কোরআনের ভুমিকা ও বাচনভঙ্গি


কোরআন যে আল্লাহর বানী সেটা প্রমান করার জন্য বিভিন্ন কথা ও মতবাদ প্রচলিত রয়েছে। এক এক জনে এক এক ভাবে কোরআনকে আল্লাহর বানী বলে প্রমান করে। বিজ্ঞানের এই যুগে, অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞান দিয়েই বিষয়টা প্রমানের চেস্টা করে। কোরআনে অনেক কথা লেখা আছে যা শত বছর পরে বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করেছে। "আল্লাহর বানী না হলে কোরআনে হাজার বছর আগে বিজ্ঞানের ওই বিষয়গুলো থাকত না" এই যুক্তিটা বেশ প্রচলিত।

কোরআনে আশ্চর্য রকমের গনিত ও পরিসংখান রয়েছে। কোন অক্ষর কতবার এসেছে কোন অক্ষরের বা বিষয়ের সাথে কোন বিষয়ের কি মিল রয়েছে এগুলোও বেশ আশ্চর্যজনক। উদাহরনঃ "বিসমল্লাহির রহমানুর রাহিম" আরবীতে লিখতে ১৯ টি অক্ষর লাগে। কোরআনের সুরার সংখা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য, মোট আয়াতের সংখা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য এরকম অনেক লম্বা এক তালিকা রয়েছে যা ১৯ দ্বারা বিভাজ্য। এই ধরনের অনেক রকমের সংখার খেলা কোরআনে রয়েছে। কোরআনের বিভিন্ন সংখার এমন মিল এখোনো আবিস্কার হচ্ছে। এসব দেখিয়েও অনেকে কোরআনকে আল্লাহর বানী বলে প্রমান করেন।

কোরআন কবিতার মতন ছন্দ মেলানো একটি বই। আরবী সাহিত্য সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তারা কোরআন এর সাহিত্য বিষয়টি বুঝতে পারে। এমন অনেক আরবী ভাষাবাসীর কথা যে এমন সাহিত্য মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। পরিতাপের বিষয়, আরবী না জানার কারনে আমি এবং আমার মতন অনেকেই কোরআন এর সাহিত্য সুখ অনুভব করতে পারছি না।

এভাবে বিজ্ঞান, গনিত, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে শ্রেস্টত্বের প্রমান দেয় কোরআন। আর এই যুক্তিগুলো আমাদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে। হ্যা, এগুলো সঠিক যুক্তি। আমি এর সঙ্গে আরো কিছু যোগ করে বিষয়টি সমৃদ্ধ করব, ইনশা আল্লাহ।

বেশীরভাগ লোকই কোন বইয়ের ভুমিকা পড়ে না। ভুমিকা পড়া বেশ গুরুত্বপুর্ন। কোন বইয়ের ভুমিকা না পড়ে থাকলেও আপনি হয়ত জানেন যে ভুমিকাতে কি থাকে। ভুমিকা হল পাঠকের কাছে লেখকের এক প্রকারের চিঠি। বিভিন্ন লেখক বিভিন্নভাবে ভুমিকা লিখলেও কিছু মুল কথা প্রায় সব লেখকের লেখাতেই থাকে। ভুমিকাতে লেখক লিখতে পারেন তিনি কে, তার যোগ্যতা কি, (বিনয়), এই বইটিতে কি লেখা আছে, বইটি লিখতে কি কি কস্ট করতে হয়েছে, কার কার সাহায্য পেয়ে তিনি কৃতজ্ঞ, ভবিশ্যতে কি লিখবেন ইত্যাদি। প্রায় ১০০% লেখক ভুমিকাতে লিখেন তাদের বইয়ে ভুল ত্রুটি পাওয়া গেলে ক্ষমা করতে, পরবর্তীতে সেগুলো সংশোধন করা হবে। কারন লেখক ভালো ভাবেই জানেন, হাজার সাবধানতা সত্বেও বইতে ছোট খাট ভুল থাকবেই।

কোরআনের ভুমিকা হল সুরা ফাতিহা। ফাতিহা শব্দের অর্থ প্রারম্ভিকা (Opening). অনেক বইতে দেখবেন “ভুমিকা” শব্দের বদলে “প্রারম্ভিকা” শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। আমারা সবাই এই সুরা জানি। এতে কি বলা হয়েছে তা নীচে দেওয়া হল।

সকল প্রশংসা জগতসমুহের প্রতিপালক আল্লাহরই

যিনি পরম দয়ালু

বিচার দিবসের মালিক

আমরা শুধু তোমারই ইবাদত করি, শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি

আমাদেরকে সরল (আকাবাকা নয়) পথ প্রদর্শন কর

তাহাদের পথ, যাহাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ

তাহাদের পথ নয়, যাহারা (তোমার) ক্রোধে নিপাতিত ও পথভ্রস্ট

উপরের এই ৭ টি বাক্য ভালো করে পড়ে দেখুন। এটি কোরআনের ভুমিকা বা প্রারম্ভিকা। কোরআনের লেখক আল্লাহ আর পাঠক আমরা। দেখুন এখানে লেখক (আল্লাহ) কিন্তু নিজের যোগ্যতা বলেনি, বিনয় করেনি, বইটিতে কি দেওয়া আছে তা বলেনি, বইটি লিখতে কি কি কস্ট করতে হয়েছে তা বলেনি, কার কাছে কৃতজ্ঞ তা বলেনি, ভবিশ্যতে ক লিখবে তা বলেনি এমনকি এটা বলেনি যে বইতে ভুল থাকতে পারে। ক্ষমা চাওয়া তো দুরের কথা। এমন ক্ষমতাবান লেখক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন। বইটি নির্ভুল এবং এর জন্য আল্লাহকে কোন কস্ট করতে হয়নি এবং কখনোই কারো সাহায্য আল্লাহর দরকার হয়না তাই কৃতজ্ঞতার প্রশ্নই আসে না। উনি সর্বশক্তিমান, সবাইকে ক্ষমা করেন, উনি আবার ক্ষমা চাইবেন কার কাছে? কোরআনের এই ভুমিকা দেখলেই বোঝা যায় এর লেখক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন।

কোরআনের ভুমিকাতে (সুরা ফাতিহা) আসলে কি আছে? লক্ষ্য করুন, ওই ৭টি বাক্য কিন্তু দোয়া (প্রার্থনা) ছাড়া আর কিছুই নয়। কোরআনের পাঠক (আমরা) এই দোয়া কোরআনের লেখকের (আল্লাহ) কাছে করবে। বলবে আল্লাহ, সর্বশক্তিমান, তুমি আমাদের করুনা কর, আমাদের সরল পথ দেখাও যেন আমরা তোমার অনুগ্রহ প্রাপ্তদের কাতারে সামিল হতে পারি। বইটি কিভাবে লিখেছে সেটা পাঠককে বুঝতে হবে না - লেখকের কাছে প্রার্থনা করতে হবে। এমন ভুমিকার লেখক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নন। কোন মানুষ এমন বাচনভঙ্গীর ভুমিকা লিখতে সাহস পাবে না।

কোরআন আল্লাহর বানী এটা আল্লাহ নিজেই কোরআনে বলেছেন। বেশীদুর পড়তে হবে না, কোরআন এর দ্বিতীয় পাতাতেই ( page) এ বিষয়ে আল্লাহর বানী রয়েছে ।

- আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি (কোরআন) তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা এর অনুরূপ কোন সুরা নিয়ে আস এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হয় তবে আল্লাহ ব্যাতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহবান কর। || যদি তোমরা তা আনয়ন না কর এবং কখনোই করতে পারবে না, তবে সেই আগুনকে ভয় কর, মানুষ ও পাথর যার ইন্ধন, কাফিরদের জন্য যা প্রস্তত করে রাখা হয়েছে। (সুরা বাকার-২৩,২৪)

এখানে একেবারে পরিস্কার করে বিষয়টি বলা রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন যে সন্দেহ থাকলে এমন একটি সুরা নিয়ে আসতে এবং এও বলেছেন যে আল্লাহ ব্যাতীত কেউ তা পারবে না।

এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হল কোরআনের বাচনভঙ্গী, কথা বলার ধরন। আপনি চিঠি লেখার সময় বাবা, শিক্ষক, ছোট ভাই, স্ত্রী সবার কাছে আলাদা বাচনভঙ্গীতে লেখেন। বাবার কাছে ও ছোট ভাইয়ের কাছে লেখার সময়, একই কথা কিন্তু লেখার ধরন ভিন্ন হয়ে যায়। আল্লাহ কোরআন লিখেছেন আমাদের জন্য। আমরা তার বান্দা, দাস। তিনি আমাদের মালিক, রব। লেখার ধরনে কিন্তু সেটি স্পস্টভাবে ফুটে উঠেছে। কোরআনের বাচনভঙ্গীতে আরো একটি জিনিস ফুটে উঠেছে সেটি হল আল্লাহ সর্বশক্তিমান। আল্লাহ কাউকে খুশি করে কথা বলেন না। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন।

