পাঠ্যবই ও মিডিয়ার কেরামতি - পর্ব ২


এখানে পর্ব -১ || বিভিন্ন মিডিয়ার মিথ্যাচার এখন আমদের গা সওয়া হয়ে গেছে। ভুল তথ্য বিশ্বাস করানোতে মিডিয়ার চেয়ে অনেক বেশী কার্যকরী পাঠ্যবই। প্রশ্নের যে উত্তর লিখে আপনি পরীক্ষায় পাশ করেছেন সেটা যে ভুল তথ্য তা আপনি কোনদিন মেনে নিবেন না। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি যদি একই কথা মিডিয়াতে ও আশেপাশে শুনতে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। আপনি কোনদিন চিন্তাও করবেন না যে এটি ভুল নাকি শুদ্ধ।
দেশে অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবি রয়েছেন। তারা এসব অসঙ্গতি জানেন ও বুঝতে পারেন। এদের কেউ এসব বিষয়ে কথা বললে, সমালোচনা নয় , একেবারে গালাগালির মুখেই পড়তে হবে। তাই মান মর্যাদা ধরে রাখতে তারা এসব বিষয়ে কোন উচ্চ বাচ্য করেন না। গত লেখাতে লিখেছিলাম মানুষের চাদে যাওয়া প্রসঙ্গে। এবার লিখছি ভাষা আন্দোলন নিয়ে। ভাষা আন্দোলনের প্রতি আপনার মতন শ্রদ্ধাবোধ আমার রয়েছে। আমি শুধু তুলে ধরছি অসঙ্গতিপুর্ন (অথবা ভুল) তথ্য, যা আমরা সারা জীবন ধরে শিখেছি। আমার অবশ্যই ভুল হতে পারে। যুক্তিপুর্ন ও মার্জিত ভাষায় আমার ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন আশা করি। মুল বিষয়ে যাবার পুর্বে অতি সংক্ষেপে রাস্ট্রভাষা আসলে কেমন সেটা বলে নিচ্ছি।

রাস্ট্রভাষাঃ ইংরেজিতে এটিকে official language বলা হয়। ইংরেজী নামটি আসলে বেশী যুক্তিযুক্ত। এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “কাগজে কলমে দেশের ভাষা”। ভালো বাংলায়, সংবিধানিক ভাষা। এই official language যে একটিমাত্র ভাষা হতে হবে এমন কোন কথা নেই। অনেক দেশে দুই বা ততোধিক official language রয়েছে। যেমন, ভারতে হিন্দি ও ইংরেজী, শ্রীলঙ্কাতে সিনহালা ও তামিল, কানাডাতে ইংরেজি ও ফ্রেন্স, হংকং এ ইংরেজী ও চাইনিজ, সিঙ্গাপুরে ইংরেজি, মালায়, চাইনিজ, তামিল। একাধিক official language থাকলে অনেক সময় সেগুলোকে first language, second language ইত্যাদি বলা হয়। এই শব্দেগুলোর সঠিক বাংলা আদৌ রয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। এসব ছাড়াও একটি দেশে regional language (আঞ্চলিক ভাষা) থাকে। বাংলাদেশে যেমন রয়েছে সিলেট ও চিটাগং এর ভাষা।

এবার মুল বিষয়ে আসছি। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আমরা কি জানি? পাঠ্যবইয়ে, মিডিয়াতে, আশেপাশের মানুষের কাছে আমরা ভাষা আন্দোলন বিষয়ে যে জ্ঞান পেয়েছি তা নীচে দেওয়া হল।

পাকিস্তানীরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানী শাশক কায়েদে আজম জিন্নাহ ঘোষনা করেন “উর্দু হবে একমাত্র রাস্ট্রভাষা”। এর প্রতিবাদে আন্দোলন ও মিছিল হয়। এই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়। শহিদ হয় সালাম, বরকত, রফিক এবং আরো অনেকে। এর পরে বাংলাকে রাস্ট্রভাষা করা হয়। আমাদের দামাল ছেলেরা বুকের রক্ত দিয়ে বাংলা ভাযাকে রাস্ট্রভাষা রক্ষা করে।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে আপনি বিস্তারিত আরো অনেক কিছু জানতে পারেন। কিন্তু আপনি যাই জানেন না কেন, মুল কথা কিন্তু এই কয় লাইন, যা আমি আগের প্যারাতে লিখেছি। আশা করি এই ব্যাপারে আপনার কোন দ্বিমত নেই। উপরের এই তথ্য আংশিক ভুল। সঠিক তথ্য নীচে।

পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শাশকের গোস্টির ভাষা যেহেতু উর্দু ছিল তাই তারা উর্দুকে বাংলাদেশের একমাত্র রাস্ট্রভাষা বানানোর ঘোষনা দেয় ১৯৫২ সালে। পুর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাসিন্দাদের ভাষা ছিল বাংলা তাই তারা উর্দুকে বর্জন করে বাংলাকে রাস্ট্রভাষা বানানোর দাবী জানায়। এই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয় সালাম, বরকত, রফিক সহ আরো অনেকে। এর পরেও রাস্ট্রভাষা উর্দু থাকে। পাশাপাশি বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা (second language ) এর অনুমোদন দেওয়া হয়। রাস্ট্রভাষা বাংলা (first language) হয় এর অনেক পরে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। ১৯৫২ সালে নয়।

