ধর্ষন ও হিজাবের টানাপোড়ন


সবাই ধর্ষকের উপযুক্ত শাস্তি দাবী করে। কিন্তু এর মধ্যে এক দল বলছে যে মেয়েরা অতি আধুনিক সাজতে গিয়ে খোলামেলা পোষাক পরে ঘুরে বেরায়। যেটা ধর্ষককে উস্কে দেয়। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে এই কথাটি বলছেন ইসলাম পন্থীরা। ওদিকে অতি আধুনিক একটি দল এই কথাটি কিছুতেই মানতে পারছেন না। খোলামেলা পোষাক ধর্ষনে উতসাহিত করে, এই কথার প্রতিবাদে করতে গিয়ে তো অনেকে রেগে যাচ্ছেন, গালি দিচ্ছেন। তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে পোষাকই যদি ধর্ষনের কারন হবে তাহলে উন্নত বিশ্বে নারীরা অর্ধনগ্ন হয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করে কিভাবে? খুবই সুন্দর যুক্তি। তবে কি করলে ধর্ষন বন্ধ হবে বা কমে যাবে সেটা কিন্তু তারা বলেন না। আসুন দেখি হিজাব ও ধর্ষনের টানাপড়নের শেষ কোথায়।

প্রথম কথা হল,  হিজাব ধর্ষন ঠেকায় না। হিজাবের সাথে আসলে ধর্ষনের কোন সম্পর্কই নেই। ধর্ষক হল কুরুচিপর্ন একজন মানুষ। হিজাব থাকুক আর না থাকুক, তার দরকার দেহ। তাছাড়া, সম্পদ ঢেকে রেখে যেমন ডাকাতি বন্ধ করা যায় না, তেমনি শরীর ঢেকে রেখেও ধর্ষন বন্ধ করাযায় না। ধর্ষন বন্ধ করতে সবচেয়ে বেশী জরুরী হল – সঠিক বিচার ও দৃস্টান্তমুলক শাস্তি। পর্দা করে ধর্ষন ঠেকানো যায় না বলেই ইসলামে পর্দা চালু করেই থেমে থাকেনি, দৃস্টান্তমুলক শাস্তির ব্যাবস্থাও আছে। পর্দা নারীকে সন্মানিত করে,  অন্য মানুষের লালসা ভরা দৃস্টি থেকে তাকে রক্ষা করে, আর সংযত পুরুষকে সংযত থাকাটা সহজ করে দেয়। পর্দা ধর্ষককে ঠেকাতে পারে না। ধর্ষককে ঠেকাতে চাই, কঠিন আইন।  

দ্বিতীয় কথা, হিজাবের আবিস্কার ইসলাম ধর্ম করেনি। বিশ্বের সকল প্রধান ধর্মেই সর্বকালে হিজাব ছিল। ঘোমটা দিয়ে রাখা, চুল ধেকে রাখা, শরীর ঢেকে রাখা ইত্যাদি সন্মানিত নারীর লক্ষন মনে করা হতো সর্বযুগে। দুনিয়া যত আধুনিক হোক না কেন, নগ্ন হয়ে থাকাটা যত বড় ফ্যাশন হোক না কেন, এখনও  সকল দেশেই শরীর ডেকে রাখা নারীকে সবাই সন্মানীত মনে করে। উন্নত বিশ্বে দেখুন। একজন সন্মানিত বিদেশী নারীকে (শিক্ষক, লেখক, নেত্রী, ইত্যাদি) কখনোই সংক্ষিপ্ত পোষাকে দেখা যায় না। সংক্ষিপ্ত পোষাকে দেখা যায় সিনেমার নায়িকা বা মডেল, ইত্যাদি পেশার নারীদেরকে, কারন শরীর দেখানোটা তার পেশার অংশ। হ্যা, বিদেশী নারীরা তরুনী বয়সে শরীর দেখিয়ে খুব স্বাধীনতা উপভোগ করে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে তারা নিজেরাও জানে, শরীর ঢেকে রাখাটা ভালো অভ্যাস এবং শরীর ঢাকা নারীকেই মানুষ সন্মানীত মনে করে। শরীর দেখানো ছবি ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য চাকরী হারিয়েছে, সংসার হারিয়েছে, এমন কয়েক শত উদাহরন আছে উন্নত বিশ্বে। ওদের সমাজে শরীর দেখানো জিনিসটা খারাপ মনে না করলে এমন কিছুই হোত না, বরং সবাই বাহবা দিত। উন্নত বিশ্বে নারীকে অর্ধনগ্ন পোষাক পড়া দেখে আমরা ভুল বুঝি। মেয়েরা অর্ধনগ্ন থাকে ঠিকই। কিন্তু তাই বলে ওখানে অর্ধনগ্ন থাকাতাকে কেউ ভালো কাজ মনে করে না। 

