দেশের স্বার্থেই বিএনপি বিলুপ্ত হওয়াটা জরুরি

পাশাপাশি জমির দুই মালিক ধলা মিয়া ও কালা মিয়া শহরে থাকে। ওখান থেকে তারা ঠিক করল যে তারা চাষীদেরকে কাজে লাগিয়ে দুটো জমিতে একসাথে চাষ করবে। এতে খরচ ও দেখাশোনার ঝামেলাও অর্ধেক। ঠিক হল খরচ ও আয় তারা সমানভাবে ভাগ করে নিবে। ধলা মিয়া বুদ্ধি দিল আলুর চাষ বেশ লাভজনক। কয়েক মাস ধরে চাষাবাদের জন্য খরচ করার পরে এলো ফসল কাটার সময়। ধলা মিয়া ফোনে বলছে, দোস্ত তুমি গাছে কোন অংশ নিবে? উপরের নাকি নিচের? কালা মিয়া ভাবলো নীচের অংশ নিয়ে আর কি হবে, ফল তো উপরে থাকে। সে বলল, আমি উপরের অংশ নিব। ধলা মিয়া বলছে, আচ্ছা ঠিক আছে আমি পাঠিয়ে দিব। কালা মিয়ার বাসায় প্রায় এক ট্রাক আলুর গাছ এসে উপস্থিত। কিন্তু খুজে তার ভেতরে একটিও আলু পেলো না। পাবে কিভাবে, আলু তো কোন ফল নয়, আলু হল গাছের শেকড়। সব আলু তো তখন ধলা মিয়ার ঘরে।

কয়েক মাস পরে আলু চাষের লোকসান পুষিয়ে নিতে কালা মিয়া আবার ধলা মিয়ার সাথে চাষাবাদ শুরু করল। এবার তারা ধানের চাষ করবে বলে ঠিক করল। ফসল কাটার সময় যথারীতি ধালা মিয়ার ফোন এলো। কালা মিয়া আগের বার উপরের অংশ নিয়ে ঠকেছে। তাই সে দ্রুত বলে দিল, এবার নিচের অংশ নিব। আগের মতনই এক ট্রাক ধান গাছের নীচের অংশ (খড়) এসে উপস্থিত হল কালা মিয়ার বাড়িতে। আর উপরের অংশ (ধান) সবই গেল ধলা মিয়ার বাড়িতে।

কয়েক মাস পরে কালা মিয়া নিজেই ঠিক করে দিল, আখের চাষ হবে। আখ বেছে নেবার কারন হল, আখের পুরো গাছটিই ফল। এবার ফল বা শেকড় খুজতে হবে না। ফসল কাটার সময় ধলা মিয়ার ফোন "দোস্ত, কোন অংশ নিবে?" অনেক ভেবে কালা মিয়া বেছে নিল উপরের অংশ। এবার কালা মিয়ার বাড়ীতে এক ট্রাক আখ গাছের উপরের অংশ হাজির হল। এটা দেখে তো কালা মিয়া বেজায় খুশি। যাক এবার কিছু ঘরে এসেছে। এর পরে সেই আখ খেয়ে দেখে খুব নোনতা। এগুলো বাজারে বিক্রি হবে না। কালা মিয়া তওবা করল আর কখনো চাষাবাদ করবে না, করলেও ধলা মিয়ার সাথে নয়।

"দোস্ত, কোন অংশ নিবে, উপরের নাকি নীচের?" এটা একটা ফাঁদে ফেলার প্রশ্ন। মোট গাছের অর্ধেক কালা মিয়া আর অর্ধের ধলা মিয়া নিলেই তো হয়। প্রতিটি গাছ আলাদা আলাদা অর্ধেক করে কাটতে হবে কেন? আস্ত গাছগুলোরই অর্ধেক নিলে হয়। এই সহজ বুদ্ধিটা কালা মিয়ার মাথায় আসেনি। ধলা মিয়ার ফাঁদে পা দিয়েছে সে লোভে পড়ে। লোভটা হল অর্ধেক নয়, পুরোটাই একা নিতে চেয়েছে। প্রথমবার লোভে পড়ে করেছে। পরের দুইবার করেছে আর্থিক ক্ষতি পুরন করার জন্য। আর এই লোভের ফায়দা উঠিয়ে সবটুকু ফসল ঘরে নিয়ে গেছে ধলা মিয়া।

