মৃত্যুর পরে জীবিত হওয়াটা কেমন

ঈমানের একটি বড় অংশ হল, পরোকাল এবং মৃত্যের পরে পুনরায় জীবিত হবার উপরে বিশ্বাস রাখা। এই জীবিত জিনিসটা কেমন। এটা কি আমাদের এখনকার জীবনের মতন নাকি আলাদা কোন ধরনের। এ ব্যাপারে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলে না। মরার পরে তো কেউ ফিরে আসে না। কাজেই মরার পরের জীবিত হওয়াটা কেমন, ওই জীবনটা কেমন, ইত্যাদি কেউই বলতে পারে না। ইসলামে এই ব্যাপারে যা লেখা আছে সেটা আমরা ভালোভাবে বুঝতে পারিনা। পারব কিভাবে? এটা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যায় না। কাঠালের স্বাধ কেমন - এটা কোনদিন লেখা পড়ে বোঝা যায় না। তাজমহল দেখতে কেমন , এটা লেখা পরে বোঝা যায় না। ইঞ্জেকশনের সুই ফোটানোর কেমন ব্যাথা, সেটা লেখা পড়ে বোঝা যায় না। মরনের পরে কেমন জীবন, সেটা লেখা পড়ে কিভাবে বোঝা যাবে?

আমরা ঠিকভাবে জিনিসটা বুঝি না, যার ফলে আমাদের মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। যেমন- মরনের পরে, কবরে তো মৃতদেহ শুয়ে থাকে, তাহলে প্রশ্নত্তোর কার সাথে? এই প্রশ্ন উত্তর দেবার সময় কি তাহলে জীবিত করা হবে? মানুষ ওই তিনটা সহজ প্রশ্নের উত্তর কেন বলতে পারবে না? তাহলে কি মানুষের স্মৃতি মুছে দেওয়া হবে? মানুষের আত্মা ইল্লিন ও সিজ্জিন নামক দুটি স্থানে থাকবে। তাহলে। হাসরের ময়দানে মানুষ। দলে দলে ইল্লিন ও সিজ্জিন থেকে না এসে, কবর থেকে উঠে দাঁড়াবে কেন? হাসরের ময়দানে কি আবার জীবিত করা হবে? হাসরের ময়দানে নাকি কেউ কাউকে চিনবে না। মানুষের কি তখন স্মৃতি মুছে দেওয়া হবে? এসব প্রশ্নে মাথা খারাপ হবার জোগাড়। এমন আরো অনেক প্রশ্ন আপনাদের কাছেও থাকতে পারে। এগুলোর সঠিক উত্তর আমরা জানিনা , কারন আমাদের কারোই মরার অভিজ্ঞতা নেই। তার পরেও সীমাবদ্ধতার মধ্যে কিছু যুক্তি খোজার চেস্টা করেছি মাত্র।

প্রথম কথা হল, জীবন বা জীবনকাল বলে আমরা যেটা চিনি সেটা আসলে কি? সেটা একটি নির্ধারিত সময় ছাড়া আর কিছুই না। একটা নির্দিস্ট সময় নির্ধারিত আছে, সেই সময়টুকু একজন মানুষ দুনিয়াতে (জীবিত) থাকে। দুনিয়াতে আসা ও ফিরে যাওয়ার মাঝের সময়টুকুই হল জীবন। আমরা যেমন বলি ছাত্রজীবন - যতটুকু সময় ছাত্র থাকি। কর্মজীবন - যতটুকু সময় কর্মে থাকি। ঠিক তেমনই জীবন হল - যতটুকু সময় দুনিয়াতে থাকি। এই আসা যাওয়ার ব ব্যাপারটা আমাদের চোখের সামনে হলেও আমরা সেটা বুঝতে ব্যার্থ। পাঁচ বছরে একটা শিশু, দেখে যে কিভাবে তার ছোট ভাই/বোন এর জন্ম হয়। সে জানে, হাসপাতাল বাচ্চা পাওয়া যায়। আগা গোড়া সব কিছুই তার চোখের সামনে ঘটলেও, বাচ্চা কিভাবে হয়, সেটা সে বুঝতে ব্যার্থ। বড়রা বাচ্চাদেরকে বিভিন্ন বুঝ দিয়ে রাখে, কিন্তু বাচ্চা কিভাবে হয় সেটা তাদেরকে বলে না। আমরাও ঠিক ঐ পাঁচ বছরের শিশুর মতন। আমরা জানি যে নারী-পুরুষের মিলনে বাচ্চা হয়। এটাও এক প্রকারে বুঝ দিয়ে রাখা। কয়েক ফোটা পানি থেকে সম্পুর্ন একটি মানুষ জন্মায়, এটা কিভাবে সম্ভব? এর অন্য কোন রহস্য আছে যেটা আমরা জানি না। কখন, কোথা হতে, কিভাবে মায়ের পেটে বাচ্চা আসে সেটা আমরা জানি না। মায়ের পেটে আসার আগে ওই শিশুটি কোথায় ছিল, সেটা আমরা যেমন জানি না। তেমন এটাও জানিনা, মরার পরে সে কোথায় যায়। জন্ম কোন শুরু নয়, বরং আগমন। মৃত্য কোন সমাপ্তি নয়, বরং প্রস্থান।

