শয়তানের মুক্ত জবান


সম্প্রতি সম্প্রতি কয়েক পর্বে বিভক্ত এক ফেসবুকিয় লেখা পড়লাম। লেখাটির নাম "শয়তানের জবানবন্দি"।  একই লেখকের অন্য দু-একটা লেখাও পড়েছি। বোঝা গেল তিনি নাস্তিক নন। তবে সুফিবাদ ধরনের একটি ধারার অনুসারী। তাছাড়া অনেক নাস্তিকের লেখাতে যেমন ইসলাম অবমাননাকর কথা লেখা থাকে, তেমন নেই তার লেখাতে। তিনি খুবই ভদ্র ভাষায় মুসলিমদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বেশ কিছু সত্য দেখিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। আসলে নাস্তিকদের কুরুচিপর্ন কথায় মুসলমানদের কোন ক্ষতি হয় না। কিন্তু এই লেখকের যুক্তিপুর্ন কথায় মুসলমানদের লাভ-ক্ষতি আছে বৈকি।  ইসলাম বিষয়ক সাধারন জ্ঞানের অভাবে আমরা এধরনের যুক্তি শুনে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারনা করে বসে থাকি, যা আমাদের ইমানের জন্য ক্ষতিকর এবং ক্ষেত্র বিশেষে, এমন ধারনা (বা বিশ্বাস) আমাদেরকে ইসলাম থেকে বের করে দেয়। সেই লেখকের পরিচয় গুরুত্বপর্ন নয়, বিষয়টা গুরুত্বপুর্ন।

যুক্তির মাধ্যমে তিনি বেশ কয়েকটি কঠিন প্রশ্নের সম্মুখিন করেছেন।  তার ওই যুক্তির কাছে হার মেনে ইসলামের মুল বিশ্বাসকে দুর্বল করে ফেলতে পারেন অনেকেই। আর সে কারনেই প্রশ্লগুলির উত্তর পাওয়া দরকার আছে। সকল প্রশ্নের উত্তর তো আর একবারে দেওয়া যাবে না। কয়েকটা নিয়ে নাডাচাড়া করলেই মুল বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। প্রশ্নগুলো বুঝতে গেলে ইসলামের নুন্যতম সাধারন জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। 
   
প্রশ্ন ১ঃ আল্লাহ, আদমকে সিজদা করার আদেশ দিয়েছিলন সকল ফেরেস্তাকে ও ইবলিশকে। আল্লহকে অমান্য করার কোন ক্ষমতাই নেই ফেরেশতাদের (তারা বুদ্ধিহীন)। তারা সবাই আদমকে সিজদা করেছিল। কিন্তু, বুদ্ধিমান ইবলিশ চিন্তা করে দেখল যে আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে কেন সিজদা করবে? আল্লাহ তেমন করতে নিষেধও করেছেন (কোরআনে)। তাই সে আদমকে সিজদা করেনি। আসলে অন্য ফেরেশতাদের চেয়ে সে বেশী আল্লাহ ভক্ত। আল্লাহর আদেশেও সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করেনি। আর এটা না করার অপরাধে ইবলিস হয়ে গেলে বিতারিত শয়তান। এ কেমন বিচার আল্লাহর? 
প্রশ্ন ২ঃ শয়তানকে দোষারোপ করা হয় আদম ও হাওয়াকে গন্ধম খাওয়ানোর জন্য, বেহেশত থেকে বিতারিত করার জন্য। কিন্তু সেই গন্ধম খাওয়ার পরেই তো তাদের যৌনতা জ্ঞান আসল, সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা প্রাপ্ত হল। শয়তান এটা না করলে তো এই মানব জাতির অস্তিত্বই থাকত না। শয়তান মানুষের শত্রু হল কিভাবে?
প্রশ্ন ৩ঃ ভালো কাজ আল্লাহ করেন আর মন্দ কাজের দোষ সব শয়তানকে দেওয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর আদেশ না থাকলে সেটা কিভাবে সম্ভব?  জন্ম- মৃত্যুর মালিক আল্লহ। যেনা ব্যাভিচারের দোষ শয়তানের, তাহলে ব্যাভিচারের মাধম্যে জন্ম নেওয়া শিশু কার আদেশে আসে? খুনের দোষ শয়তানের, তাহলে ওই ব্যাক্তির জান কবচ কার হুকুমে হয়? রিজিকের মালিক আল্লাহ, তাহলে চুরি ডাকাতি করে তো মানুষ নিজের রিজিকটাই অন্যের কাছ থেকে নিয়ে আসে। সবই তো আল্লাহর অবদান। এখানে শয়তানকে দোষারোপ করা হচ্ছে কেন? বিতাড়িত শয়তান যদি অভিশপ্তই হবে তাহলে তার আয়ূ বেশী কেন, তার কোন রোগশোক হয় না কেন। সব ভালো সৃস্টি করেছেন আল্লাহ আর সকল মন্দ শয়তানের আবিস্কার। এখানে কি শয়তানকে আল্লাহর সমকক্ষ বা প্রতিদ্বন্দি বানানো হছে না। এমন হলে আল্লাহ সর্বশক্তিমান কিভাবে হলেন? 