সকল ধর্মে এবং সমাজে যখন হিজাবের প্রচলন রয়েছে, সকলেই যখন শরীর ঢেকে রাখাকে সন্মানিত মনে করে তখন সবাই মুসলমানদের হিজাবের বিরোধীতা কেন করে?  পশ্চিমা দেশ তো আছেই, আমাদের বাংলাদেশেই হিজাব পড়তে দেয় না, এমন উদাহরান আছে। এর কারন হল এলার্জিটা হিজাবে নয়, এলার্জিটা ইসলামে। অন্য যে কোন সমাজ বা ধর্মে হিজাব সন্মানিত হলেও বাধ্যতামুলক নয়। কিন্তু ইসলামে এটি বাধ্যতামুলক। এই জিনিসটা যদি সবাই জেনে যায়, এবং সবাই এর সুফল বুঝে যায় তাহলে সবাই আরো বেশি ইসলামের প্রতি আকৃস্ট হবে। আরও বেশি করে খুজে দেখবে ইসলামে আর কি রয়েছে যাতে মানুষের আরো কল্যান হয়। এছাড়া, নগ্নতা ঘিরে বিশ্বজুড়ে রয়েছে ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যাবসা। কিন্তু সমাজে হিজাবের প্রচলন হলে নারী তার আসল সন্মান বুঝে যাবে, তখন নারীর নগ্নতা দেখিয়ে ব্যাবসায় ভাটা পড়বে। 
বিভিন্ন ধর্মের হিজাব
 
নারীর সন্মানটা আসলে কেমন? সেটা জানার আগে প্রথমে জানতে হবে “সন্মান” জিনিসটা কি। সন্মান হল ভালোবাসার মতন একটা জিনিস। এর কোন সঠিক সংগা নেই। এটা মন দিয়ে অনুভব করতে হয়। এলাকার দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীন নেতাকে সবাই সকাল বিকাল সালাম দেয়। বড় স্যার অফিসে ঢুকলে সবাই উঠে দাঁড়ায়। এগুলো হল সন্মানের প্রদর্শন, সন্মান নয়। আসল সন্মান আসে মন থেকে। কোন রকমের জোর ছাড়াই মন থেকে কারো প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগলে তাকে সন্মান বলে। বেশীরভাগ পুরুষেরই নারীকে সন্মান করার একটা প্রবনতা থাকে। লুইচ্চ্যা বদমাইশের কথা আলাদা। সেই সন্মানের উদাহরন দিচ্ছি। 

নিজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। স্কুল, কলেজে লেখা পড়া করতে গেলে বা কর্মস্থলে, নারী ও পুরুষের মাঝে এক ধরনের নির্দোষ বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক হয়। এমন এক বন্ধুত্বপুর্ন দলে, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর সংখা কম। হতে পারে এমন এক দলে, আপনি সহ ৫ জন পুরুষ আর ২ জন নারী। প্রায় প্রতিদিনই সবার সাথে সবার দেখা হয়, এবং সবাই সবার প্রতি সহানুভুতিশীল। একজনের প্রয়োজনে অন্যজন এগিয়ে আসেন। একদিন, লেখাপড়া বা কাজের ফাকে সবাই মিলে কোন একটি বিষয় আলোচনা করছেন। এমন সময় মেয়ে দুইটি কোন এক কাজের কারনে ১০ মিনিটের জন্য  কোথাও গেল। বাকি রইলেন আপনারা ৫ জন পুরুষ। এমন সময় আপনি যদি অন্যদেরকে বলেন – “দেখেছো আমাদের দলের এই মেয়েটির কোমর কি সুন্দর সরু। যখন হেটে যায়, পেছন থেকে তার হেলানি দুলানি দেখলে আমার যেন কেমন লাগে। আর সামনে থেকে দেখলে তো কথাই নেই।“ আপনার এমন কথা শুনে আপনার ৪ জন পুরুষ বন্ধু খুব রেগে যাবে। তারা আপনার এমন কুরুচিপর্ন চিন্তা ভাবনার জন্য আপনার সঙ্গ ত্যাগ করবে। দু-একজন আপনাকে মারতেও আসতে পারে। তারা হয়তো ওই মেয়ে দুটোকেও বলে দিবে যেন আপনার কাছ থেকে দূরে থাকে। অথচ, অচেনা কোন মেয়ে নিয়ে যদি এই একই কথাগুলো বলেন তাহলে ওই ৪ জন পুরুষের কেউ কেউ আপনার সঙ্গে রসিয়ে আরো রসাত্বক কথা বলবে। কেউ চুপ থেকে শুনে মজা নিবে। আপনার বন্ধুরা অতি ভদ্র হলে শুধু এটা বলতে পারে – মেয়েদের নিয়ে এমন কথা বলতে হয় না। কেউই আপনাকে তিরস্কার করবে না। কেউই আপনার উপরে রাগারাগি চেচামেচি করবে না। একই কথায় দুই রকমের প্রতিকৃয়ার কারন হল দুই যায়গায় নারীটি ভিন্ন। একজন নারী তার কাছে সন্মানের আসনে বসে আছে আরেকজনকে সে চিনেও না সন্মানও করে না। নারীর প্রতি এই ধরনের সন্মানবোধ পশ্চিমা দেশগুলতে খুব একটা দেখা যায় না। একই দলের একজন নারী বন্ধুর অবর্তমানে তাকে নিয়ে রসালো আলাপ করাটা পুরুষ বন্ধুদের জন্য বেশ স্বাভাবিক একটা বিষয়। এর প্রতিবাদ কেউ করেনা, কেউ রাগও হয় না। ওরা রাগ হয় ওদের পরিবার, গার্লফ্রেন্ড, বউ ইত্যাদি নারী নিয়ে কথা বললে। সহপাঠি, সহকর্মী নারীদের নিয়ে যা খুশি বলেন, কোন সমস্যা নেই। ওরাই আপনার রাসাত্বক আলোচনাকে আরও রসালো করে তুলবে।

নারীর যে সন্মানের কথাটা এতক্ষন বললাম, এমন সন্মান জোর করে, ভয় দেখিয়ে, আইন করে আদায় করা যায় না। এমন সন্মান নিতে গেলে নারীকে নিজে সন্মানিত হতে হবে। আর এই সন্মানিত হবার একটাই পথ, নিজের ইজ্জতের হেফাজত করা। নিজের শরীর ঢেকে রাখা ও নিজেকে সহজলভ্য না করা। 

