আল্লাহ কোথায়




অবিশ্বাসীরা তো বটেই, এটা বিশ্বাসীরাও এটা জানতে চায়। অবিশ্বাসীদের বহু পুরাতন "আল্লাহ কোথায় আছে দেখাও" প্রশ্নটির উত্তর বিশ্বাসীরা দিয়েছে যুগে যুগে। কেউ বলেছে কত কিছুই তো দেখা যায় না। যেমন ব্যাথা, আনন্দ ইত্যাদি। অবিশ্বাসীরা আবার বলেছে - আচ্ছা দেখা যায় না সেটা বুঝলাম। কিন্তু তিনি কোথায় আছেন বা অবস্থান করছেন ? ব্যাস উত্তর চলে আসল - তিনি তো সবখানেই আছেন। হয়ত এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষে মনে একটা ধারনা চলে এসেছে যে আল্লাহ অদৃশ্য, নিরাকার ও সর্বত্রে বিরাজমান। আসলে ইসলামিক শিক্ষা অর্থাৎ কোরআন ও হাদিসের শিক্ষা অনুসারে এটা একটা ভুল কথা। এ বিষয়ে একটু পরে আবার ফিরে আসব। প্রথমে অবিশ্বাসীদের কথা বলে নেই। 

অবিশ্বাসীরা সব সময় বিজ্ঞানকে ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করে। তারা বিজ্ঞান মনস্ক এবং কোন কিছুই যুক্তি প্রমান ছাড়া বিশ্বাস করে না। আল্লাহ বিশ্বাস করে না কারন বিজ্ঞান কোন রকমের যুক্তি ও প্রমান হাজির করে "আল্লাহ আছেন" প্রমান করতে পারে না যে । যতক্ষন গবেষনা করা যায়, সেই পর্যন্তই বিজ্ঞানের দৌড়। যে জিনিস নিয়ে গবেষনা করতে পারে না সেই জিনিস সম্পর্কে কিছুই জানে না। আল্লাহ নিয়ে গবেষনা করা যায় না। এজন্য বিজ্ঞান এব্যাপারে কিছু জানেও না। এক হাজার বছর আগে, কেউ যদি বলত - "বিদ্যুৎ বলে একটা জিনিস আছে যেটা তারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা যায় এবং এটা প্রচন্ড শক্তির উৎস। এমনকি এই বিদ্যুৎ ছুঁয়ে দেখলেই মানুষ মারা যাবে।" এই কথাটা শুনে তখন বিজ্ঞানীরা বলত - তুমি কি আমাকে ভুতের গল্পে বিশ্বাস করতে বলছ? কারন এক হাজার বছর আগে, বিদ্যুৎ কি তা বিজ্ঞান জানত না। হাজার বছর তো দুরের কথা , একশ বছর আগেই মানুষ জানত না যে বিদ্যুৎ স্পর্শ করলেই মারা যেতে হবে। লাইট বাল্ব এর আবিস্কারক টমাস আলভা এডিসন, ১৯০৩ সালে বিদ্যুৎ এর শক্তির ভয়বাহতা প্রমানের জন্য ইলেকট্রিক শক দিয়ে একটা হাতি মেরে দেখিয়েছেন (ছবি দেখুন)। আজকেও এমন অনেক জিনিস আছে যা বিজ্ঞান জানে না, বোঝেও না। কাজেই বিজ্ঞানকে সবজান্তা মনে করাটা মুর্খতা।  

ওই মৃত হাতির কথাটাই ধরুন। ইলেকট্রিক শক দেবার "৫ মিনিট আগে" ও "৫ মিনিট পরে" হাতির দেহে বিজ্ঞান অনুযায়ী কি পার্থক্য আছে? জীব বিজ্ঞান অনুযায়ী তো হাতির শরীরের কাঠামো, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, চামড়া, মাংশ, হাড় ইত্যাদি একই আছে। রাসায়নিক বিজ্ঞান অনুযায়ী হাতির দেহের সব রাসায়ানিক উপাদান একই আছে। পদার্থ বিজ্ঞান অনুযায়ী, হাতির দেহর সব অনু-পরামানু একই আছে। সবই এক। জীবিত ও মৃত হাতির কোন পার্থক্য বিজ্ঞান বলতে পারবে না। অর্থাৎ বিজ্ঞান অনুযায়ী মরা ও জ্যান্ত প্রানী একই জিনিস। জানি অনেকেই এই কথাটি মানবেন না। তারা বলবেন - না, বিজ্ঞান বলবে মরা হাতিটির যেটা নেই, সেটা হল "জীবন"। হ্যা, এখানেই বিজ্ঞান ধরা। জীবন যে কি জিনিসটা বিজ্ঞান বলতে পারে না। আর যেটা বিজ্ঞান চেনে না, সেটা বিশ্বাসও করে না। কাজেই বিজ্ঞানের স্বভাব মতেই "জীবন" এর অস্তিত্ব বিশ্বাস করার সুযোগ বিজ্ঞানে নেই। আপনি বেঁচে আছেন বা আপনার জীবন আছে এটা তো নিশ্চই স্বীকার করেন। সেই জীবনটা কি, কেমন দেখতে, বা কোথায় থাকে এগুলো বিজ্ঞান বলতে পারে না। আপনিও কিন্তু এসব না জেনেই "জীবন আছে" এটা বিশ্বাস করে চলেছেন। নিজের জীবন নিজেই দেখতে পান না তবুও না দেখেই এটা বিশ্বাস করেন। ওদিকে যখন আল্লাহর কথা শোনেন তখন না দেখে বিশ্বাস করতে পারেন না। 