মজার ব্যাপার, এগুলো সবই পুরাতন ও সংগ্রহ করা প্রশ্ন। যেভাবে তিনি প্রশ্নগুলি সংগ্রহ করেছেন ঠিক একইভাবে উত্তরও সংগ্রহ করা যায়। যাই হোক, তেমন সংগ্রহ করা উত্তর না দিয়ে নিজের উত্তর দিব। এছাড়া, পুরো বিষয়টিকে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করার চেস্টা করবে যেন আশে পাশের প্রশ্নগুলিরও উত্তর পাওয়া যায়।

উত্তর ১ঃ ইবিলিশ, ফেরেশতাদের মতন নুরের তৈরি নয়। সে আগুনের তৈরি জ্বীন। আদমকে সৃস্টির আগে, হাজার বছর ধরে আল্লাহর ইবাদত করে ইবিলিশ হয়েছিল ফেরেশতাদের সর্দার। একবার একটা খবর আসল যে খুব শিঘ্রই একজন আল্লাহর অভিসম্পাতে পড়তে যাচ্ছে। পাপ করার ক্ষমতা নেই, তবুও ফেরেশতারা সবাই ভয়ে কাপতে লাগল। কে জানে কে হয় সেই ব্যাক্তি। সবাই ইবলিশকে অনুরোধ করল, সে যেন আল্লাহর কাছে দোয়া করে। ইবলিশ সবার জন্য দোয়া করেছে, কিন্তু নিজের জন্য করেনি। কারন হল তার অহংকার। সে ধরেই নিয়েছে, তার মতন লোক আল্লাহর অভিসম্পাতে পড়বে না। আদমকে বানানোর পরে যখন আল্লাহর আদেশে অন্য ফেরেশতারা আদমকে সিজদা করল, তখন ইবিলিশ সিজদা করেনি। সে বলেনি - হে আল্লাহ, তুমি অন্য কাউকে সিজদা করতে বলছ কেন? আমি তো শুধু তোমাকেই সিজদা করি। অথবা এও বলেনি - তুমি কি আমার বুদ্ধি পরীক্ষা করছ? আমি কেন বোকা ফেরেশতাদের মতন, তোমাকে বাদ দিয়ে অন্যকে সিজদা করতে যাব? ইবলিশ বলেছিল - আমি আগুনের তৈরি আর আদম মাটির তৈরি। আমি আদমের চেয়ে শ্রেস্ট, তাকে সিজদা করব না। অর্থাৎ, সে আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে সিজদা করেনি, এই কথাটি ভুল। সঠিক কথাটি হবে - সে অত্ম অহঙ্কারের জন্য আদমকে সিজদা না করে আল্লাহর অবাধ্য হয়েছে। 

উত্তর ২ঃ মানুষের জন্ম মৃত্য সবই আল্লাহর হাতে। সেই জটিল প্রকৃয়াটা কেমন আর কিভাবে হয় সেটা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা যেমন পাঁচ বছরের শিশুকে বুঝ দিয়ে রাখি, বাচ্চা হাসঁপাতালে কিনতে পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি আল্লাহ আমাদেরকে বুঝ দিয়ে রেখেছেন যে যৌনতা থেকে বাচ্চার জন্ম হয়। একবার চিন্তা করেন, আপনার মতন একজন পুর্নাঙ্গ মানুষ কয়েক ফোটা পানি থেকে কিভাবে হয়?  এর আসল প্রকৃয়া একমাত্র আল্লাহ জানেন। যৌনতা না থাকলে আল্লাহ অন্যভাবে মানুষের জন্ম দেখাতেন। কাজেই আদম ও হাওয়াকে গন্ধম খাইয়ে যৌনতা শিখিয়ে ইবলিশ মানব প্রজাতি রক্ষা করেছে - এটা ভুল কথা।  

