নিয়তের গুরুত্ব ও এর ভয়াবহতা


নিয়ত কথাটির অর্থ হল উদ্দেশ্য (intention)। ইসলামে যে কোন আমলের (action) জন্য নিয়ত খুবই গুরুত্বপুর্ন। কোন কাজটি কেন করলাম, কি উদ্দেশ্যে করলাম, এটাই নিয়ত। আমাদের উপমহাদেশে নামাজ রোজা ইত্যাদির নিয়ত মুখস্থ করার এক ভুল পদ্ধতি চালু আছে। নিয়ত মুখে বলা তো দুরের কথা, মনে মনে বলারও দরকার নেই। আমি কি করছি, কেন করছি, এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই নিয়ত। 

আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনের প্রত্যেক কাজেরই নিয়ত হয়। আপনি তিন তলায় থাকেন, সিড়ি বেয়ে নিচে নামছেন। আপনি কেন নামছেন, কি করতে নামছেন, সেটাই আপনার নিয়ত। একজন মানুষের জীবনটাই একটা পরীক্ষা। এর প্রতিটি কাজ আমরা কেন করি, কি উদ্দেশ্যে করি, আমাদের পাপ পুন্য তার উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। এই কুরবানীর ঈদের কথাই ধরুন, আপনি কি মানুষকে দেখানোর জন্য গরু কিনছেন, অনেক মাংশ খাওয়ার জন্য গরু কিনছেন এটাই আপনার নিয়ত। এই নিয়তটা হয় অন্তরে। আপনি (আর আল্লাহ) ছাড়া কেউ জানে না, আপনার নিয়তটা কি। আর এই নিয়তের উপরেই নির্ভর করে আপনার আমলের গ্রহনযোগ্যতা। আমাদের অতি কস্টের আমল এক মুহুর্তেই অকেজো হয়ে যেতে পারে, শুধু ভুল নিয়তের জন্য। 

নিয়তের আরেকটি গুরুত্বপর্ন দিক হল, এটি কোন এক আমলের পরিচয় বহন করে। বিষয়টা কিছুটা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের ক্রমিক নম্বরের মতন। ৭ নং প্রশ্নের উত্তর যত ভালো করে লিখুন না কেন, সেখানে যদি প্রশ্নের ক্রমিক নম্বর ৫ লিখে রাখেন, তাহলে শুন্য পাবেন । কারন আপনার ওই উত্তরটি ৭ নম্বর এর জন্য সঠিক হলেও ৫ নম্বরের জন্য ভূল। আবার উত্তর লেখার সময় কোন ক্রমিক নম্বর না দিলেও শুন্য পেতে হবে। ঠিক তেমনি কোন আমলের ভুল নিয়ত থাকলে ফলাফল শুন্য। রাত ৮ টার সময়, জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলেন। কোন ওয়াক্তের নামাজ পড়ছেন, সুন্নত না নফল, কিছুই জানেন না। মনে মনে ভাবলেন, যে নামাজই হোক, একটা কিছু তো হবে। না, কিছুই হবে না। ফলাফল শুন্য। 

দুই বন্ধু যাচ্ছে দেশের বিখ্যাত এক পীরের মাজারে। একজন, মনে মনে ভাবছে, ওখানে গেলে তার পাপ ধুয়ে ছাফ হয়ে যাবে। আরেকজন ভাবছে, যাক একটা ঐতিহাসিক স্থান দেখা হবে। ওখানে গিয়ে দুজনেই একই কাজ করেছে। কেউই দোয়া করেনি, কবরে সিজদা করেনি। কেউই কোন রকমের কার্জকলাপ করেনি। ওখানে ঘুরে দেখেছে, দুই বন্ধু খুব পোজ দিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করেছে। দুই বন্ধু একই কাজ করলেও, দ্বিতীয় বন্ধুটি সামান্য পাপ করেছে, আর প্রথম বন্ধুটি একেবারে শিরক করে ফেলেছে। শিরক ইসলামে সবচেয়ে বড় পাপ, এটা মানুষকে ইসলাম থেকে বহিস্কার করে দেয়। এর পরিনতি চীরস্থায়ী জাহান্নাম। একই কাজ করেও দুই বন্ধুর দুই রকমের পরিনতির কারন হল - দুজনের মনের দুই রকমের ইচ্ছা, দুই রকমের নিয়ত। 

এতক্ষন নিয়তের গুরুত্ব বলেছি, এবার ভয়াবহতা বলছি। শেষ বিচারের দিনে, আল্লাহ তিনজন ব্যাক্তিকে হাজির করবেন। একজন আলেম, একজন দানশীল ও একজন শহিদ। আলেমকে জিজ্ঞাস করবেন, তিমি দুনিয়াতে কি করেছ? সে উত্তর দিবে, আল্লাহ, আমি মানুষকে ইসলামী জ্ঞান শিখিয়েছি। কেন শিখিয়েছ? উত্তর দিবে, আল্লাহ, আমি তোমার সন্তস্টির জন্য শিখিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তিমি মিথ্যা বলছ। সেই সাথে ফেরেশতারা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। কারন ফেরেশতারা জানে, আল্লাহর কথা সর্বদাই সঠিক। আল্লাহ বলবেন, তুমি এজন্য জ্ঞান দান করেছ যেন মানুষ তোমাকে বলে, লোকটি কত বড় জ্ঞানী, তোমাকে সন্মান করে, তোমাকে এটা ওটা উপহার দেয়, এগুলি সবই তুমি পেয়েছ।