আমাদের রাজনীতি অঙ্গনে এই কালা মিয়া ও ধলা মিয়া হল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। দোস্ত, কেমন নির্বাচন চাও? তত্বাবধায়ক সহ নাকি ছাড়া? চলে গেল কয়েক বছর। দোস্ত, তত্বাবধায়ক তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে, নির্দলীয় হলে চলবে? চলে গেল কয়েক বছর। দোস্ত, নির্দলীয় না করে সর্বদলীয় করি, কি বল? এভাবেই ফাঁদে ফেলছে বিএনপি কে। দোস্ত, তোমাদের দল বাদ দিয়ে সর্বদলীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে, তুমি কি যোগ দিবে? সেই নির্বাচনে যোগ না দিয়ে বিএনপি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এর পরে নিরপেক্ষ হোক বা না হোক, উপজেলা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ইত্যাদিতে অংশ নিয়ে, নোনতা হলেও কিছু ফসল ঘরে আনার চেস্টা করছে। নইলে দলটি তো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে।

আসলে তত্বাবধায়ক, নির্দলীয় ইত্যাদি নিয়ে কথা বা আন্দোলন হলেও আসলে এগুলো কারো মুল চাওয়া নয়। জনগন চায় নিরপেক্ষ নির্বাচন। তত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে সেটা নিরপেক্ষ হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে এমন ধারনা করে আমাদের জনগন। যদিও বাস্তবতাটা প্রত্যাশার একটু নীচে। আওয়ামী লীগ বার বার বিএনপি কে ফাঁদে ফেলতে পারে তার কারন হল বিএনপি এর ক্ষমতায় যাবার লোভ। হ্যাঁ, রাজনীতিতে সবারই এই লোভ থাকে তবে বিএনপি এর লোভ হল বিনা পরিশ্রমে ক্ষমতায় যাবার।

এরশাদ সরকারের পতনের পরে তত্বাবধায়ক সরকার শাহবুদ্দিন আহমেদ এর অধীনে ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল সম্ভবত সেটাই দেশের সবচেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন, অন্তত জনগনের সেটাই ধারনা। এই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এবং ১৯৯৬ সালে মেয়াদ শেষে, কোন ঝামেলা ছাড়াই ক্ষমতা ত্যাগ করে। ঝামেলা ছাড়া ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াটা তো আমাদের রাজনীতিতে বিরল। ৯১ এর নির্বাচনে বিএনপি এর জয়ের পেছনে জামায়াতের বড় ভুমিকা ছিল। ঘরে ঘরে গিয়ে নিজেদের ভোটারকে তারা বিএনপিতে ভোট দিতে বলেছে। তখন জামায়াতের ট্যাগ লাইন ছিল - আওয়ামী লীগ ঠেকাও। এর পরে ৯১ থেকে ৯৬ পর্যন্ত ছাত্রদল সরাসরি ছাত্র শিবিরকে অত্যাচার করেছে। প্রকাশ্য দিবালকে খুন করেছে এমন রেকর্ড আছে। এভাবেই ৯৬ এর নির্বাচনে জামায়াত বাধ্য হয়েছিল বিএনপি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে। তখন জামায়াতের ট্যাগ লাইন ছিল - প্রকাশ্য শত্রু গোপন শত্রুর চেয়ে উত্তম, বিএনপি ঠেকাও। নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সহযোগীতা করেছে জামায়াত, বিশেষ করে শিবির। ওই সময় আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২৩ বছর পরে ক্ষমতায় যেতে পেরেছিল। সেই সাথে ঝানু দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতের কর্মক্ষমতাও চিনতে পেরেছিল। খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এই দলকে বাড়তে দিলে দেশের অন্য কোন দল মাঠে টিকতে পারবে না। শুরু হয়ে গেল জামায়াতকে দমন - যেটা এখনও চলছে। এর পরে একাধিকবার ক্ষমতা বদল হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু সেই তত্বাবধায়ক সরকারের নিরপেক্ষতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

