যাত্রার বিবেক


শিক্ষককে লাঞ্ছিত করাটা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়।  প্রতি বছরই প্রায় নিয়মিতভাবেই এমন হয়ে আসছে। ছোট খটো নির্যাতনের কথা বাদ দিয়ে, বড় কয়েকটি তুলে ধরছি। এই লেখার শেষে এসব সংবাদের লিঙ্ক দেওয়া আছে।   

২০১১ -  ঠাকুরগাঁওয়ে একজন সাংসদ রানীশংকৈল মহিলা কলেজের অধ্যক্ষকে মারধর করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন কাউকে না জানিয়ে তার জমির গাছ কাটায় তিনি উত্তেজিত হয়ে শিক্ষককে পিটিয়েছেন।
২০১৩ - সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে ঢুকে ডেপুটেশনে থাকা স্কুল শিক্ষককে মারধর করেছেন স্থানীয় সাংসদ। 
২০১৪ - ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের এক শিক্ষককে সাংসদের সমর্থকেরা দিগম্বর ও লাঞ্ছিত করে।
২০১৫ - বাউফলে এক ইউপি সদস্যের বিরুদ্ধে সাইদুর রহমান জুয়েল (৪০) নামে এক কলেজ শিক্ষককে দিগম্বর করে মারধরের অভিযোগ পাওয়া গেছে।  
২০১৫- সিলেটের একজন সংসদ সদস্য অধ্যাপক জাফর ইকবালকে কোর্ট পয়েন্টে ধরে এনে চাবুক মারার খায়েস করেছিলেন। 

নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়ত দিগম্বর কথাটির অর্থ বুঝবেন না। দিগম্বর অর্থ হল - উলঙ্গ। একজন মানুষকে এর চেয়ে বেশী লাঞ্ছিত করা যায় বলে আমার মনে হয় হয় না। সেটাই করা হয়েছে শিক্ষকদের সাথে। এর জন্য ছোট-বড় প্রতিবাদও হয়েছে। তবে ফলাফল শুন্য। অভিযুক্তদের শাস্তি তো দুরের কথা, কেউ তাদেরকে মৃদু শাশন করেছে বলে কখনো শুনিনি। সবচেয়ে বড় কথা, সেটা নিয়ে তথাকথিত জাতির বিবেকের তেমন কোন কার্যকলাপ দেখিনি।  তবে, সম্প্রতি একজন শিক্ষককে কানে ধরে উঠ-বস করানোতে তাদের বিবেকের কান্না দেখার মতন। তাদের একটা অংশ  রাস্তায় দাঁড়িয়ে কানে ধরে প্রতিবাদ করেছে। সময় স্বল্পতা বা ব্যাস্ততার কারনে যারা এমন সুবর্ন সুযোগ হাতছাড়া করেছেন, তাদের অনেকেই নিজের কানে ধরা ছবি ফেসবুকে আপলোড করে স্বস্তি পাচ্ছেন। সাধারন লোক তো বটেই, এই তালিকায় কিছু তারকাও আছেন।  আর, নির্যাতিত শিক্ষকের কাছে ক্ষমা চেয়ে, এই নির্যাতনের বিচার চেয়ে লাইনের পর লাইন লিখে যাচ্ছেন ফেসবুকিয় ব্লগারেরা। তাদের সেই বিবেকবান লেখায় সে কি আবেগ। তারা ছোটবেলায় শিক্ষকদের কেমন সন্মান করতেন, শিক্ষকদের কেমন সন্মান পেতে দেখতেন সেসব আছে তাদের সেই লেখাতে। অনেকে তো আবার সেই মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব এর উদাহরন টেনে এনেছেন। বাদশার ছেলে কেন শিক্ষকের পায় শুধু পানি ঢেলে দিল, কেন নিজের হাত দিয়ে শিক্ষকের পা পরিস্কার করে দিল না, এটাই ছিল বাদশার আক্ষেপ। কত বড় শিক্ষকের মর্যাদা। 

