ইংরেজী কেন শিখতে পারি না

কোন একটা ভাষা (কোর্স করে) শিখতে ৬ মাস থেকে ২ বছর লাগার কথা সেখানে আমরা সারা জীবনেও ইংরেজী শিখতে পারি না। কেন পারি না, আজ এ বিষয়ে লিখার চেস্টা করব। ভুল শোধরাবার প্রথম পদক্ষেপ ভুলগুলি জানা। আমার মতন নগন্য লোক তো ভুল শোধরাতে পারবে না। যদি কেন একদিন এসব ভুল শুধরে যায় এই আশায় সামর্থ অনুযায়ী ভুলগুলি তুলে ধরি।

প্রথমে চিন্তা করে দেখুন আপনি ভাষা শিখেছিলেন কিভাবে। চোখের সামনে দেখুন একটি শিশু ভাষা শেখে কিভাবে। প্রথম ৬ থেকে ১২ মাস একটি শিশু শুধু শোনে। লক্ষ্য করে দেখবেন ৮-৯ মাস বয়সের অনেক শিশু রয়েছে যারা সব কথা বোঝে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। এরপরে আস্তে আস্তে বলা শুরু করে। বলার সময় প্রথমে ভুল উচ্চারন করে। চেয়ারকে চেলাল বলে, বিছানাকে বিনানা, গ্লাসকে গালিস ইত্যাদি বলে। এর পরে ধীরে ধীরে বাক্য বলা শুরু করে। এই সময়ে ব্যাকারনে ভুল করে। যেমন "আমি ভাত খাও" "তুমি খুমাই" "মা, কোলে দাও" ইত্যাদি। আমরা এসব ভুল শুনে আনন্দিত হই, শিশুটিকে উতসাহিত করি এবং এক সময় সে তার ভুলগুলি শোধরাতে পারে। কয়েক বছর পরে যখন আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে শিশুটি ভালোভাবে কথা বলতে পারে তখন আমরা তাকে অক্ষর জ্ঞান দেই। শেখাই অ,আ,ক,খ । এর পরে আমরা তাকে লিখতে শেখাই।

এটিই আসলে ভাষা শেখার একমাত্র পদ্ধতি। পদ্ধতিটি চার অংশে বিভক্ত।

১। শুনে বোঝা (listening)
২। বলা (speaking)
৩। পড়ে বোঝা (reading)
৪। লেখা (writing)

এখানে কিন্তু ধারাবাহিকতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। বলতে পারে না এমন শিশুকে আপনি কি লেখা শেখানোর চেস্টা করবেন? শুনে বোঝে না এমন শিশুকে আপনি কি পড়া শেখানোর চেস্টা করবেন? কেউ এই চেস্টা করলে আপনি তাকে পাগল বলবেন। অথচ দেখুন; আমরা ৪-৫ বছরের একটি শিশু যে ইংরেজী শুনে বোঝে না, বলতে পারে না তাকে ইংরেজী লিখতে ও পড়তে শেখাচ্ছি। আমাদের ইংরেজী শেখার পদ্ধতি হল, অ আ ক খ ইত্যাদি জানে এমন একটি শিশুকে তার হাতে পেন্সিল ধরিয়ে দিয়ে লেখা শেখাই - a b c d । লেখা শেখার পরে বানান করে ইংরেজী পড়া শেখাচ্ছি। এর পরে কেউ কেউ হয়ত বলতে শেখে কেউ শেখে না। কিন্তু কেউই প্রচলিত ব্যাবস্থাতে ইংরেজী "শুনে বোঝা" শেখার সুযোগ পায় না। ইংরেজী "শুনে বোঝা" শেখার ব্যাবস্থাই আমাদের নেই। এর মানে আমরা শিখছি প্রথমে "লেখা" তারপরে "পড়া" এরপরে কিছুটা "বলা" আর "শোনা" কখনোই নয়। আমাদের পদ্ধতি সম্পুর্ন উলটো। এছাড়াও যেটা প্রথমে শেখার দরকার (শুনে বোঝা) সেটা আমরা কখনো শিখি না। আমাদের স্কুল কলেজে ইংরেজী কোর্সগুলো আসলে ইংরেজী ভাষা সম্পর্কে বিভিন্ন জ্ঞানার্জনের কোর্স - ভাষা শেখার কোর্স নয়।

