স্বামী ও স্ত্রীর রোজগারে পারস্পরিক অধিকার


আধুনিক এই যুগের মেয়েরা পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে সবকিছুই করছে। মেয়েরা পুরুষের চেয়ে এখন তুলনামুলকভাবে বেশী আয় রোজগার করে; কারন সমান শিক্ষাগত যোগ্যতার একটি মেয়ে একটি ছেলের চেয়ে ভালো চাকরী পায়। এখন প্রশ্ন উঠেছে - স্বামী ও স্ত্রী দুজনেই চাকরী করে। স্ত্রী বরং বেশী আয় করে। এখন সংসারের খরচ কি স্বামী সারা জীবন একলাই চালাবে? যখন এই প্রশ্নের উত্তর ইসলাম নিয়ে লেখাপড়া করেছে এমন কারো কাছে জানতে চাওয়া হয় তখন তিনি ইসলাম সম্মত উত্তরই দেন। উত্তরটি হল, স্ত্রীর ও সন্তানদের খরচ চালনো স্বামীর দায়িত্ব, স্ত্রীর নয়। এটা স্বামীকেই করতে হবে। এই উত্তর শুনে পুরুষদের হিসাব মেলাতে কস্ট হয়। সেই হিসাবটা মেলানোর চেস্টা করব আজ।


আগে বলেছি, আমি ইসলামের নই, বিজ্ঞানের ছাত্র। যেটা কিছুটা বুঝি, সেটা দিয়েই শুরু করি। সফটওয়ার যারা তৈরি করে, তাদের জগতে Redundancy বলে একটা কথা আছে। এর হবহু বাংলা অর্থ আমার জানা নেই। কাছাকাছি শন্দটি হল – বাড়তি। ধরুন, যাত্রীদের ট্রেনের টিকিট দেবার জন্য একটি সফটওয়ার বানানো হচ্ছে। এর মধ্যে যদি যাত্রীদের “জুতার সাইজ” লেখার অপশন থাকে তাহলে সেটা হবে বাড়তি। কারন ট্রেনের যাত্রীদের “জুতার সাইজ” জিনিসটি টিকিটের জন্য কোন কাজেই লাগে না। মানুষের বানানো জিনিসের মধ্যে, ভুলবশত এমন অপ্রয়োজনীয় বাড়তি জিনিস থাকে। ইসলাম হল আল্লাহর বানানো জীবন বিধান। এতে কোন অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কিছু নেই। কোন অবিচার নেই। আমাদের কাছে খটকা লাগে, কারন আমরা বুঝতে ভুল করি। 

বিয়ে ও স্বামী স্ত্রীর আর্থিক অধিকার বিষয়ে আসার আগে বহুল প্রচলিত একটি ধারনা নিয়ে কিছু বলে নেই। অভিযোগ আছে, মেয়েরা ধনী ছেলেদের পছন্দ করে, টাকার উপরে তাদের রয়েছে প্রচন্ড লোভ। এটা আসলে ভুল ধারনা। টাকার প্রতি আকর্ষন বা প্রয়োজন পুরুষর অনেক বেশী। মেয়েদের যে জিনিসটার প্রতি আকর্ষন সেটা হল গর্ব ও প্রতিযোগীতা। তারা অন্য নারীদের সাথে সকল বিষয়ে প্রতিযোগীতা করে। কার জামাটা ভালো, কার গয়নাটা ভালো ইত্যাদি। ঠিক তেমনি তারা স্বামী নিয়েও প্রতিযোগীতা করে। মেয়েরা চায় স্বামীকে নিয়ে গর্ব করতে। প্রাচীনকালে মানুষ কুস্তিগীর, যোদ্ধা ইত্যাদি নিয়ে গর্ব করত। কাজেই সেই সময় মেয়েরা কুস্তিগীর স্বামী পছন্দ করত। মধ্যযুগে মানুষ জ্ঞানী-গুনি নিয়ে গর্ব করত। তাই সেই সময় মেয়েরা জ্ঞানী স্বামী পছন্দ করত। এখন হল টাকা আর ক্ষমতার যুগ। তাই মেয়েরা ক্ষমতাবান ও ধনী স্বামী পছন্দ করে। তাদের লোভ টাকার উপরে নয়, লোভটা হল প্রতিযোগীতার উপরে। ওদিকে পুরুষ হল শিকারি জাতি। মানুষ যখন গুহায় বাস করত তখন নারীরা গৃহস্তালীর কাজ করত আর পুরুষেরা করত শিকার। একটা বন্য প্রানী শিকার করে, সেটাকে ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিয়ে এসে পুরুষ মানুষ যেমন আনন্দ পেতো,  এখন তেমন আনন্দ পায় ব্যাগ ভরে টাকা আনতে পারলে। টাকার লোভ ও প্রয়োজনীয়তা দুটোই পুরুষের বেশী। যাই হোক, নারী-পুরুষের এই স্বভাবের কথাটি কেন বললাম সেই বিষয়ে পরে আসছি।