উত্তর ৩ঃ ভালো-মন্দ সবই আল্লাহর সৃস্টি। শয়তান কেন, কারোরই কোন কিছু সৃস্ট করার ক্ষমতা নেই। আল্লাহ ভালো মন্দ দুটিই সৃস্ট করে আমাদেরকে, নিজের ইচ্ছায় বেছে নেবার ক্ষমতা দিয়েছেন। আমরা যেটা বেছে নেব, তার দোষ বা গুন আমাদের, যদিও সবই আল্লাহর সৃস্টি। শয়তানের দোষ হল, সে জেনে বুঝেই আমাদেরকে মন্দ কাজ করতে উতসাহিত করে। শয়তান মোটেই আল্লহর সমকক্ষ নয়। সে আমাদেরকে আল্লাহর আদেশ অমান্য করার বুদ্ধি ও যুক্তি দেয় মাত্র।                 
প্রশ্নের উত্তর শেষ। তার পরেও বিষয়টা পরিস্কার করতে কিছু কথা জানা প্রয়োজন। সেটা হল- আল্লাহর মর্যাদা। তিনি কত মর্যাদার অধিকারী সেটা বোঝার ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে তিনি কিসের মালিক সেটা জানলে কিছুটা ধারনা হবে। একটি বিল্ডিং এর গ্যারেজে বসে বিল্ডিংটি কেমন দেখতে সেটা দেখা যায় না। দেখতে হলে কয়েক পা হেটে, উপরে তাকিয়ে দেখতে হয়। ঠিক তেমনি। এই মহাবিশ্ব কেমন দেখতে সেটা দেখতে হলে আমাদেরকে যে স্থানে গিয়ে দাড়াতে হবে সেটার দুরত্ব ১০ হাজার কোটি  আলোক বর্ষ।  অর্থাত, প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার যেতে পারলে ওখানে গিয়ে দাড়াতে ১০ হাজাত কোটি বছর লাগবে। এই মহাশুন্য প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে। এই মহাশ্যন্য সহ, বেহেশত, দোযখ, অগনিত ফেরেশতা ও উর্ধ জগতে যা কিছু আছে সবকিছুর মালিক আল্লাহ। সামান্য একটি দেশের রাজার কত মর্যাদা আমারা দেই। তাহলে আল্লাহর কত মর্যাদা? আল্লাহর সৃস্টির বাইরে কোন কিছু নেই। বিজ্ঞানের কোন সৃস্টি (creation) নেই, আছে আবিস্কার (Discovery, Invention)। রেশম পোকার গুটি গাছে ঝুলে থাকে, এট হল সৃস্ট। সেই গুটি দিয়ে সুতা ও কাপড় বানানোটা হল আবিস্কার। বিজ্ঞান আল্লাহর সৃস্টিকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জন্য ব্যাবহার করার মতন নতুন জিনিস বানায়, কোন কিছু সৃস্টি করতে পারে না। এছাড়াও জন্ম, মৃত্যু, খাদ্য, খনিজ সম্পদ, সময়, ভালোবাসা, ঘ্নৃনা, ভালো, মন্দ - সবই আল্লাহর সৃস্টি।  হ্যা, মন্দ জিনিসটাও আল্লাহর সৃস্টি। যেখানে সৃস্টি সেখানেই আল্লাহ। তিনি একমাত্র সৃস্টিকর্তা। 

এমন ক্ষমতাবান ও মর্যাদাপুর্ন আল্লাহ এমন কিছু করেন না যে তাকে কেউ দোষারোপ করতে পারে। কারন কেউ যদি তার দোষ বের করে দেখাতে পারে, তাহলে তিনি কেমন সর্বশক্তিমান? আল্লাহ মানুষকে সৃস্ট করেছেন (শুধুমাত্র) তার ইবাদত করানোর জন্য। ভালো-মন্দ ইত্যাদি না বানিয়ে, মানুষকে ইবাদত করা শিখিয়ে, চাবি দেওয়া পুতুলের মতন বেহেশতে ছেড়ে দিতে পারতেন। মন্দ বলে কিছুই থাকতো না, সবাই আল্লাহর নাম জপ করে বেহেশতে খুশি থাকতো। কেউই আল্লাহকে অস্বীকার করত না। কিন্তু, এমন করলে তিনি সর্বশক্তিমান কোথায় থাকলেন? ওভাবে, পুতুলকে চাবি দিয়ে ছেড়ে দিতে তো আমরাই পারি। আল্লাহর ক্ষমতা হল সেখানেই - তিনি কাউকে জোর করবেন না, তবুও তিনি যা চেয়েছেন সেটাই হবে। আল্লাহ চান, মানুষের মন্দ করার ক্ষমতা থাকা স্বত্বেও ভালো কাজ করবে। তিনি চান সবা মানুষ বেহেশতে গিয়ে মিলে মিশে থাকবে। সর্বপোরি, আল্লাহর অবাধ্য হবার ক্ষমতা থাকলেও মানুষ আল্লাহর ইবাদত করবে, কারন মানুষকে সেই জন্য বানানো হয়েছে। 