এ তো গেল গোড়ায় গলদের কথা। এর পরে যখন ইংরেজী শিখতে যাই তখন দু-তিনটি বিষয় আমাদের ইংরেজী শেখার আগ্রহ, চেস্টা ও ক্ষমতা ধংশ করে দেয়। এর প্রথমটি হল grammar। কত প্রকার sentence হয়, noun কত প্রকার হয়, ইত্যাদি আরো কত কিছু। এসব শিক্ষা দরকার আছে তার, যে ইংরেজী খুব ভালো জানে এবং ভাষাটা নিয়ে গবেষনা করছে। আপনি যদি ইংরেজী শিখতে চান তবে এই গ্রামার আপনাকে এমন বিভ্রান্ত করবে যে আপনি ভাষাটা শিখতেই পারবেন না। কোন ভাষায় কথা বলতে গেলে গ্রামারের চিন্তার দরকার নেই। আপনি বাংলায় কথা বলার সময় বাংলা গ্রামার চিন্তা করেন না। অনেকে যুক্তি দেয় বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা, ইংরেজী আমরা ওভাবে শিখতে পারব না। এট ভুল যুক্তি। ভাষা শেখার একমাত্র পদ্ধতিই হল প্রথমে, হ্যা, একেবারে প্রথমে শুনে বুঝতে শেখা। এর পরে ভুল বলে বলে সঠিক বলতে শেখা। এর বিকল্প কোন পদ্ধতি নেই। সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, জাপান, ইটালী ইত্যাদি দেশে অনেক অশিক্ষিত বাঙ্গালী কয়েক বছরে ভাষা শিখেছে। তাদের কেউ কোনদিন কোন গ্রামার পড়েছে বলে কি কারো জানা আছে? গ্রামার পড়িয়ে যত পন্ডিত হোক না কেন কোনদিন ইংরেজী (কোন ভাষা) বলতে পারবে না যদি "শুনে বোঝা" না শেখে এবং ভুল বলে বলে "বলা" না শেখে।

আরেকটি জিনিস আমাদেরকে শেখানো হয়। Translation (ইংরেজী অনুবাদ)। পুরো ইংরেজী কোর্সে সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকারক জিনিস এটি। আপনি যখন ইংরেজী বলতে যাবেন তখন আপনিন যদি বাংলায় প্রথমে চিন্তা করেন এর পরে সেটিকে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন তবে কোনদিন ইংরেজী বলতেই পারবেন না। একে তো আপনার সময় লাগবে প্রত্যেক কথার অনুবাদ করতে, আপনাকে খুজতে হবে প্রত্যেক কথার শব্দার্থ। এর পরে সেটার গ্রামার চিন্তা করে অনুবাদ করতে হবে। এভাবে কথা বলতে গেলে আপনি ও আপনি যার সাথে কথা বলছেন দুজনেই ক্লান্ত হয়ে যাবেন। এছাড়া সব কথা এক ভাষা থেকে আর এক ভাষায় রুপান্তর করা যায় না। একই কথা ভিন্ন ভাষায় ভিন্নভাবে বলতে হয়। 

ইংরেজীতে রচনা (essay) ও চিঠি (letter & application) পড়ানো হয়। আমি এখন পর্যন্ত এর কারন বুঝতে পারিনি। আরেক জনের লেখা গরু (the cow) রচনা মুখস্ত করে পরীক্ষার খাতায় লিখে এসে লাভ কি? রচনা জিনিসটা আবিস্কার হয়েছে নিজে নিজে লেখার জন্য। এতে ইংরেজী লেখার চর্চা হয়। আচ্ছা ঠিক আছে, এটা মেনে নিলাম। কিন্তু এটা মেনে নিব কিভাবে যে, চিঠিও আরেকজনের লেখাটা মুখস্ত করতে হবে। অশিক্ষিত লোকেরা আরেকজনকে দিয়ে চিঠি লেখায়। কিন্তু আমরা এমন শিক্ষিত বানাচ্ছি যারা আরেকজনের লেখা চিঠি মুখস্ত করে। বাবার কাছে টাকা চেয়ে পত্র, ছুটি চেয়ে পত্র, বন্ধুর বোনের বিয়েতে পত্র এসব নাকি অরেকজন লিখে দিবে আর ছাত্ররা মুখস্ত করবে। অনেকে বলেন, এ ছাড়া আর উপায় কি? ছাত্ররা তো নিজে লিখতে পারে না। হ্যা, এখানেই আমাদের কেরামতি। হোচট না খাইয়েই আমরা হাটা শেখাতে চাই। ছাত্রদেরকে ২-৩ বছর ভুল লেখার সুযোগ দিলে এর পরেই তো তারা সুদ্ধ লেখা শিখবে। আমরা সে সুযোগ দিব না। আমরা তাদেরকে ভুল লিখতেই দিব না। তাই তো আরেকজনের লেখা তাদেরকে মুখস্ত করাব। এর ফলেই এমন শিক্ষিত আমাদের দেশে পাওয়া যায় যে নিজের চিঠি অন্যকে দিয়ে লেখায়।

