মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - আর কত সস্তা হবে?


মুক্তিযুদ্ধের চেতনা - এই কথাটি শোনেননি এমন কোন বাংলাদেশী নেই। এই কথাটি সবচেয়ে বেশী প্রচার করেছে রাজনৈতিক দলগুলো এবং মিডিয়া। এই কথা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেলেও, এর অর্থ এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা" কথাটির সংগা স্কুল কলেজের কোন বই পত্রে নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে কি?
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বোঝার আগে দেশপ্রেম বুঝতে হবে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও বোঝানোর জন্য পুরাতন একটি ঘটনা (পুনরায়) সংক্ষেপে বলতে হচ্ছে। কোলকাতার লোকরা ছোট মনের মানুষ বলে পরিচিত। যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা জানেন যে কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। সেই কোলকাতাতে আমি ছোট এক বন্যার সময় আমি ছিলাম। এত ছোট বন্যা যে বন্যার পানি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। সেই বন্যায় স্থানীয় দোকানদারেরা সবাই নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম কমিয়ে দিয়েছিল। ওই কয়দিন তারা নামমাত্র লাভে বিক্রি করেছে। এমনকি আমার এলাকাতেও , যেখানে বন্যার পানিই দেখা যায়নি। দেশের মানুষের বিপদে এভাবে সাহায্যের হাত বাড়ানোটা সঠিক নাগরিকের কাজ। আর দেশের মানুষের প্রতি এই ভালোবাসাকে দেশপ্রেম বলে। আমাদের দেশে বন্যার সময় জিনিস পত্রের দাম বাড়িয়ে জুলুম করা হয়। আমরা বুঝি দেশপ্রেম হল মুখে কতগুলো শব্দ বলা। শব্দ সমুহ হল - মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি।

দেশপ্রেম কাকে বলে তা আমরা বুঝিই না।

আরো অপ্রাসঙ্গিক ছোট একটি গল্প এখানে না যোগ করে পারছি না। প্রাচীন আমলে এক লোক হেটে হেটে অন্য শহরে যাচ্ছে। সাথে তার কুকুর রয়েছে। পথে একবার লোকটি কান্না করছে। তা দেখে রাস্তার অন্যরা জিজ্ঞেস করল "কি ব্যাপার তুমি কাদছ কেন?"। সে জানালো যে তার কুকুরটি ক্ষুদায় মারা যাচ্ছে তাই কাদছে। ওরা আবার জিজ্ঞেস করল "তোমার পোটলার ভেতরে কি?"। লোকটি উত্তর দিল "হালুয়া আর রুটি"। সবাই অবাক হয়ে বলল "তোমার পোটলায় খাবার রয়েছে আর তুমি সেটা কুকুরকে না দিয়ে কাদছ কেন?"। লোকটি উত্তর দিল, খাবার দিলে তো পয়সা খরচ হয়, কাদলে তো পয়সা লাগে না।

এবার মুল কথায় ফিরে আসি। চেতনা কথার মানে বোধশক্তি। মুক্তিযুদ্ধ কি এই বোধশক্তি সবার আছে। আমাদের মধ্যে যেটি নেই সেটি হল দায়ীত্ববোধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কথাটা রাজনীতিবিদ ও তাদের সুবিধাভোগীরাই ব্যাবহার করেন। কোন এক দলের নেতা কর্মী তো বটেই, সমর্থনকারী পর্যন্ত দাবী করে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক আর বাকী দল রাজাকারে ভরা। এমনই চলে আসছে গত ৪০ বছর ধরে। ওদের কাছেই জিজ্ঞেস করুন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি? উত্তরে হয়ত আপনাকে রাজাকার বলে বসতে পারে। আর যদি ভদ্রতা দেখায় - তবে উপরের মার্কা মারা শব্দগুলি ব্যাবহার করে এদ দীর্ঘ ভাষন দিবে। সেই ভাষনের অর্থ দাঁড়ায় - "আমাদের দেশ স্বাধীন করতে ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। অগনিত লোক মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এর নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাদের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ রাজাকার মুক্ত করতে হবে। আমাদের দেশে কোন রাজাকার থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে লালিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।"

আমার কথা বিশ্বাস না করে বিশেষ দলটির নেতা কর্মী বা সমর্থকের কাছে "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি?" প্রশ্নটি করে দেখুন। তার উত্তরের সারমর্ম যদি উপরে বর্নিত কথাগুলোর বাইরে যায় তবে আমি ভুল লিখেছি বলে ক্ষমা চাইব। আসলে এর বাইরে তারা কথাই বলতে পারে না। লক্ষ্য করে দেখুন ওই উত্তরের মধ্যে "মুক্তিযুদ্ধের চেতনা" এর অর্থ বলা নেই। উত্তরটিতে রয়েছে শুধু আবেগ। এই আবেগটাকেই আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হয়।

তাদের বলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে এক আবেগ ছাড়া আর কিছুই না। অনেকের এই আবেগ রয়েছে। বেশিরভাগ লোকের এই আবেগ নেই। তারা বারবার এই চেতনা (আবেগ) এর কথা বলে আবেগ সম্পন্ন লোকদের আবেগ নিয়ে খেলা করে ফায়দা লুটে। আমরা যেহেতু দেশপ্রেম বুঝি না তাই এসব চেতনার কথা বললে আমরা মনে করি "ওরে বাবা, কত বড় দেশপ্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলছে"। যারা চেতনার কথা বেশী বলে তাদেরকে আমরা বেশী দেশপ্রেমিক বলি, সমর্থনও করি।