হ্যা, শিক্ষকের মর্যাদা অবশ্যই অনেক বড়। মানুষ যা শেখে তার অনেকাংশ শিক্ষকের কাছ থেকেই শেখে। এই মর্যাদাটা শিক্ষককে অর্জন করে নিতে হয়, অনেক কস্ট করে সেটাকে রক্ষা করতে হয়।  আমাদের ছেলেবেলায়, মর্যাদা ধরে রাখার জন্য শিক্ষকেরা অনেক সংযত জীবন যাপন করতেন। এমন কিছুই করতেন না যাতে মানুষ তাদের দোষ বের করতে পারে। এমনকি তাদের কোন অসংযত কথা বা কাজ ছাত্রদেরকে ভুল শিক্ষা দিতে পারে, এই ভয়ে তারা অনেক সংযত ছিলেন। তেমন সংযম এখনকার অনেক শিক্ষকের মাঝেই দেখা যায় না। তাছাড়া অনেকে এত বেশী বানিজ্যক হয়ে গেছেন যে শিক্ষা পেশাটাই এখন আর তেমন মহত নেই। 

কাহিনী সংক্ষেপঃ তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে আগেই এক ছাত্রকে বেপরোয়া মারধোর করার অভিযোগ ছিল। এ বিষয়ে স্কুল কমিটির শালিশ এর সময় তার ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের বিষয়টি উঠে আসে। তখন ওই আসল বিচার পেছনে চলে গিয়ে ওই ইসলাম বিরোধী বক্তব্যই সামনে চলে আসে। এর আগে নাকি অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তি মসজিদের মাইকে তার ইসলাম বিরোধীতার কথা প্রচার করে এলাকাবাসীকে জানিয়ে দেয়। ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে আসলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সংসদ সদস্যকে খব্র দেওয়া হয়। তিনি সদলবলে সেই শিক্ষককে কানে ধরে উঠ-বস করতে বাধ্য করেন। সংসদ সদস্যের দাবী, জনরোষ থেকে ওই শিক্ষককে রক্ষা করতেই এমন করতে হয়েছে। ওদিকে শিক্ষকের দাবী, তার বিরুদ্ধে বানোয়াট অভিযোগ এনে তাকে পদচ্যুত করার একটি ষড়যন্ত্র। উল্লেখ্য, স্কুলের একছাত্রকে বেপরোয়া মারধোর করার সাক্ষ্য দয়েছে ওই স্কুলের ছাত্ররা। সেই সাথে তার ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের সাক্ষ্যও দিয়েছে তারা। তিনি ছাত্রদেরকে বলেছিলেন - তোদের আল্লাহ নাপাক, তোরাও নাপাক। (সুত্রঃ - বিবিসি বাংলা)   

এবার ঘটনা ভেবে দেখি। তিনি যদি ষড়যন্ত্রের শিকার হন তাহলে এটা খুবই দুঃখজনক। যারা এমন ষড়যন্ত্র করেছে তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্ত ষড়যন্ত্রটা কোথায়? স্কুলের ছাত্ররা তার কার্যকলাপ নিজে চোখে দেখেই তার বিরুদ্ধে বলছে। তিনি বেপরোয়া মেরেছেন এবং ইসলাম নিয়ে কটুক্তি করেছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যারা কানে ধরে এই ঘটনার প্রতিবাদ করছে ও বিচার চাইছে - তারা আসলে কি চায়? কার বিচার চায়? স্থানীয় সংসদ 
যদি নিজে এসে তার ক্ষমতাবলে সেই শিক্ষককে অপমান করতেন তাহলে সেটা বিচারযোগ্য হতে পারতো। তিনি তো তা করেননি। তিনি বলছেন তিনি জনগনের চাপে পড়েই এমন করেছেন। এমনকি থানায় এ ব্যাপারে কোন মামলা হয়নি। কানে ধরে উঠ-বস করানোর জন্য আমাদের দেশের আইনে কি শাস্তির ব্যাবস্থা আছে? অনেকে আবার এও বলছেন যে সংসদ সদস্য আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারেন না। কথা ঠিক আছে, কিন্তু তিনি এটা না করলে জনগনই নিজের হাতে আইন তুলে নিত। 