আপনি একবার আঙ্গুল দিয়ে নিজেকে দেখানোর চেস্টা করুন। আঙ্গুলটি নিজের বুকের কাছে তাক করে বলুন "এটা হচ্ছি আমি"। আপনি কিন্তু নিজেকে দেখাতে পারেননি। আপনি দেখিয়েছেন আপানার "বুক"। নিজের মুখের দিকে আঙ্গুল দিয়ে বলুন "এটা হচ্ছি আমি"। এবারও আপনি কিন্তু নিজেকে দেখাতে পারেননি। দেখিয়েছেন আপনার "মুখ"। এভাবে শত চেস্টা করেও নিজেকে দেখাতে পারবেন না। যা দেখাবেন এগুলো সবই আপনার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। আপনি এগুলোর মালিক। তাহলে আপনি কোনটা? আপনি হলেন সেই জিনিস (ব্যাক্তি) যার চলে যাওয়াটাকেই মৃত্যু বলে। মরে যাওয়া অর্থ আপনি অন্য কোথাও চলে যাওয়া। যে মানুষটা চলে গেছে (মারা গেছে) তারই অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলোকে আমরা সাদা কপড়ে মুড়িয়ে মাটি চাপা দিয়ে আসি। ওখানে (কবরে) সেই লোকটি নেই। সে অন্য কোথাও আছে। তার প্রশ্নত্তোর, শাস্তি-শান্তি সবকিছুই হয় অন্য কোন জগতে, আমাদের জানা ও বোঝার ক্ষমতার বাইরে।

বোঝা গেল, আমরা যেটাকে মৃত্য বলি সেটা আসলে এক জগত ছেড়ে অন্য জগতে ঢোকা। পরোকালে মানুষের দুনিয়ার সব স্মৃতি মনে থাকবে। ওই জগতে ঢোকার পরে ফেরেশতা পাঠানো হবে ওই সহজ তিনটি প্রশ্ন করার জন্য। তোমার রব কে, তোমার (দ্বীন (ধর্ম) কি, রাসুল (সা) কে। এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর অনেকেই দিতে পারবে না। উত্তর না দিতে পারলে রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যাবস্থা। স্মৃতি মনে থাকলেও ওই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না তার কারন হল, ওই সময়ের জন্য মিথ্যা বলার ক্ষমতা মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। সারা জীবন অন্য কোন ইশ্বরের পুজা করে, প্রশ্নত্তোরের সময়, আমার রব আল্লাহ - এমন বলা যাবে না। যে যা করেছে সেটাই বলবে।

হাসরের ময়দান, যেখানে সব মানুষ লক্ষ বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, সেখানে কেউ কাউকে চিনবে না। অন্য মানুষের কথা তো বাদ দিলাম, মা তার নিজের ছেলেকেই চিনবে না। সেখানেও কিন্তু মানুষের স্মৃতি ঠিকই থাকবে। চিনবে না অর্থ, চেনার মতন সময় ও সুযোগ থাকবে না। সবাই নিজেই এত বিপদের মধ্যে থাকবে যে অন্যকে চেনার সময়ই থাকবে না। তাছাড়া দুনিয়াতে আমরা একে অপরের যাই হই না কেন, আসলে আমরা সবাই একা। কেউ কারো নয়। বোঝানোর জন্যই, নিরুপায় হয়ে, আমাকে পার্থিব একটি উদাহরন দিতে হচ্ছে। একটি সিনেমাতে যেমন একজন আরেকজনের বাবা, মা ভাই বোনের চরিত্রে অভিনয় করে, কিন্তু সিনেমার বাইরে তারা কেউ কারো নয়। ঠিক তেমনিই, এই দুনিয়াতে আমাদের একজন অপরের বাবা, মা , ভাই বোন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা আসলে সবাই একা। পরোকালে মানুষের এই উপলব্ধি হবে। তাই কেউ কাউকে চিনবে না, বা চেনার মতন সুযোগ থাকবে না।

শেষ বিচারের সময় আল্লাহ স্বয়ং বিচারক। এর চেয়ে সুক্ষ ও সঠিক বিচার আর হতে পারে না। সেই সময় কিন্তু মানুষের সবই মনে থাকবে। কোথায় কবে কি অন্যায় করেছে সবই সে জানে। তার পরেও মানুষ মিথ্যা বলবে। বলবে আমি অমুক অন্যায় করিনি। মিথ্যা বলে দোযখের আগুন থেকে বাচতে চাইবে। হ্যা, তখন মিথ্যা বলার ক্ষমতা মানুষের থাকবে। যদিও সেই মিথ্যায় কাজ হবে না। মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাক্ষী দিবে। সেই অন্যায়ের মুহুর্তটাই চোখের সামতে তাকে দেখানো হবে। আল্লাহ সবচেয়ে সেরা ন্যায় বিচারক।

আসলে, দুনিয়ার স্মৃতি মনে না থাকলে ন্যায় বিচার হয় না। বিশ্বের যে কোন আদালতেই, স্মৃতিভ্রস্ট কোন লোকের বিচার করা হয় না। একজন লোক খুন করল, এর পরে কোন দুর্ঘটনায় বা আঘাতে স্মৃতি সবই ভুলে গেল। সে যে খুন করেছে এটাই তার মনে নেই। এমতবস্থায় কোন আদালতই তার বিচার করে না। তাকে পাঠানো হয় মানসিক চিকিতসার জন্য। স্মৃতি ফিরে এলে বিচার করা যেতে পারে। কারন এটাই ন্যায় বিচার। একজন লোক, কি করেছে সেটাই যদি মনে না থাকে তাহলে তার বিচারটা তার কাছে অবিচার মনে হবে। হাশরে ময়দানে, শেষ বিচারের সময়, ন্যায় বিচারে স্বার্থেই আমাদের দুনিয়ার সকল স্মৃতি মনে থাকবে।

Comments

  1. আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক উপর, অনেক সুন্দর পোস্ট লেখার জন্য দোয়া মাগফেরাত কামনা করছি। ধন্যবাদ ভাই আপনাকে।

    ReplyDelete

Post a Comment