পুঞ্জিভুত গ্যালাক্সি ভেসে বেড়াচ্ছে। মহাশুন্য যেহেতু সীমাহীন সেহেতু এই গ্যালাক্সির সংখাও সীমাহীন। গ্যালাক্সি হল অগনিত তারকা (তারা বা নক্ষেত্র) এর সমাহার। গ্যালাক্সি দেখতে কিছুটা কয়েল এর মতন। সর্বদাই ঘুরছে। একটি গ্যালাক্সির তারকার সংখা অগনিত হলেও অসীম নয়। গ্যালাক্সি বিভিন্ন আকারের হয়ে থাকে। একটি সমুদ্র সৈকতে যতগুলি বালুকনা থাকে , বলা যায় ছোট একট গ্যালাক্সিতে কতগুলো তারকা থাকে। গ্যালাক্সি নিজেই সব তারকাকে সাথে নিয়ে ঘুরছে। তারকাদের চারিদিকে আবার গ্রহ ঘুরছে। গ্রহের চারিদিকে ঘুরছে উপগ্রহ। সুর্য এমন এক তারকা, আমাদের পৃথিবী এমন এক গ্রহ আর চাদ এমন এক উপগ্রহ।
আমাদের গ্যালাক্সি মিল্কিওয়েতে আমাদের সৌরজগতের অবস্থান
মহাশুন্যের আকার অনেক বড় হওয়াতে এখানে দুরত্ব পরিমাপের একক হল আলোকবর্ষ। আলো প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩ লক্ষ কিলোমিটার যায়। এভাবে চলে এক বছরে আলো যতখানি দুরত্ব অতিক্রম করে তাকে আলোকবর্ষ বলে। খসড়া হিসাবে তা দাঁড়ায় ৯,৫০,০০০,০০,০০,০০০ কিমি অর্থাৎ ৯৫ লক্ষ, কোটি কিলো মিটার। দ্রুতগামী যে প্লেনে কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে অন্য দেশে চলে যাওয়া যায় সেই প্লেনে ওই দুরত্ব যেতে সময় লাগবে ১০ লক্ষ ৮৪ হাজার বছর। একই দুরত্ব যেতে আলোর এক বছর সময় লাগে। একে আলোকবর্ষ বলে। এটা সময়ের নয়, দুরত্বের একক।