আমার উদাহরন দেওয়া উপরের আয়াতেই (সুরা বাকারা - ২৩,২৪) দেখুন। মানুষ যে সন্দেহ করবে যে কোরআন আল্লাহর বানী নয়, সেটা তিনি (আল্লাহ) জানেন। মানুষকে তাই এমন সুরা বানানোর কথা বলেছেন। কোন মানুষ এই চেস্টা করলে যে অন্য লোকের সাহায্য নিবে সেটাও আল্লাহ জানেন। তাই তিনি সব সাহায্যকারীকে আনতে বলেছেন। কোন চ্যালেঞ্জ দিলে যে মানুষ অসত উপায়ে যেটা পুরন করার চেস্টা করে সেটা জেনেই আল্লাহ বলেছেন “যদি তোমরা সত্যবাদী হও”। মানুষ যে পারবে না তাও তিনি বলেছেন। মানুষের যে কি ক্ষমতা রয়েছে তাও তিনি জানেন। তাই তিনি বলেছেন, কখনোই করতে পারবে না। এরপরেই দোজখের আগুনকে ভয় করতে বলেছেন। এই আয়াতে রয়েছে চ্যালেঞ্জ, মানুষের অক্ষমতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ও সাবধান বানী। কোথাও উপদেশ নেই। একটি দুটি আয়াত নয়, মনযোগ দিয়ে কোরআনের যে কোন একপাতা পড়ুন। বাচনভঙ্গীর বিষয়টি বুঝতে পারবেন।

ইন্টারনেটের এই যুগে, অন্য কোন ধর্মগ্রন্থ পড়ার যথেস্ট সুযোগ রয়েছে। সার্চ করলেই শত কপি পাওয়া যায়। এগুলো পড়ে দেখতে পারেন। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের বাচনভঙ্গীতে যা রয়েছে তা হল উপদেশ। এই কাজ করিবে, এইভাবে করিবে, খারাপ কাজ করিবে না, ভালো হয়ে চলিবে, ইশ্বরকে স্মরন করিবে। ইশ্বর রক্ষা করিবে, ইত্যাদি। অন্য ধর্মগ্রন্থের বানী নমনীয়। কোরআনে নরম সুরে বলা কোন কথাই নেই। বাবা সব সময় শাশন করে না। মাঝে মাঝে আদরের সুরে ছেলেকে কোন কিছু করতে বলে বা উপদেশ দেয়। কোরআনে তেমন নরম সুরে বলা কোন উপদেশ নেই। মনিব তার কেনা গোলামকে যেভাবে আদেশ দেয় তেমন আদেশ রয়েছে কোরআনে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ছাড়া এমন বাচনভঙ্গী দিয়ে কোন বই লেখা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ যদি এমন বাচনভঙ্গী দিয়ে বই লেখার চেস্টা করে তবে সেই বইয়ের ভেতরে তার নিজের অজান্তেই নমনীয়তা চলে আসবে। কোরআনের কোথাও নমনীয়তা আসেনি।

আল্লাহ এজন্যই বলেছেন যে আমরা একটি সুরাও বানাতে পারব না। এমন সাহিত্য, গনিত, বিজ্ঞান ও সর্বপরি বাচনবঙ্গী সব আমাদের দ্বারা সম্ভব নয়। এছাড়া আল্লাহ আমাদের তৈরি করেছেন। কাজেই তিনি আমাদের ক্ষমতা ভালো করেই জানেন।

কোরআন রাসুল (সাঃ) এর একটি মুজেজাও বটে। আল্লাহ যে যে আশ্চর্য ক্ষমতা নবী ও রাসুলকে প্রদান করেন তাকে মুজেজা বলে। দেড হাজার বছরেও এই বইটি একটুও পরিবর্তন হয়নি। সারা বিশ্বের সব কোরআনে একই কথা লেখা আছে। একটি বর্নও এদিক সেদিক নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল লক্ষ লক্ষ মানুষ কোরআন মুখস্ত করে রেখেছে। এটি একমাত্র বই যা মানুষ দাড়ি কমা সহ সারা বই হুবহু মুখস্ত রাখতে পারে। এমনকি অর্থ না বুঝেও। সারা বিশ্বের সব কোরআন এর কপি নস্ট হয়ে গেলেও লক্ষ মানুষের মুখস্ত করা কোরআন আবার বই আকারে লেখা হয়ে যাবে। এভাবেই কোরআন অপরিবর্তিত থাকছে ও থাকবে। কোরআন, আল্লাহর কুদরতে সংরক্ষিত হয়।

Comments