বাংলা কথায় প্রায় ২০% ইংরেজী শব্দ রয়েছে। অনেক ইংরেজী শন্দের বাংলা অর্থ অনেকেই জানে না। যেমন balloon- ফানুষ, ventilator-ঘুলঘুলি ইত্যাদি। আমাদের আসলে সবার ইংরেজী অন্তত বলতে পারার কথা। কিন্তু আমরা পারি না এর জন্য শিক্ষা ব্যাবস্থার পাশাপাশি আমাদের মানষিকতাও কিছুটা দায়ী। বাংলা ভুল বলে বলে যে শিশুটি কথা বলা শেখে তাকে আমরা উতসাহ দেই। কিন্তু কেউ ভুল ইংরেজী বলুক - দেখবেন হাসাহাসি আর ব্যাঙ্গ কাকে বলে। ভুল না বলে কখনো শুদ্ধ বলা শেখা যায় না। আমরা ব্যাঙ্গের ভয়ে সেই ভুল বলার সাহসই পাই না। তা না হলে ভুল ইংরেজী হলেও আমাদের দেশের সবাই ইংরেজী বলতে পারার কথা।

ভারতের মাদ্রাজে তামিল নামক বিদঘুটে এক ভাষা রয়েছে। ওরা হিন্দি অপছন্দ করে। তাই তাদের সঙ্গে বাইরের সবাই ইংরেজীতে কথা বলে। কাজের বুয়া, রিক্সাওয়ালা, দারোয়ান সবাই (ভুল হলেও) ইংরেজী বলে। কারন এছাড়া আমার মতন বাইরের লোককে বোঝানোর আর কোন উপায় নেই, আর ওদের দেশে ভুল বললে কেউ হাসাহাসিও করে না। যেই হোক অনেক আগে (ছাত্রাবস্থায়) আমি ও আমার বন্ধু একবার মাদ্রাজে এক কলেজের অনুস্টানে গিয়াছিলাম। দারোয়ান আমাকে জিজ্ঞেস করল "College student ?"। আমি বললাম "No" । দারোয়ান বলল "College student bike yes, outside bike no"। অর্থাৎ সে বোঝাতে চাইছে, আমি এই কলেজের ছাত্র না হলে মোটর সাইকেল ভেতরে ঢুকাতে দিবে না। এর পরে অবশ্য সে আমাদের কিছু কাগজ পত্র দেখে আমাদের মোটর বাইক ভেতরে ঢূকতে দিয়েছিল। লক্ষনীয় হচ্ছে - দারোয়ানটি তার অতি সীমিত জ্ঞান দিয়ে আমাকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিয়েছে। এটাই ভাষার উদ্দেশ্য। আপনি কত ভাল ভলতে পারেন সেটা বড় কথা নয়। মুল উদ্দেশ্য হল একজনকে আপনার মনের ভাব বোঝানো। দারোয়ানটি  এব্যাপারে সফল ছিল। এমন ইংরেজী আমাদের দেশে কেউ বললে, তাকে নিয়ে এত হাসাহাসি হবে যে এর পরে সে আর এলাকায় মুখ দেখাতে পারবে না। তার গুস্টিতে কেউ আর কখনো ইংরেজী বলার সাহস করবে না।

আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা তো আছেই - আমাদে সমাজও আমাদেরকে ইংরেজী শিখতে কিছুটা বাধা দিচ্ছে। ভুল বলে চর্চা করতে পারছি না। তাই সঠিক বলতেও পারছি না। এর ফলে আমরা সারা জীবন ইংরেজী পড়েও ইংরেজী শিখতে পারছি না।

পরবর্তীঃ ইংরেজী যেভাবে বলতে পারি 

দ্রস্টব্যঃ ইদানিং পাঠ্যবইয়ে ইংরেজী শেখার পদ্ধতি আধুনিক হয়েছে। এই আধুনিক পদ্ধতি অনুসরন করতে পারলে আমাদের ছাত্ররা ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই আধুনিক পদ্ধতিও আমরা মান্দাতার আমলের পদ্ধতিতে ব্যাবহার করছি। এর জন্য আমাদের আভ্যাস দায়ী। সঠিক পদ্ধতি চেনানোর জন্য শিক্ষকদেরও বিশেষ ট্রেনিং এর দরকার রয়েছে।

Comments

Post a Comment