উপরের প্যারা দুটির কোনটি সঠিক বা যুক্তিযুক্ত সেটা আপনার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে যদি আপনি কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুজবেন। বলা বাহুল্য, এসব প্রশ্নের উত্তর কোন পাঠ্যবইতে খুজে পাবেন না। এর উত্তর খুজতে আপনাকে সাধারন জ্ঞান (যেটাকে common sense বলা হয়), যুক্তি ইত্যাদির সাহায্য নিতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা মুখস্থ বিদ্যা ধাচের হওয়ায় এসব প্রশ্নের উত্তর কেউ খোজেও না।

১। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী রাস্ট্রভাষা উর্দু এর ঘোষনা দেওয়া হয় এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়। এর আগে রাস্ট্রভাষা কি ছিল? (উদাহরনঃ ১৯৫২ সালের ১০ই জানুয়ারী রাস্ট্রভাষা কি ছিল?)

- এই প্রশ্নের উত্তরে ৯৯% মানুষ বলবেন, “উর্দু”। লক্ষ্য করুন, পাকিস্তানের শাশকেরা ঘোষনা দিয়েছিল “উর্দু রাস্ট্রভাষা হবে”। তখনকার ভাষা যদি উর্দুই ধাকত তাহলে তো “উর্দু হবে” এই ঘোষনা দেবার কোন দরকার ছিল না। এখানে একটি গোজামিল রয়েছে। সেটি কি?

২। ২১শে ফেব্রুয়ারীর পরে রাস্ট্রভাষা কি হয়েছিল? (উদাহরনঃ ১৯৫২ সালের ১০ই মার্চ রাস্ট্রভাষা কি ছিল?)

- এই প্রশ্নের উত্তরে ৯৯% মানুষ বলবেন, “বাংলা”। লক্ষ্য করুন, বাংলাদেশ বলে তখন কিছু ছিল না। ছিল পুর্ব পাকিস্তান বা পাকিস্তানের পুর্ব অংশ। একই দেশ, পুর্ব ও পশ্চিম অংশ। পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তবে তো পশ্চিম অংশেও বাংলা হয়ে যাবে। এর মানে করাচী ও ইসলামাবাদে বাংলা চালু হবে। তা কি হয়েছিল? এখানে গোজামিলটা কি?

৩। “রাস্ট্রভাষা উর্দু হবে” এর প্রতিবাদ না করলে কি হতো?

- অনেকেই বলবেন তাহলে আমরা বাংলায় কথা বলতে পারতাম না। বাংলায় লিখতে পারতাম না ইতাদি। আসলে কি তাই?

এবার গোজামিলের মিমাংশা দেখে নিন।

পাকিস্তান নামক দেশটি ইংরেজদের শাশনে ১৯০ বছর থেকে স্বাধীন হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট। স্বাধীন হওয়ার পরেও ইংল্যান্ড এর রাজারা পাকিস্তানের রাজা ছিল। এই পদ্ধতি এখনো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে রয়েছে। ইংল্যান্ড এর রানী এখনো ওদের রানী। ঠিক একইভাবে ইংল্যান্ডের রাজা রানীরাই স্বাধীন পাকিস্তানের রাজা রানী ছিল। এই পদ্ধতি বন্ধ হয় ১৯৫৬ সালে যখন পাকিস্তান তাদের সংবিধান পরিবর্তন করে ইসলামিক সংসদীয় গনতন্ত্র চালু করে।

১৯০ বছর ইংরেজ শাশিত একটি রাস্ট্রের রাস্ট্রভাষা কি ছিল? অবশ্যই ইংরেজী। পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরে যেমন ইংল্যান্ডের রাজা বর্জন করতে ৯ বছর লেগেছে। ঠিক তেমনি ইংল্যান্ডের ভাষা বর্জন করার সিদ্ধান্তে আসতে ৫ বছর লেগেছে। ১৯৫২ সালে “রাস্ট্রভাষা উর্দু হবে” এই ঘোষনা দেওয়ার আগে পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা ইংরেজী ছিল। আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। রাস্ট্র ক্ষমতায় যেসব নেতারা ছিল তারা ছিল উর্দুভাষী। কাজেই উর্দুকে রাস্ট্রভাষা বানানোর চেস্টা করেছে। বাংলাভাষী নেতারা রাস্ট্রক্ষমতায় থাকলে তারা রাস্ট্রভাষা বাংলা বানাতে চাইত। বাংলাভাষীরা রাস্ট্রক্ষমতায় ছিল না, তাই নিজের ভাষা রাস্ট্রভাষা করার জন্য প্রতিবাদ করেছে, প্রান দিয়েছে। এখানে যার যার নিজের ভাষাকে প্রতিস্টা করার মনোভাব কাজ করেছে। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া বা ফিরিয়ে দেওয়া এসব আবেগী কথামাত্র।