অন্যান্য অনেক ধর্মে বিয়ে জিনিসটা একটা সামাজিকতা একটা রীতি। কিন্তু ইসলামে, বিয়ে জিনিসটা একটা চুক্তি (Contract)। স্বামী ও স্ত্রী দুজনে একসাথে থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এই চুক্তির বিভিন্ন শর্ত ও নিয়মাবলী (Terms & Condition) আছে। কার কতখানি অধিকার, কে কি পাবে, মৃত্যুর পরে সম্পত্তি কিভাবে ভাগ হবে ইত্যাদি সকল বিষয়ে বিস্তারিত নিয়মাবলী আছে, ইসলামে। সেটা আজকের আলোচনার বিষয় নয়। আজকের বিষয় হল স্বামী ও স্ত্রীর আর্থিক অধিকার। এ বিষয়ের সারমর্ম হল – স্ত্রী যতই ধনী হোক না কেন, তার ও সন্তানের ব্যয় বহন করা স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রী যদি চায় তাহলে সে স্বামীকে টাকা পয়সা দিতে পারে। কিন্তু স্ত্রীর টাকার উপরে স্বামির অধিকার নেই। 

আমাদের ভুল বোঝা সবই ওই এক লাইনের ভেতরে। আসুন জটগুলো ছাড়াই।  স্ত্রী ও সন্তানদের খরচ চালানো স্বামীর দায়িত্ব। এর অর্থ হল, তাদের নুন্যতম প্রয়োজন মেটানো। নুন্যতম প্রয়োজন হল, পেটে খাবার থাকবে, মাথার উপরে ছাদ থাকবে, পরনে কাপড় থাকবে। আরো খুলে বলি। স্বামীর দায়িত্ব হল স্ত্রীকে নিরাপদে রাখা, চারটে ডালভাত খাওয়ানো আর দুইটা মোটা কাপড় কিনে দেওয়া। জ্বী, “নুন্যতম চাহিদা” কথাটার মানে এটাই দাড়ায়। এবার আশেপাশের মানুষের দিকে তাকান, সবাই এর চেয়ে শতগুন ভাল আছে। অর্থাৎ, স্বামীরা তাদের আর্থিক দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করছেন না, এমন অভিযোগ আনার কোন সুযোগ নেই। 

আধুনিক যুগে তো আর মোটা ভাত কাপড়ে চলে না। এখন অনেক বাড়তি খরচ আছে। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া, স্ত্রীর শপিং, বিশেষ দিনে সবাই মিলে বাইরে খাওয়া, দেশে বিদেশে ঘুরতে যাওয়া, অমুকের বিয়ে বা জন্মদিনে দামী উপহার, এছাড়া নিজের সংসারের খরচ তো আছেই। লক্ষ্য করুন, এর সবই কিন্তু বাড়তি। আমরা এমন এক সমাজ ব্যাবস্থার ভেতরে বন্দী হয়ে আছি যে মানুষের সাথে প্রতিযোগীতা করতে আমাদেরকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে পয়সা রোজগার করতে হচ্ছে। গিন্নি বললেন, খোকার বন্ধুদের সবার ৩টি গৃহশিক্ষক, আমাদের খোকার ১টি শিক্ষকে কি কাজ হবে? ব্যাস, বাড়াও খরচ, শুরু কর প্রতিযোগীতা। গিন্নি বললেন আমার বান্ধবী অমুক দামী গয়না কিনেছে, অমুক দামী ফোন কিনেছে,  ব্যাস, বাড়াও খরচ, শুরু কর প্রতিযোগীতা। অনুক তার পরিবার নিয়ে ফাইভ স্টারে খেতে যায়, ব্যাস, বাড়াও খরচ, শুরু কর প্রতিযোগীতা। এভাবে কিন্তু প্রতিযোগীতার প্যাচে পড়েই সংসারের খরচ বাড়ে। এসব বাড়তি খরচ চালোনোর জন্য স্বামী বাধ্য নন। এমনকি এসব খরচ করাটাই তো যায়েজ নয়।   

দ্রব্যমুল্যের উর্ধগতিতে এখন বাড়তি খরচ ছাড়াই সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হয়। তাছাড়া এখন ওই দুইটা কাপড়ে চলে না। ঠিক আছে, দুইটার যায়গায় পাচটা হোক, দশটা হোক, সেটাও তো একটা সীমার মধ্যে থাকে। এখনকার যুগের মেয়েদের তো দশটার বেশী স্যন্ডেলই থাকে। অন্য জিনিসের কথা বাদই দিলাম। এমনভাবে স্ত্রী নিজের জন্য বাড়তি জিনিস কিনবেন আর সেটাকে স্বামীর উপরে অধিকার বলে চালিয়ে দিবেন – এটা মোটেও ইসলামিক নয়। স্বামীর যদি সামর্থ থাকে তাহলে দশটা কেন, একশটা কিনে দিতে পারে। তবে সেটা, উপহার – অধিকার নয়। একই নিয়ম, সংসারের অন্যান্য খরচের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। অর্থাৎ, নুন্যতম দেওয়াটা অধিকার, বাড়তি কিছু দেওয়াটা উপহার।   