বিএনপি এর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ অবস্থান হল জামায়াতের সাথে শক্ত ও প্রকাশ্যে জোট বেধে থাকা। সেটা তারা করে না। তারা কাজের সময় গোপনে জামায়াতকে চায় আবার সময় হলে বলে জামায়াতের সঙ্গে অবস্থান একটা কৌশলমাত্র। জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্যে মিশতে বিএনপির কিসের ভয়? মানুষ রাজাকার বলবে এই ভয়, নাকি মানুষ ইসলামিক ভাববে এই ভয়, নাকি দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে সেই ভয়? শাহবাগ জনসভা শুরু হবার পরে যখন হেফাজতে ইসলামের লাখো লোক জড়ো হয়েছিল ঢাকায়। সেই সময় সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা, বড় রাজনীতিবিদ, পুলিশ সবাই ছিল সেই পক্ষে। একটা পরিবর্তনের হাওয়া বইছিল। মনে হচ্ছিল এই জনস্রোত হয়ত বিশাল একটা পরিবর্তন এনে দিবে। সেটা সম্ভবও ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি বিএনপি এর বিনা পরিশ্রমে ক্ষমতায় যাবার লোভের কারনে। বিএনপি মনে করেছিল এই জনস্রোত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করবে আর এই ফাকে বিএনপি সুড়সুড় করে ক্ষমতায় চলে আসবে। এতই সহজ? বিএনপি এর নেতারা ওই জনস্রোতে যোগ না দিয়েই ঘরে বসে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিলেন। এর পরে সারা দেশে বিএনপি ব্যাপক জনসভা করে। তাদের প্রত্যেকটি জনসভাতে উপস্থিত থেকে জামায়াত-শিবিরের পুর্ন সমর্থন ছিল। কিন্তু বিএনপি আনুস্টনিকভাবে একবারও জামায়াতের সাথে তাদের জোট বাঁধার কথা প্রকাশ বা স্বীকার করেনি। এমনকি জামায়াতের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও কিছু বলেনি বললেই চলে। ঠিক আছে, তারা জামায়াতের সঙ্গে থাকবে না, খুব ভালো। কিন্তু তারা নিজেরা তো একটা কিছু করে দেখাবে বা করার চেস্টা করবে। বিএনপি কত বড় প্রতিবাদী দল যে বালুর ট্রাক দিয়েই তাদেরকে থামিয়ে দেওয়া যায়। বিএনপি নেতৃবৃন্দ প্রায় তিন মাস অর্ধাহারে গৃহবন্দী অবস্থা কাটিয়ে এখন বিনা বাধায় বাইরে যেতে পেরে খুশি।