আগেই বলেছি, কোন কিছুর বিশালতা আমাদের সীমিত জ্ঞানে বোঝাটা কস্টকর। উপরের প্যারাতেই দেখুন। আমি যখন ৯৫ লক্ষ কোটি কিলোমিটারের কথা বলেছি তখন আপনি বুঝেছেন যে এটা অনেক অনেক বড় দুরত্ব। কিন্তু এটা যে কত বড় সেটা আরো ভালোভাবে আন্দাজ করতে পেরেছেন যখন বলেছি যে প্লেনে চড়ে ওটুকু দুরত্ব যেতে ১০ লক্ষ বছরের বেশী লাগবে। এজন্য, মহাশুন্যের বিশালতা বোঝার জন্য আমরা যদি একটি মডেল বানাই তাহলে বিষয়টা আরো ভালো বুঝব। যেমন, খেলনা অনেক গাড়ী আছে যেগুলো দেখতে হুবহু সত্যি গাড়ীর মতন। শুধু আকারে ছোট। এর দরজা খোলা যায়, ভেতরে সীট আছে, চাকা, লাইট, কাচ কি নেই ওতে। কিন্তু সবকিছুই আকারে ছোট। এর সবকিছুই কিন্তু আকারে সামঞ্জস্যপুর্ন । গাড়ি যেমন ছোট এর চাকা বা সীটও তেমন ছোট। ঠিক এভাবে আমরা যদি মহাশুন্যের ছোট একটি সামঞ্জস্যপুর্ন মডেল বানাই তবে মহাশুন্যের আকার সম্পর্কে আরেকটু স্বচ্ছ ধারনা হবে। 
মহাকাশে গ্যালাক্সি যেভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে
আমাদের বানানো এই মডেলটি হবে খুবই ছোট। এই মডেলটিতে একে একে চন্দ্র সুর্য গ্রহ তারা সব বানাবো। ধরুন এই মডেলের মধ্যে পৃথিবীটি হবে একটা গলফ বল বা পিং পং (টেবিল টেনিস) বলের সমান। এই বলটি পৃথিবীর হুবহু মডেল। এতে আনুপাতিক আকারের সাগর, পাহাড় নদীনালা , বন জঙ্গল, দালান কোটা) ইত্যাদি থাকবে। কিন্তু পৃথিবীর হিসাবে বলটি আসলে এত ছোট যে, হাতে নিয়ে এই বলটি দেখলে ওসব কিছুই নজরে পড়বে না। এর উপরে হাত বোলালেও বলটি সম্পর্ন মসৃন মনে হবে। চীনের প্রাচীর, আইফেল টাওয়ার, ইত্যাদী এতই ছোট যে সেগুলো আপনার হাতেও অনুভুত হবে না, চোখেও দেখা যাবে না। একমাত্র হিমালয় পর্বত এর এলাকাটা একটু অমসৃন মনে হবে। এবার শীতের সকালে ওই বলটির উপরে মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ুন। দেখবেন বলটির উপরিভাগ কেমন একটু ভেজা মনে হচ্ছে। এই ভেজাটিই হবে ওই মডেল পৃথিবীর সকল মহাসাগর। হয়ত আজগুবি মনে হচ্ছে। তবে এটুকু নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে আমাদের এই মডেলটি আসলে খুব ছোট। এটি এতই ছোট যে পৃথিবীর মডেলের উপরের জিনিস কিছুই চোখে দেখা যাচ্ছে না।
সুপারনোভা - তারকা বিস্ফোরন
এবার এই মডেলে চাদ, সুর্য্য অন্যান্য তারকা ইত্যাদি আনুপাতিক আকারে ও দুরত্বে বসাই। চাদ হবে মটরশুটির দানার মতন সাইজের। এটি থাকবে (গলফ বল) পৃথিবী থেকে ১১০ মিটার দূরে। সুর্য হবে একটি টেনিস কোর্ট সাইজের আর এটি থাকবে ৩৭ কিলোমিটার দূরে। এভাবে বিভিন্ন দুরত্বে অন্যান্য গ্রহগুলো থাকবে। সবচেয়ে দুরের গ্রহ প্লুটো থাকবে ১৮৫০ কিলোমিটার দূরে। তার মানে ছোট এই সৌরজগতের মডেলটির আকার হবে ভারতের সাইজের। এবার এই মডেলে তারকা বসানো শুরু করি। সবচেয়ে কাছের তারাটা কোথায় বসাতে হবে বলে আপনার ধারনা? দুবাইতে, জাপানে নাকি আমেরিকায়? এটা আসলে আপনার ধারনারও বাইরে যাবে। এই মডেলের সবচেয়ে কাছের তারাটিকে (নামঃ আলফা সেঞ্চুরাই) বসাতে হবে চাদে। আর দুরের তারা কথা তো চিন্তারই বাইরে। কোন তারা হয়ত শনি গ্রহে বাসানো লাগবে। কোন তারা হয়ত সৌরজগতের বাইরে বসাতে হবে। মডেলটি এত ছোট যেখানে পৃথিবীকে একটা গলফ বলের সাইজের বানানো হয়েছে ও চাদকে বানানো হয়েছে মটরশুটির দানা। সেই মডেলেই সৌরজগত হবে ভারতের চেয়ে বড়। সেই মডেলে আমাদের গ্যালাক্সিটি (মিল্কিওয়ে) হবে সৌরজগতের চেয়ে বড়। এত ছোট একটি মডেলে, একটি গ্যালাক্সি যদি সৌরজগতের চেয়ে বড় হয় তবে সীমাহীন সংখক গ্যালাক্সি সম্বলিত এই মহাশুন্যের ওই ছোট মডেলটিও এঁকটি মহাশুন্যে মতনই বড় হবে। এর থেকে মহাশুন্যের বিশালতার একটি ধারনা পাওয়া যায়।

