বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এর রহস্যভেদ


সম্প্রতি বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল বিষয়ে একটি লেখা পড়লাম। এই জিনিসটি নিয়ে আগেও কম বেশী পড়েছি।  তবে নতুন ওই লেখাটি পড়ে বোঝা গেল যে বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল বিষয়ে মানুষ ধারনা সেই আগের মতনই আছে।  সে এক ভয়ঙ্কর যায়গা, ওখানে গেলেই রক্ষা নেই, ইত্যাদি। আর সেই কারনেই আজকে এই দু-এক লাইন লিখতে বসলাম।

অন্য সবার মতন আমিও কিশোর বয়সে এই বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল জিনিসটা জানি। কত ধরনের বই পত্র, পত্রিকায় ফিচার , রহস্য আর টান টান উত্তেজনা। এই বিষয়ে বিদেশী লেখকদের বই এর অনুবাদ ছিল। আর দেশের সেবা প্রকাশনী ছিল এমন রহস্যময় বিষয়ের উপরে বই প্রকাশ করতে ওস্তাদ। বিদেশী অনেক লেখক, বিজ্ঞানী অনেক রকমের থিওরী দিলেন। কেউ বলে ওখানে চুম্বক ক্ষেত্র রয়েছে, কেউ বলে ওখানে সময় সুড়ঙ্গ রয়েছে, কেউ বলে ওখানে পানির নীচে আছে ভীনগ্রহবাসীদের ঘাটি। এমন সব থিওরী আর তার সাথে দাতভাঙ্গা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে ভরপুর। এসব তত্ত্ব দু একটা হড়বড় করে বলতে পারলে বেশ জ্ঞানী হিসাবে পরিচয় পাওয়া যেতো। যাই হোক, একটা জিনিস নিয়ে তো আর মানুষ চীরকাল মেতে থাকতে পারে না। আমরাও ধীরে ধীরে এক সময় এই ব্যাপারটা ভুলে গেলাম। 

বছর দশেক আগে, যখন ইন্টারনেট এর যুগ পুরোপুরি চালু হয়েছে, তখন কিভাবে যেন কোন এক প্রসঙ্গে সেই বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল বেরিয়ে আসল। আগের মতন আর বই পত্র সংগ্রহ করে পড়তে হয় না। ইন্টারনেটে, সুইস চাপ দিলেই হাতের কাছে সব তথ্য পাওয়া যায়। তখন খুজতে লাগলাম - বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল আসলে কি জিনিস। 

বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কে প্রায় সবার ধারনাটা এই রকম - ওটা একটা ত্রিভুজ আকৃতির ভয়ঙ্কর যায়গা। ওখানে কোন জাহাজ গেলে সেটা ডুবে যায় বা হারিয়ে যায়। উপরে দিয়ে বিমান গেলে তার যন্ত্র নস্ট হয়, দুর্ঘটায় পড়ে বা হারিয়ে যায়। মোট কথা ওই এলাকা দিয়ে গেলে আর রক্ষা নেই। 

আসুন, আসল বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেলকে চিনি – 

ফ্লোরিডা, পুর্টো রিকো ও বারমুড়া দ্বীপের মাঝখানের তিনকোনা যায়গাটি বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত। এই স্থানটি আমেরিকার দক্ষিন পুর্বে, আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত। এই এলাকাতে প্রত্যেক দিন অনেক জাহাজ ও উড়োজাহাজ চলাচল করে। আজকেও ওই এলাকায় জাহাজ চলছে, উড়োজাহাজ চলছে, ভবিশ্যতেও চলবে। আফ্রিকা মহাদেশ ও উত্তর আমেরিকার দেশ, বিশেষ করে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ইত্যাদি দেশ থেকে আমেরিকা ও কানাডা গামী সব বিমান ওই বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এর উপর দিয়ে যায়। দক্ষিন আফ্রিকা থেকে আমেরিকা আসা যাওয়া করা মালবাহী সকল জাহাজ বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এর ভেতর দিয়ে যায়। এছাড়া ফ্লোরিডা ও বারমুডা দ্বীপের শত শত প্রমোদ তরী চব্বিশ ঘন্টা বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এর ভেতরেই থাকে। এমনকি ওই  এলাকার ভেতরে অনেকগুলি দ্বীপ আছে যার অধিবাসীরা সারা জীবন বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এর ভেতরেই কাটিয়ে দেয় (নীচে ম্যাপ দেখুন)।  কাজেই, ওখানে গেলেই দুর্ঘটনায় পড়বে বা হারিয়ে যাবে এই কথাটা মোটেও ঠিক নয়। 



বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এ বিমান হারিয়েছে ৭ বার। প্রথম বিমান হারিয়েছে ১৯৪৫ সালে, আর শেষেরটা ১৯৬৫ সালে (৫০ বছর আগে)। অর্থাৎ গত ৫০ বছরে ধরে নিয়মিত বিমান চলাচল করার পরেও ওখানে কোন বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। এই স্থানটিকে কি দুর্ঘটনা প্রবন এলাকা বলা যায়? তাছাড়া ২০ বছরে ৭টা বিমান হারানোটা খুব বড় সংখা নয়। বিশ্বের এমন অনেক স্থান আছে যেখান থেকে ওই ২০ বছরে ৪-৫টা বিমান হারিয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো বিখ্যাত হয়নি, বিখ্যাত হয়েছে বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল। এবার আসি জাহাজের কথায়। জাহাজ হারিয়েছে মোট ১০টি। প্রথম জাহাজটি হারিয়েছে ১৮০০ সালে। সবচেয়ে শেষেরটি হারিয়েছিল এক মালবাহী জাহাজ, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫, গত বছর। যদিও হারানোর এক মাস পরে জাহাজটিকে ডুবন্ত অবস্থায় খুজে পাওয়া গেছে। এবার সময়টা দেখুন। ১৮০০ থেকে ২০১৫ অর্থাৎ, ২১৫ বছর। যেখানে প্রতিদিন জাহাজ চলাচল করে, সেখানে ২১৫ বছরে ১০টি জাহাজ ডুবে যাওয়া কি খুব অস্বাভাবিক?

আসলে বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এ রহস্য বলে কিছু নেই। বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল বলে আমরা যেটা চিনি সেটা আসলে একটা প্রচার ছাড়া কিছুই নয়। এই বিষয়ে বই পত্র লিখে, কথা বলে, নিউজ করে জিনিসটাকে রহস্যময় বানিয়ে ছেড়েছে। কোন একটা ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে সেটাকে প্রতিস্টিত করার ব্যাপারে আমেরিকা দেশটি একেবারে এক নম্বর। টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার ঘটনাটি এর বড় প্রমান। হয়ত ৪০-৫০ এর দশকে কোন এক রাজনীতির কারনে কিছু বিমান ও জাহাজ গায়েব করতে হয়েছে, কিংবা কিছু মানুষকে গুম করতে হয়েছে। কেন করেছে, কি করেছে এসব তো আর প্রকাশ করা যায় না। কারন আর যাই হোক, আমেরিকা দেশটির ভেতরে গনতন্ত্র খুব শক্ত। এ কারনেই রহস্য বলে বুঝ দিয়ে রেখেছে। হ্যা, এটা সত্য যে কয়েকটি বিমান ও জাহাজ রহস্য জনকভাবে হারিয়ে গেছে। গুম করা জিনিস তো রহস্যজনক ভাবেই হারায়। বাড়মুড়া ট্রায়াঙ্গেলকে রহস্য হিসাবে প্রতিস্টিত করে একদিকে তাদের গুমের রাজনীতি যেমন আড়াল হয়েছে অন্যদিকে কোটি ডলারের ব্যাবসা হয়েছে মিডিয়া, বই আর গবেষনা থেকে। ২০-২৫ বছর আগে ওই রহস্য বুঝ দিয়ে সারা বিশ্বকে ভুল বুঝিয়ে রেখেছিল। প্রযুক্তির এই যুগে সেটা এত সহজে করা যায় না। কাজেই, এখন বেরিয়ে আসছে - বারমুড়া ট্রায়াঙ্গেল এ রহস্য বলে কিছু নেই

সুত্রঃ 
https://en.wikipedia.org/wiki/Bermuda_Triangle
https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_Bermuda_Triangle_incidents

Comments