ক্যামেরাকে আমরা কম্পিউটার এর চোখ হিসাবে ধরে নিতে পারি। এই ক্যামেরার সাহায্যে কম্পিউটার ছবি তোলে, ভিডিও করে এবং পরে সেটা দেখাতে পারে। এটা তো কম্পিউটার এর চোখই। এমন ক্যামেরা চোখ রয়েছে বিভিন্ন রোবটেরও। এ পর্যন্ত বানানো সবচেয়ে উন্নত রোবোট হল হোন্ডা এসিমো (HONDA - ASIMO)। মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি দেখতে এই যন্ত্রটি চার ফুট লম্বা রোবট। এটি একমাত্র যন্ত্র যা প্রায় মানুষের মতন পা ফেলে হাটতে পারে এবং হাতে পাঁচ আঙ্গুলও আছে যা প্রায় মানুষের মতনই নাড়াতে পারে। এছাড়া এটি নাচতে পারে, সিড়ি বেয়ে ওঠা নামা করতে পারে, পথ দেখিয়ে আপনাকে নিয়ে যেতে পারে, খাবারের ট্রে এনে দিতে পারে। কথা বলা আর হাত পা নাড়ানো তো এর কাছে কোন ব্যাপার না। এই রোবটেরও ক্যামেরা চোখ রয়েছে যেটা দিয়ে সে দেখে। একজনকে দেখে চিনে রাখতে পারে। আশে পাশের কেউ প্রশ্ন করলে চট করে তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিতে পারে। এই রোবটের রয়েছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা যা ধীরে ধীরে শিখে নিজেই সমৃদ্ধ করে। এত কিছু পারলেও কিন্তু সে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ বোঝে না। কোনভাবেই একে আপনি স্বাদ ও গন্ধ চেনাতে পারবেন না। কারন এই রোবোট গন্ধ দেখতে চাইবে অথবা স্বাদ শুনতে চাইবে। স্বাদ ও গন্ধ বোঝার মতন ব্যবস্থাই নেই এই রোবটের দেহে। পিঠের ব্যাগের মতন দেখতে ওটা ওই রোবটের ব্যাটারী। এর বিদ্যুতেই রোবটটা চলে। এই বিদ্যুতই ওর জীবন। এই রোবটটি কিন্তু বিদ্যুৎ, অর্থাৎ ওর নিজের জীবন চিনে না। তাছাড়া, মানুষ যে কি জিনিস সেটা একটা রোবট কোনদিনই বুঝবে না। যত উন্নত রোবট বানানো হোক না কেন। ওই রোবট যেমন বিদ্যুৎ বোঝে না আমরাও তেমনি জীবন বুঝি না। আমরা আল্লাহর তৈরি। আল্লাহকে দেখার ও জানার ব্যাবস্থা আমাদের শরীরে নেই। অনেক উন্নত করে আমাদেরকে বানানোর পরেও, আল্লাহকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই।


এবার ফিরে আসি বিশ্বাসীদের কাছে। "আল্লাহ সর্বত্রে বিরাজমান" এটা অন্যান্য ধর্মের কথা এবং এটা আসলে ইসলামের বিপরীত। কোরআনে অনেকবার বলা হয়েছে যে আল্লাহ তার আরশে থাকেন। তাছাড়া, তিনি অতীত বর্তমান ভবিশ্যত সবই একইসাথে জানেন। তিনি সবকিছুই একই সাথে দেখেন, শোনেন ও জানেন। যদিও অনেক হাদিসে এসেছে যে আল্লাহ আমাদের "সাথে রয়েছেন"। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তিনি আমাদের সাথে অবস্থান করছেন। তিনি আমাদের নজরে রেখেছেন ও আমাদের প্রয়োজন মেটান। আমাদের সাথে অবস্থান করেন না। আমরা যেমন বলি - অমুক তুমি এগিয়ে চল, আমরা আছি তোমার সাথে। এখানে কিন্তু আমরা সাথে অবস্থানের কথা বলি না। আল্লাহ তার যায়গায় (আরশ) আছেন। তবে সবকিছুই তার আওতায় বা নিয়োন্ত্রনে রয়েছে। তিনি নিজে সর্বত্রে বিরাজমান নন। তাছাড়া আল্লাহর নিরাকার ও অদৃশ্য নন। আল্লাহর আকার আল্লাহর মতন এবং তাঁকে দেখার ক্ষমতা আমাদের নেই।