কোলকাতার ওই ঘটনা মনে করুন। ওখানে দোকানদারেরা কিন্তু আবেগের ধারে কাছেও যায়নি। আবেগ হলে ওরা মানুষের বাড়ী বাড়ী গিয়ে সান্তনা দিয়ে আসত। ওরা যেটা করেছে সেটা হল দায়ীত্ব, কর্তব্য, সহায়তা, টিমওয়ার্ক, মানবতা, সেবা। এর মধ্যে আবেগ বলে কিছু নেই। আবেগ আছে সেই ব্যাক্তির যে উপরের গল্পে কুকুরকে খাবার না দিয়ে কাদছে। এবার আসুন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। সিনেমা নাটকে বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ দেখানো হয়। কেউ আবেগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে দায়ীত্ব, কর্তব্য, সহায়তা, টিমওয়ার্ক, মানবতা, সেবা, অধীকার আদায়, ইত্যাদী থেকে। আবেগ রয়েছে এমন লোক মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। সে ঘরে বসে "দেশে কেন যুদ্ধ হচ্ছে" এই বলে কেদেছে। কোন দায়ীত্ব সঠিকভাবে পালন করেনা এমন লোকেরই আবেগ বেশী থাকে। আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায় ধর্মগ্রন্থ কাপড়ে জড়িয়ে চুমা খায় কিন্তু ভেতরে কি লেখা আছে তা পড়ে দেখে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা তারাই বলে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়ীত্ববোধ অনুভব করে না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (আবেগ) বলে কিছু আমাদের দরকার নেই। যেটা দরকর তা হল মুক্তিযুদ্ধের দায়ীত্ব, কর্তব্য, দায়ভার, কৃতজ্ঞতা। কোলকাতায় দোকানদারেরা যেভাবে এলাকাবাসীর বিপদে সাহায্য করেছিল। ঠিক কোন এক বিপদে এলাকাবাসীরাও সুযোগ পেলে দোকানদারকে সাহায্য করবে। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব বোধ থেকে যুদ্ধ করেছে। আমাদের দায়িত্ব হল তাদের সেই বাংলাদেশ রক্ষা করা, ভালো একটি দেশ বানানো ও তাদেরকে যোগ্য সন্মান দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে বলে মুখে ফেনা তুললেও কোন লাভ নেই। আমাদের দরকার কাজ - দরকার বাস্তবায়ন।

অনেকে হয়ত মনে করছেন মুক্তিযোদ্ধারা তো দেশে অনেক সুবিধা পাচ্ছে। তাদেরকে যোগ্য সন্মান না হলেও বেশ সন্মান দেওয়া হয়। মিডিয়াতে কি দেখা যায় তা না দেখে আপনার আশেপাশে দেখুন মুক্তিযোদ্ধারা কেমন সন্মান পাচ্ছে। যেসব মুক্তিযোদ্ধা সুবিধা বা সন্মান পাচ্ছে তারা হয় ধনী। নতুবা সামাজিকভাবে বা রাজনীতিকভাবে বা অন্য কোন ভাবে প্রভাবশালী।

অনেক আগে এক ঈদে বিটিভি এর আনন্দমেলা দেখেছিলাম। এক পর্যায়ে দেখা গেল মঞ্চে আমন্ত্রিত চারজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হুইল চেয়ারে বসে রয়েছে পেছনে দাঁড়িয়ে দেশের এক বিখ্যাত কন্ঠশিল্পী ওই গানটি পুরো গাইল "আমরা তোমাদের ভুলব না"। আমি চিন্তা করলাম ওই মুক্তিযোদ্ধারা এই অপমানের পরেও ওখানে বসে রয়েছে কেন। অপমানটা কোথায় হয়েছে বুঝতে পারেন নি? এবার বুঝবেন। এর আগে বলে রাখি, টিভিতে মুখ দেখানোর জন্য কিন্তু ওই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রভাবশালী হতে হয়েছে বা প্রভাবশালী লোকের দারস্থ হতে হয়েছে।

একটি ছোট গল্প বলে শেষ করব। একজন তার বন্ধুর জীবন রক্ষা করতে গিয়ে নিজের পা হারিয়েছে। এখন সেই বেচে যাওয়া বন্ধুটি যদি পা হারানো বন্ধুটিকে হুইল চেয়ারে করে বসিয়ে মগবাজারের মোড়ে এসে গান গায় "বন্ধু তোমাকে কোনদিন ভুলব না"। রাস্তার সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে এসব দেখছে। তাহলে কেমন হবে? আমার তো মনে হয় হুইল চেয়ারের বন্ধুটির জন্য এর চেয়ে অপমানের আর কিছু নেই। (আল্লাহ না করুন) একবার ভাবুন, হুইল চেয়ারের ওই বন্ধুর যায়গায় আপনি হলে কি করতেন? আমার তো মনে হয় চড় মেরে ওই গান গাওয়া বন্ধুর কয়েকটি দাত ফেলে দিতেন।

এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্মান দেই। ওই অনুস্টানে যদি দেখানো হতো আমন্ত্রিত মন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা পাশাপাশি বসে একই সন্মান পাচ্ছে তাহলে হোত যোগ্য সুন্মান। তারা নিজের পা হারিয়ে আমাদেরকে এই দেশ উপহার দিয়েছে - তাদেরকে সামনে বসিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে গান গাচ্ছে "আমরা তোমাদের ভুলব না"। এটাকে সন্মান নয় ফাইজলামী বলে। ইদানিং এটাকেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে জানি ।

আমাদের মধ্যে সুবিধাভোগী ও আবেগী চেতনা না থেকে দায়ীত্বশীল চেতনা থাকলে আমরা ব্যাপারটি বুঝতে পারতাম।

Comments