উপরের কথাগুলো বুঝতে কঠিন হলে সহজ আরেকটি পদ্ধতি আছে। আপনারা সবাই পরমানু চেনেন। পরমানু এত ছোট যে একটি সুইয়ের আগাতে ২০০টি সাজিয়ে রাখা যায়। আমাদের সৌরজগতের তুলনায় একটি পরমানুর যত ছোট। আমাদের গ্যালাক্সির তুলনায় পৃথিবী ঠিক তত ছোট। এমনই সীমাহীন সংখক গ্যালাক্সি নিয়েই আমাদের মহাশুন্য। আমাদের সবচেয়ে কছের তারাটি সাড়ে চার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। যদিও সম্ভব নয় তবুও বোঝানোর জন্য বলছি। ওই তারার কোন গ্রহে যদি মানুষ বসতি স্থাপন করতে পারে তবে পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ হবে এরকম- টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা অনুস্টানটি সাড়ে চার বছর পরে দেখা যাবে। মোবাইলে কারোর সঙ্গে কথা বললে “হ্যালো, কেমন আছো” বলার সাড়ে চার বছর পরে সে সেটি শুনতে পাবে। সে আবার “আমি ভালো আছি” উত্তর দিলে আপনি সেটি আরো সাড়ে চার বছর পরে শুনতে পারবেন। অর্থাৎ হ্যালো বলতেই নয় বছর পার হয়ে যাবে। এই হল, সবচেয়ে কাছের তারার অবস্থা। দুরের তারার কথা চিন্তা করতে, ভয় লাগে। 
দুই লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে সুপারনোভা। যে এলাকা জুড়ে বিস্ফোরন হয়েছে তার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দুরত্ব ৩০ আলোকবর্ষ
তাহলে দুরের তারা কি অবস্থা? তারা হল সুর্যের মতন, আগুনের দলা। কোন তারা জ্বলে নিঃশেষ হবার আগে শেষ বারের মতন ধপ করে জ্বলে ওঠে। সৃস্টি হয় বিশাল বিস্ফোরন। একেই সুপারনোভা বলে। খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু আধুনিক দুরবিক্ষন যন্ত্রে বা অন্য কোন যন্ত্রে সুপার নোভা দেখা গেছে বা যন্ত্রে ধরা পড়েছে। হিসেব করে পাওয়া গেছে যে সুপারনোভা হয়েছে যে তারাটিতে সেটি ৫ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। সেই তারা থেকে আলো আমাদের এখানে আসতে ৫ লক্ষ বছর সময় লাগে। এই আলো আসার পরেই তো জিনিসটা আমাদের যন্ত্রে ধরা পরেছে। অর্থাৎ, ওই সুপারনোভা (বিস্ফোরন) হয়েছে ৫ লক্ষ বছর আগে আর তা দেখা যাচ্ছে এখন। হতে পারে আজকে কোন সুপারনোভা হচ্ছে, যেটা দেখা যাবে লক্ষ বছর পরে। পৃথিবীর বয়স ৫০০ কোটি বছর। এমনও অনেক তারা আছে যেগুলো থেকে আলো আমাদের কাছে এখনো (৫০০ কোটি বছরে) এসে পৌছেনি। অসীম এই মহাকাশ।
মহাশুন্য দেখতে যেমন
একটি বিল্ডিং এর গ্যারেজে দাঁড়িয়ে বিল্ডিংটি কেমন দেখতে তা বোঝা যায় না। বিল্ডিংটি দেখতে হলে কয়েক পা হেটে গেটের বাইরে গিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে। ঠিক তেমনি মহাকাশ কেমন দেখতে সেটা দেখতে হলে আমাদেরকে যেখানে গিয়ে দাড়াতে হবে সেখানে আলোর গতিতে যেতে এক হাজার কোটি বছর লাগবে। ওখানে গেলে আমরা মহাশুন্যের একটি ক্ষুদ্র অংশকে উপরের ছবিটির মতন দেখতে পাব। 

Comments

  1. সুবানআল্লাহ! অসিম মহাশুন্যেকে খুব সহজ-সরল করে বুঝালেন। জাযাকাল্লাহ খায়ের।

    ReplyDelete
  2. মজা লাগল, আল্লাহর কি নিয়ামত।

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ ' অনেক সুন্দর করে বুঝিয়েছেন ৷
    মাঝে মাঝে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয় ৷

    ReplyDelete

Post a Comment