সুত্রঃ
১। এবং তাহার সমতুল্য কেউ নেই (সুরা ইখলাসঃ ৪)
২। দৃষ্টি তাঁহাকে অবধারন করিতে পারে না; কিন্তু তিনি অবধারন করেন সকল দৃস্টি এবং তিনিই সুক্ষদর্শী, সম্যক পরিজ্ঞাত (সুরা আনআমঃ ১০৩)
৩। আল্লাহ আরশে সমাসীন হনঃ সুরা ৭- আয়াত ৫৪। সুরা ১০- আয়াত ৩ । সুরা ১৩ - আয়াত ২। সুরা ২৫ - আয়াত ৫৯ । সুরা ৩২ - আয়াত ৪ । সুরা ৫০ - আয়াত ৩৮। সুরা ৫৭ -আয়াত ৪

Comments

  1. কথিত আহলে হাদীসদের কাছে আমাদের প্রশ্ন

    আল্লাহ তাআলা আরশেই অবস্থান করলে আরশ সৃষ্টির আগে আল্লাহ তাআলা কোথায় ছিলেন?

    কিয়ামতের সময় সব কিছু যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন আল্লাহ তাআলা কোথায় থাকবেন?

    আল্লাহ তাআলা আরশেই অবস্থান করলে মুসা আঃ কে দেখা দেয়ার জন্য তূর পাহাড়ে কেন ডেকে নিলেন?

    বিভিন্ন সহীহ হাদীস দ্বারা প্রতিয়মান হয় যে, শেষ রাতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে এসে বান্দাদেরকে ইবাদত করার জন্য আহবান করে থাকেন, যেন বান্দা ইবাদত করে।
    এখন প্রশ্ন হল, সারা পৃথিবীতে একই সময়ে শেষ রাত হয় না, এক দেশ থেকে আরেক দেশের সময়ের পার্থক্য রয়েছে। এক ঘন্টা থেকে নিয়ে বার তের ঘন্টা এমনকি বিশ বাইশ ঘন্টাও। তাহলে কি আল্লাহ তাআলা বাংলাদেশের আসমানে শেষ রাতে একবার আসেন, তারপর তিন ঘন্টা পর আবার সৌদিতে যান, তারপর এভাবে একের পর এক দেশের প্রথম আসমান ঘুরতেই থাকেন?
    কুরআন ও সহীহ হাদীসের শব্দসহ উক্ত বিষয়ের সমাধান চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। দুঃখিত, আপনার কমেন্ট অনেকদিন পরে চোখে পড়েছে।
      আল্লাহ্‌ কোথায় আছেন, এই ব্যাপারে আমাদের ভুল ধারনা থাকলে, সেটা আমাদের ঈমান ও আকিদার জন্য ক্ষতিকর।
      এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যেতে হতে পারে। এ কারনেই, এই লেখাতে আমি আল্লাহ কোথায় এটা বলেছি।

      আপনি কোরআন ও হাদিসের আলোকে এমন বিষয়ের ব্যাখ্যা চাইছেন - যেটা সিলেবাসের বাইরে।
      "আরশ সৃস্টির আগে আল্লাহ্‌ কোথায় ছিলেন" এমন প্রশ্নের উত্তর কি কোরআন ও হাদিসে খুজে পাবেন?
      মুসা (আঃ) কে কেন তুর পাহাড়ে ডেকে নিলেন, কিভাবে আল্লাহ্‌ প্রথম আসমানে আসেন - এগুলো কিছুই কোরআন ও হাদিসে খুজে পাবেন না।
      তবে আপনার ২য় প্রশ্নটির উত্তর আছে। কেয়ামতের সময় আল্লাহর আরশ অক্ষত থাকবে।

      আপনাকে বুঝতে হবে, আপনি সেই আল্লাহ্‌ সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে চাইছেন যার সৃষ্টি করা জিনিসই আপনি ভালো করে বোঝেন না। এই কমেন্ট লিখতে পাঁচ মিনিট সময় লাগল। এই সময় জিনিসটি কি, সেটা ধরা বা ছোয়া যায় না অথচ কিভাবে সেটা চলে যায়, কেন সেটা ফেরানো যায় না - এটা আপনি জানেন না। একজন মৃত মানুষের শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিকই থাকে, নেই শুধু প্রান। এই প্রান জিনিসটা কি - সেটা আপনি জানেন না। মানুষকে দশ মিনিট পানিতে চুবিয়ে রাখলে মারা যায়। ওদিকে মায়ের পেটে, পানির ভেতরে একটি শিশু দশ মাস কিভাবে বেচে থাকে - সেটা আপনি জানেন না। আল্লাহর সৃস্টিটাই বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। আল্লাহকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের কিভাবে হবে?

      এ কারনেই, আল্লাহর স্বরূপ জানতে হলে কোরআন ও হাদিসের কথাই মেনে নিতে হবে। কোন কথাটা কোরআন ও হাদিসে আছে, আর কোন কথাটা নেই - সেসব নিয়ে আমাদের মতপার্থক্য (বা বিতর্ক) হবে। তবে আল্লাহর স্বরূপ নিয়ে বিতর্ক তো দুরের কথা, মনে মনে যে কোন একটি ধারনা করলেই পাপের (শিরকের) রাস্তা সহজে খুলে যায়।

      Delete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete

Post a Comment