৫ই জনুয়ারীর যে নির্বাচনে যদি বিএনপি যোগ দিত তাহলে তাদের লাভই হোত। জামায়াত এ ব্যাপারে তৈরিও ছিল। তাছাড়া আমাদের দেশের প্রশাসন বা সরকারী কর্মকর্তারা ক্ষমতার পালা বদল দেখে অভ্যাস্ত। তারা ধরেই নিত এবার বিএনপি ক্ষমতায় যাবে। তাই তাদের নিজেদের সুবিধার জন্যই তারা অন্ধভাবে আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিত না। এছাড়া আওয়ামী লিগ লাঠির জোরে ভোটের কারচুপি করতে চাইলে বিএনপি ও জামায়াত মিলে তাদের বিরুদ্ধে দুইটা লাঠি নিয়ে দাড়াতে পারত। বিএনপি এই সুযোগ হাতছাড়া করল দুইটা কারনে। এক, বিনা পরিশ্রমে ক্ষমতায় যেতে যায়। দুই, জামায়াতের সাথে প্রকাশে মিশতে পারে না। ওই নির্বাচনে ৫% লোক ভোট দিলেও সেটি মোটেও অবৈধ নির্বাচন নয়। সবার জন্য মাঠ উন্মুক্ত ছিল। কেউ না আসলে ফাকা মাঠেই গোল হবে। এট মোটেও অবৈধ নয়। বরং নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি এর এখনকার আবদার ও আন্দোলনটাকে অবৈধ বলা যায়। তারা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছাড়তে বলছে। কিন্তু কেন? ফাকা মাঠে গোল দিয়ে হলেও আওয়ামী লীগ তো নির্বাচিত সরকার, ক্ষমতা ছাড়বে কেন? যুক্তি দেখান। আর এই আন্দোলন করে তিন মাস ধরে দেশের এমন পরিস্থিতি করে রাখাটা কোন যুক্তিতে বৈধ? এই আন্দলনে আহত ও নিহতেদের কথা নাইবা বললাম। তারপরও, যদি এমন কোন সম্ভাবনা থাকে যে বিএনপি আমাদেরকে আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কোন সরকার উপহার দিতে পারবে তাহলে আন্দোলন হয়ত মেনে নেওয়া যায়। বিএনপি কোনদিন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবে না। সেটা পারলেও আওয়ামী লীগের চেয়ে ভালো কোন সরকার জনগনকে উপহার দিতে পারবে না। কাজেই এই আন্দোলনকে বিএনপি একটা অপ্রয়োজনীয় জনদুর্ভোগে পরিনত করেছে। এতে তাদের নিজেদের কোন লাভ নেই ও জনগনের ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নেই।

আওয়ামী লীগ কোনদিন ক্ষমতা ছাড়বে না। বিএনপি আন্দোলন করে সফল হবে না। তৃতীয় কোন শক্তি এর মাঝে আসতেও পারবে না। এই টানাহেঁচড়ায় দেশ ও জনগন সবই শেষ। বিএনপি মচকে গেছে কিন্তু ভাংছে না। এমন মচকানো অবস্থায় যদি তারা টিকে যায় তাহলে সেটা দেশের জন্য মোটেও কল্যানকর নয়। যদি বিএনপি ভেঙ্গে যায় তাহলে দলের নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরা অন্য বিভিন্ন দলে ঢুকে যাবে। বিএনপি ভেঙ্গে গেলে জামায়াতের আকার কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে। আওয়ামী লীগ দলটি এমনিতেই জামায়াতকে দমন করতে করতে শক্তিশালী করে ফেলেছে। আকারে বেষে গেলে জামায়াত হবে আরো শক্তিশালী। তারা তখন সামনের কাতারে আওয়ামি লীগের সাথে সরাসরি মোকাবেলা করতে পারবে। বিএনপি এর মতন জিরিয়ে জিরিয়ে ও পান তামাক খেয়ে আন্দোলন তারা করে না।আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই দুটি দলেরই কার্জপ্রনালী এমন যে এদের যে কোন একটা টিকে থাকতে গেলে অপরটিকে ধংশ করেই টিকতে হবে। এভাবেই অবশেষে আমরা একটা দল পাব যেটা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের শাশন ক্ষমতায় থাকবে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবার জন্য যে কোন একটি দল দীর্ঘসময় বিরোধীতা ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকাটা খুব জরুরী। বিএনপি দলটি ভেঙ্গে যেতে যত সময় নিবে, এই প্রক্রিয়াটা ততই পিছিয়ে যাবে, মানুষের দুর্ভোগ তত বাড়বে, দেশের তত ক্ষতি হবে। দেশের ও জনগনের স্বার্থেই, বিএনপি দলটি বিলুপ্ত হওয়া এখন খুবই প্রয়োজন।

Comments