এর পরে আল্লাহ দানশীলকে হাজির করবেন। তাকে জিজ্ঞেস করবেন, সে কেন দান করেছিল। সে আল্লাহকে বলবে, আমি তোমার সন্তস্টির জন্য দান করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি এই কারনে দান করেছো যেন মানুষ তোমাকে দানশীল বলে, তোমাকে যেন মনে রাখে, তুমি যেন বিখ্যাত হতে পারো। এর পরে ডাকবেন শহিদকে। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন তুমি কেন জীবন দিয়েছো? সে বলবে, আল্লাহ আমি তোমার সন্তস্টির জন্য জীবন দিয়েছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি জীবন দিয়েছিলে, কারন লোকে যেন তোমাকে বীর বলে, ওরা যেন তোমার মুর্তি বানিয়ে রাখে।

তিন ব্যাক্তির এই ঘটনাটা বলছিলেন স্বয়ং রাসুল (সাঃ)। এটুকু বলার পরে তিনি সামনে বসা সাহাবী মুহাজ (রা) এর ঘাড়ে হাত দিয়ে ঝাকি দিলেন, যাতে সাহাবী তার দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কথাটা শোনে। কারন তিনি এখন যেটা বলবেন, সেটা অত্যান্ত গুরুত্বপুর্ন। তিনি বললেন, হে মুহাজ, এরাই হচ্ছে প্রথম তিন ব্যাক্তি যাদেরকে আল্লাহ জাহান্নামে প্রজ্জ্বলিত করবেন (মুসলিম ১৩/৪৫/১৯০৫) - আবু হুরায়রা থেকে বর্নীত।

বিষয়টা কতখানি ভায়াবহ সেটা আন্দাজ করা দুঃস্কর। একজন আলেম, হতে পারে যিনি কয়েকজনকে মুসলিম বানিয়েছেন, হতে পারে তার কথা শুনে হাজারো লোক ইসলামের পথে এসেছে, হতে পারে হাজারো লোক নিজেকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করতে পেরেছে সেই আলেমের দেওয়া জ্ঞানের কারনে। একজন দানশীল, হতে পারে তার দানে বানানো হাসপাতালে প্রতিবছর শতলোক আরোগ্য হচ্ছে, হতে পারে তার দানের টাকায় বানান মসজিদে ইবাদত করে শত লোক নিজেকে দোজোখ থেকে রক্ষা করেছে। একজন শহিদ, যিনি তার জীবন উতসর্গ করেছেন, আর তার এই জীবন উতসর্গে হয়ত শত মানুষের কল্যান হয়েছে। এতকিছুর পরেও, এরাই প্রথম জাহান্নামী। এর কারন, তাদের অন্তরে (আল্লহ ব্যাতীত) অন্য কোন ইচ্ছা, আকাংখা বা উদ্দেশ্য (নিয়ত) ছিল।

এখানে জিজ্ঞাসা থাকে, একজন মানুষ তার জ্ঞান দিয়ে, অর্থ দিয়ে, জীবন দিয়ে, হাজারো লোকের উপকার করছে, সেই লোকটি কিভাবে আল্লাহর সন্তস্টি কামনা করবে। হ্যা, এখানে তার উদ্দেশ্য (নিয়ত) থাকতে হবে মানুষের উপকার করা (লোক দেখানো বা মানুষের বাহবা পাওয়া নয়)। আর মানুষের এই উপকার করার মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তস্টি কামনা করতে হবে। মানুষের নিঃস্বার্থ উপকার করলে আল্লাহ সন্তস্ট হবেন। 

দ্রস্টব্যঃ এই লেখাটি লিখবার সময় (শয়তানের ধোকায়) আমারও মনে হয়েছে, লেখাটি পড়ে অনেকে আমাকে বাহবা দিবে, অনেকে বলবে, কত সুন্দর একটি বিষয় লিখেছে। এটাই ভুল নিয়ত। এটাই দোযখে যাবার রাস্তা। আমার সঠিক নিয়ত হল, এই লেখাটি পড়ে মানুষ নিয়তের গুরুত্ব জানবে এবং সেই অনুযায়ী আমল করে উপকৃত হবে। আর এর মাধ্যমেই আসবে আল্লাহর সন্তস্টি। এর মাধ্যমেই আসবে আল্লাহর রহমত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়র ও সেই অনুযায়ী আমল করার ক্ষমতা দান করুন। আল্লাহ আমাদেরকে দোযখের আগুন থেকে দক্ষা করুন।  

Comments

  1. আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক নিয়ত ও সেই অনুযায়ী আমল করে আল্লাহর সন্তস্টির উপর থাকার ক্ষমতা দান করুন। আল্লাহ আমাদেরকে দোযখের আগুন থেকে দক্ষা করুন।
    জাযাকাল্লাহ খায়ের। আল্লাহ আপনার জ্ঞানে বরকত দান করুন, আমীন।

    ReplyDelete

Post a Comment