এখন আপনি চিন্তা করুন,  দুনিয়ার সব মানুষকে এখন বেহেশতে ঢোকালে সাত দিনের মধ্যেই সেটাকে নস্ট করে ফেলবে। একে অন্যের আয়গা দখল করবে, অন্যের হুর ধর্ষন করবে, মারামারি কাটাকাটি করবে। কারা এমন করবে, আর কারা করবে না, এটা আল্লাহ জানেন। কাজেই তিনি বাছাই করা লোক বেহেশতে ঢোকাতে পারেন। কিন্তু সেখানেও আছে সমস্যা। বাছাই পর্বে বাদ পড়া লোকগুলো তখন আল্লাহকে দোষারোপ করবে - আমাকে ঢুকতেই দিলে না, আমি তো ভালো হয়ে চলতাম। আগেই বলেছি, আল্লাহকে দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কাজেই আমাদেরকে একটি পরীক্ষার সম্মুখিন করা হয়েছে। সেই পরীক্ষাটা হল দুনিয়ার জীবন। এই জীবনে আমরা কেমন হয়ে চলব, সেটা দেখেই বোঝা যাবে আপনি বেহেশতে কেমন হয়ে চলবেন। আল্লাহ সবই জানেন, এই পরীক্ষাটা তার জন্য নয়, পরীক্ষাটা আপনাকে দেখানোর জন্য। যাতে আপনাকে যদি বেহেশতে ঢুকতে না দেওয়া হয় তাহলে যেন আল্লাহকে দোষারোপ না করতে পারেন। এটা একটা পরীক্ষা, আর সেই কারনেই এত গোপনীয়তা। আল্লাহ নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন এবং মানুষকে বলছেন - না দেখে তাকে বিশ্বাস করতে ও তার আদেশ পালন করতে। ভালো-মন্দ আল্লহর সৃস্টি। এ দুটো করা ক্ষমতাই আমাদেরকে আল্লহ দিয়েছেন্। পরীক্ষাটা আরো কঠিন করার জন্য শয়তানের ব্যাবস্থা আছে, যে আমাদেরকে সর্বদাই মন্দ কাজে উতসাহ দেয়। এই কাজটা করার সুযোগ করে দিতেই শয়তানকে দির্ঘায়ু ও রোগশোক মুক্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু কেয়ামতের পরে শয়তানের খবর আছে, সেটা সে নিজেও জানে।      

দুনিয়ার এই পরীক্ষাটা যে হবে, শয়তান যে পথভ্রস্ট হবে, আদম হাওয়া যে গন্ধম খাবে, তাদেরকে দুনিয়েতে পাঠানো হবে, দুনিয়াতে মানুষ কি করবে, কেয়ামতের পরে মানুষ কতজন বেহেশতে যাবে, সবই আল্লহ অনেক আগে থেকেই জানেন। এগুলোর কোনটা করার জন্য কাউকেই তিনি জোর করেননি। সবাই নিজের ইচ্ছায় সেগুলো করছে। এখানে আল্লাহকে দোষারোপ করার কোন সুযোগ নেই। কারন আমাদের কর্ম দোষেই আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হই। ক্ষমতা থাকা 
সত্বেও সঠিক কর্মটা না করতে পারাটা আমাদের ব্যার্থতা, আমাদের দোষ। আসলে, আল্লাহকে দোষারোপ করার বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধি ও যুক্তিদাতা কিন্তু শয়তান নিজেই। আল্লাহ আমাদেরকে শয়তানের কু-মন্ত্রনা থেকে রক্ষা করুন।                


    

Comments

  1. চমৎকার লিখেছেন,দোয়া রইলো... ভাই !

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

      Delete

Post a Comment