ভাষা আন্দোলনের পরে রাস্ট্রভাষা বাংলা হয়ে যায়নি। যেটা হয়েছে সেটা হল বাংলাকে second language বা regional language হিসাবে সাংবিধানিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। রাস্ট্রভাষা বাংলা হলে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষীদেরকে বাংলা ব্যাবহার করতে হতো। যেটা কখনো হয়নি। ষাট দশকে বঙ্গবন্ধুর অধিকার আদায়ের আন্দোলেনে মিছিলে বিভিন্ন ব্যান্যার ও প্লেকার্ড ইত্যাদীতে বিভিন্ন দাবীর সঙ্গে এটাও লেখা থাকত “রাস্ট্রভাষা বাংলা চাই।“ ১৯৫২ সালে রাস্ট্রভাষা বাংলা হলে “রাস্ট্রভাষা” দাবীটি ১৯৬৫ সালে কেউ করত না। রাস্ট্রভাষা বাংলা হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। এর আগে বাংলা ভাষা ছিল পাকিস্তানের second language

এবার সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ। ভাষা আন্দোলন না হলে কি হতো।

বাংলাদেশের খুব কাছে পশ্চিম বঙ্গ (কোলকাতা) তাই ওখানে যাবার সুযোগ অনেকেরই হয়েছে। ভারতের first language হিন্দি ও second language ইংরেজী। ভারতের অংশ হওয়ার পরেও কোলকাতাবাসীদের বাংলা ভাষার ব্যাবহার ঢাকাবাসীদের চেয়ে কি কম? কোলকাতার কোথায় বাংলা ভাষা ব্যাবহার করা নিষেধ? ভারত এর কেন্ত্রীয় সরকার রাস্ট্রভাষা হিন্দি বানিয়ে, এত বছরেও কলকাতার মানুষের মুখের ভাষা (বাংলা) কেড়ে নিতে পারেনি। ওদিকে ১৯৫২ সালে পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা বানালে তখন আমাদের মুখের ভাষা (বাংলা) কেড়ে নেওয়া হয়ে যেত, তাই না? ভাষা আন্দোলন না হলে আমাদের অবস্থা হতো কলকাতাবাসীদের মতন। উর্দুকে রাস্ট্রভাষা মেনে নিতে হতো এবং বাংলাকে ইচ্ছামতন ব্যাবহার করতে পারতাম। ভাষা আন্দোলনের পরে যেটা হয়েছে সেটা কিছুটা একই রকম। উর্দুকে first language ও বাংলাকে second language মেনে নিতে হয়েছে। ভাষা আন্দোলন হয়েও ফলাফল প্রায় একই হয়েছে।

তাহলে ভাষা আন্দোলনের প্রাপ্তি কি?

ভাষা আন্দোলনে আমরা যা পেয়েছি তা হল (ভাষা নয়) সন্মান ও গর্ব। উর্দুভাষী শাশকেরা উর্দুকে রাস্টভাষা বানানোর কথা বললে বীর বাঙ্গালী ছেলেরা জি স্যার, জি স্যার বলে তা মেনে নেয়নি। বরং তাদের নিজেদের ভাষাকে প্রতিস্টা করতে চেয়েছে এবং জীবন দিয়েছে। এটা আমাদের জাতীর জন্য এক বিশাল সন্মান বয়ে এনেছে। মুক্তিযুদ্ধের শহিদেরা আমাদের যেমন গর্বের, ভাষা আন্দোলনের শহিদেরাও তেমনি গর্বের।



উপসংহার
পাকিস্তানের শাশকের গোস্টির ভাষা যেহেতু উর্দু ছিল তাই তারা উর্দুকে বাংলাদেশের একমাত্র রাস্ট্রভাষা বানানোর ঘোষনা দেয় ১৯৫২ সালে। পুর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বাসিন্দাদের ভাষা ছিল বাংলা তাই তারা উর্দুকে বর্জন করে বাংলাকে রাস্ট্রভাষা বানানোর দাবী জানায়। এই আন্দোলনে শহিদ হয় ভাষা সৈনিকেরা। এর পরেও রাস্ট্রভাষা উর্দু থাকে। পাশাপাশি বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা (second language ) এর অনুমোদন দেওয়া হয়। রাস্ট্রভাষা বাংলা (first language) হয় এর অনেক পরে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। ১৯৫২ সালে নয়।

ভাষা আন্দোলন আমাদের জন্য সন্মান বয়ে আনে। বাংলা ভাষা আমাদের সবসময় ছিল। ভাষা কেউ কোনভাবে কেড়ে নিতে পারে না। ভাষা আন্দোলন হয়েছে ভাষা রক্ষার জন্য নয়। এটা হয়েছে ভাষার সন্মান রক্ষার আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন আমাদেরকে বাংলা ভাষা ব্যাবহার করার অধিকার দেয়নি। এ অধিকার আমাদের জন্মগত। ভাষা আন্দোলন আমাদের বাংলা ভাষাকে (রক্ষা করেনি) গৌরভময় করেছে।

Comments