যারা এই শিক্ষকের প্রতি সহানুভুতিশীল শুধু এই কারনে যে তিনি একজন শিক্ষক। তাদের প্রতি আমার বক্তব্য হল - আপনার চোখের মহান শিক্ষকের যে ইমেজ আছে তিনি সেই ক্যাটাগরিতে পড়েন না। তিনি ছাত্রকে পেটে ঘুষি মেরেছেন এর পরে জোর করে ওষূধ খাইয়েছেন। তিনি ছাত্রদেরকে বলেছেন -  তোদের আল্লাহ নাপাক, তোরাও নাপাক। ব্যাক্তিগত জীবনে আপনি যেসব শিক্ষকদেরকে সন্মান করেন তারা কেউই এমন স্বভাবের নয়। কাজেই শুধুমাত্র একই পেশা বলেই তাদের সাথে উনাকে মেলাবেন না।  তাছাড়া যে মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব  এর আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে শিক্ষকের মর্যাদা করতে চাইছেন। সেই বাদশা এমন স্বভাবের শিক্ষক পেলে চাবুক পেটা করতেন।

যাই হোক, শিক্ষককে দিগম্বর করার ঘটনাটার চেয়ে অনেক বেশী আলোচিত হচ্ছে এই কানে ধরার ঘটনাটি। এর কারনটা অবশ্যই রাজনৈতিক। উনার নাম - শ্যামল কান্তি ভক্ত। তার নাম নজ্রুল ইসলাম, আফজাল হোসেন অথবা মিজানুর রহমান হলে এতো আলোচনা হত না।  এটাকে একটা ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে এই নিয়ে রাজনীতি করে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নস্ট করাটাই এই রাজনীতির উদ্দেশ্য। যে কোন মুল্যেই হোক এদেশের মুসলিমকে উগ্রপন্থী বানাতে হবে। আর এ জন্য খোচাতে থাকতে হবে। তেমন খোচানোই চলছে এখানে। শ্যামল বাবু স্কুলের ভেতরে যে কথাটি বলেছেন সেই কথাটা মসজিদের মাইকে প্রচার করে এলাকাবাসীকে জানানোর মাধ্যমে এই রাজনীতি শুরু হয়েছে। এর পরে এখন চলছে খোচানো। উনাকে একজন ভুক্তোভোগী সংখালঘু  দেখিয়ে তার পক্ষে সহানুভুতি আদায় করা হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছ থেকে। একজন ভুক্তোভোগী শিক্ষক দেখিয়ে ছাত্রসমাজের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে সহানুভুতি।  আর ইসলাম অবমাননার দায়ে তার বিরুদ্ধে মুসলিম জনরোষ তো আছেই। এই লোকটির পক্ষে বিপক্ষে কথা বলতে গেলেই একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে দুই পক্ষে দাড়াতে হচ্ছে।  পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের ধর্মীয় সম্প্রীতি গর্ব করার মতন। তবে, এমন রাজনীতির প্যাচে পড়ে সেই গর্ব কতদিন থাকে সেটাই এখন প্রশ্ন। 

রাজনীতির যাত্রাপালায় বিবেকের ভুমিকায় বরাবরের মতন এবারও আছে শাহবাগীয় গোস্টি। নতুন প্রজন্মের কাছে "যাত্রার বিবেক" জিনিসটা অপরিচিত হবারই কথা। মঞ্চ নাটকের আদী দেশীয় রূপ হল যাত্রা। সেই যাত্রায় নিয়মিত একটি চরিত্র থাকে যেটার নাম হল যাত্রার বিবেক। এই চরিত্রটি আসলে নাটকের কোন অংশ নয়। কারনে অকারনে বিভিন্ন দুঃখ প্রকাশ করতে, লম্বা টান দিয়ে বেসুরো গান গাইতে ও বেশিরভাগ সময় বিরক্ত করতেই আসে এই - যাত্রার বিবেক। যাত্রায়, দুই দেশের রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ হয়ে কত লোক নিহত হল - যাত্রার বিবেকের খবর নেই। ওদিকে রাজার বড় ছেলে বনবাসে চলে গেল - ব্যাস, যাত্রার বিবেক এসে হাজির। গান গেয়ে দুঃখ প্রকাশ করতে লাগল। আমাদের এই শাহবাগীয় গোস্টি হল তেমনই যাত্রার বিবেক। মোমবাতি জ্বালানো, কানে ধরে দাঁড়ানো, ইত্যাদি বিভিন্ন উপায়ে তারা জাতীর বিবেক জাগাতে চেস্টা করেন।                    

সুত্রসমুহঃ             

http://www.jugantor.com/old/news/2015/09/08/320408#sthash.G1JmGoFB.dpuf
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/249040
http://www.jagonews24.com/opinion/news/99646

Comments