তৃতীয় কথা, উন্নত বিশ্বে অর্ধনগ্ন হয়ে নারীরা কি আসলেই নিরাপদে আছে? উত্তর হচ্ছে – না। তারা নিরাপদে নেই। চোখে দেখা যায় প্রায় নগ্ন হয়ে সমুদ্র সৈকতে শুয়ে আছে, কেউ তাদেরকে ছুয়ে দেখা তো দুরের কথা, একটা কটুক্তিও করে না। এটা দেখে যদি আমরা নিরাপদ ভাবি তাহলে ভুল হবে। আসুন দেখে নেই উন্নত ও অনুন্নত দুই বিশ্বে চিত্র। বাংলাদেশে গড়ে প্রতি লাখে ধর্ষিতা হয় ১০ জন। ওদিকে যুক্তরাস্ট্রে গড়ে প্রতি লাখে ধর্ষন হয় ২৮ জন। অর্থাৎ, মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে ধর্ষনের হার বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশী।  অন্যান্য কিছু উন্নত দেশে বাংলাদেশের চেয়ে কত গুন বেশী ধর্ষন হয় সেটা দেখে নেই। অস্ট্রেলিয়াতে তিনগুন, নারী অধীকারের দেশ নিউজিল্যান্ডে আড়াই গুন, সুইডেনে সাড়ে ছয়গুন, বেলজিয়ামে তিন গুন, শান্তির দেশ নরওয়েতে দুই গুন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, দক্ষিন কোরিয়াতে দেড় গুন। একই সমীক্ষা মতে, পুরো ইউরোপে প্রতি লাখে ধর্ষনের হার ১০ জন, যা কিনা বাংলাদেশের সমান। হ্যা, উন্নত বিশ্বের কিছু দেশ আছে যেগুলোতে ধর্ষনের হার খুব কম যেমন কানাডা, জাপান, হংকং ইত্যাদি। তবে, যে দশটি দেশের ধর্ষনের হার সবচেয়ে কম, তার মধ্যে ৮ টি দেশই মুসলিম ঘনবসতির দেশ। এছাড়া আরো অনেক মুসলিম দেশ আছে যেগুলোর ধর্ষনের হার এত কম যে ধর্ষনের লিস্টে তাদের নামই নেই। কাজেই, উন্নত বিশ্বে অর্ধনগ্ন থেকে নারীরা নিরাপদে থাকে, এই কথাটা ভুল। 

অর্থাৎ, বোঝা গেল, ধর্ষন বন্ধ করতে শক্ত আইনের পাশাপাশি ইসলামিক পরিবেশও প্রয়োজন। শুধু নারীর দেহ ঢেকে রাখলেই এই পরিবেশ হয় না। এমন পরিবেশ হতে হবে যেখানে নারীকে মানুষ সন্মানের চোখে দেখবে। এমন পরিবেশ তৈরি করতে হলে পুরুষদেরকেও ইসামিক নৈতিক শিক্ষা গ্রহন করতে হবে। দেহ ঢেকে রাখা যেমন নারীর পর্দা, তেমনি চোখ ও মন সংযত রাখাটাও পুরুষের পর্দা। আর এই পর্দা জিনিসটা ইসলামে বাধ্যতামুলক। ইসলাম সবচেয়ে কঠিন ধর্ম। সহজে ইসলাম পালন করা যায় না। একজন মানুষ কোনদিন পুজা না করে, কোনদিন মন্দিরে না গিয়ে এমনকি হিন্দু ধর্মের সম্পুর্ন নিয়ম কানুন অস্বীকার করেও সারা জীবন হিন্দু থাকতে পারবে। একজন মানুষ গির্জায় না গিয়ে , প্রার্থনা না করে, আজীবন খৃস্টান থাকতে পারবে। কিন্তু নামাজ না পড়ে মুসলমান থাকা যায় না। ইসলামের কোন ফরজ (অবশ্যই পালনীয়) অস্বীকার করে মুসলমান থাকা যায় না। পর্দা এমনই এক ফরজ যেটা অস্বীকার করে মুসলমান থাকার কোন উপায় নেই। আমাদের সাধারন জ্ঞান, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সমাজ, যে যাই বলুক, মুসলমান থাকতে হলে বিনা দ্বিধায় “পর্দা” মেনে নিতে হবে। আর গুনাহ (পাপ) থেকে বাচতে গেলে, পর্দা পালন করতে হবে। আধুনিক মুসলিম, পালনকারী মুসলিম, বিশ্বাসকারী মুসলিম ইত্যাদি এত প্রকারে ভাগ ইসলামে নেই। ইসলামে মাত্র দুইটি ভাগ আছে। মুসলিম আর অমুসলিম। সাবধান, অতি আধুনিক হয়ে মাঝামাঝি মুসলিম হতে গিয়ে আমরা যেন শেষ পর্যন্ত অমুসলিম না হয়ে যাই

বিশ্বব্যাপী ধর্ষনের হারঃ http://www.nationmaster.com/country-info/stats/Crime/Rape-rate


Comments