এতক্ষন কথা বলেছি সেই নারীদের ব্যাপারে যারা নিজেরা রোজগার করেন না, অথবা তার কোন সম্পদ নেই। এখন আসছি আয় করা নারী প্রসঙ্গে। এ ব্যাপারেও উপরের আলচ্য বাক্যটির মধ্যে উত্তর আছে। নুন্যতম খরচ চালালেই স্বামীর দায়িত্ব শেষ। কিন্তু এমন আয় করা মহিলা কি নুন্যতম খরচে চলতে পারবে? তার তো অনেক খরচ আছে। আর সেই খরচ মেটাতে স্বামী বাধ্য নন। এটা স্ত্রীর অধিকার নয়। স্ত্রী নিজে আয় করেন, নিজেই নিজের টাকা খরচ করে নিজের মতন ভালভাবে চলতে পারেন। প্রয়োজনে তার ইচ্ছা অনুযায়ী স্বামীকে টাকা দিতে পারেন যাতে আরেকটু ভালোভাবে থাকা যায়। স্ত্রী যদি সেটা করতে না চান, খুব ভালো কথা। তার নিজের আয় করা টাকা নিজের ইচ্ছায় ব্যয় করার অধিকার তার আছে। তবে সেক্ষেত্রে স্বামীর সামর্থ অনুযায়ী, স্বল্প খরচেই জীবন জাপন করতে হবে। কারন সংসারের নুন্যতম প্রয়োজন মিটিয়ে, নিজের টাকা ইচ্ছে মতন খরচ করাটাও স্বামীর অধিকার। স্ত্রী নিজের টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দিবে, আর স্বামী তার সব টাকা সংসারে ঢেলে দিবে – স্বামী স্ত্রীর  আর্থিক অধিকারটা এমন নয়। আরেকটা কথা অনেকেই জানেন, কয়েকজন সাহাবী তাদের ধনী স্ত্রীদের কাছ থেকে যাকাত পেতেন। (ক্ষেত্র বিশেষে) 

স্বামী ও স্ত্রীর আর্থিক অধিকারের পার্থক্য হল – স্ত্রীর টাকাতে স্বামীর কোন অধিকার নেই। ওদিকে স্বামীর ওই পরিমান টাকার উপরে স্ত্রীর অধিকার আছে যা দিয়ে নুন্যতম খরচ চলে, বাকি টাকার উপরে স্ত্রীর কোন অধিকার নেই। স্ত্রী ও পরিবারের নুন্যতম খরচ চালানো স্বামীর কর্তব্য। স্ত্রীকে সেই স্বল্প খরচেই চলতে হবে। যদি স্বামীর সামর্থ থাকে  তাহলে স্বামীর ইচ্ছে করলে বাড়তি খরচ স্ত্রীকে দিতে পারেন, আবার নাও পারেন। এটা স্ত্রীর কোন অধিকার নয়। ওদিকে স্ত্রীর আয় কিংবা সম্পদ চাইলে স্বামীকে দিতে পারেন, নাও দিতে পারেন, স্বামীর কোন অধিকার নেই। এখানে আরেকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। সেটা হল স্ত্রীর কর্তব্য ও স্বামীর চেস্টা। স্ত্রী যেন আয় করতে গিয়ে সংসারের দায়িত্বে অবহেলা না করে। আর সংসারে খরচ চালোনো চেস্টায় স্বামীর যেন কোন ত্রুটি না থাকে। 

আমাদের সমাজে আমরা ওই প্রতিযোগীতা করতে গিয়েই লাগাম ছাড়া হয়ে যাই। আমরা যদি ইসলামিক জীবন জাপন করি তাহলে আমাদের বাড়তি কিছুই লাগবে না। তাছাড়া স্বামীর কাছ থেকে টাকার অধিকার পাওয়ার জন্য নারীরা যেমন ইসলাম অনুসরন করেন, ঘর-সংসারে চালাতে গিয়ে যদি ঠিক তেমনভাবে ইসলামের অনুসরন করেন তাহলে প্রতিটি ঘর হবে দুনিয়ার মাঝে জান্নাতের ছোয়া। লোক দেখানো প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে আমরা যেন সবাই ইসলামের পথে আসতে পারি। আল্লাহ আমাদেরকে বোঝার ক্ষমতা দিন।     

Comments