গনতন্ত্র বলিয়া লজ্জা দিবেন না

আমরা বুঝে বা না বুঝে, মুখে সব সময় গনতন্ত্র বলি। আমরা এর অংশবিশেষ বেশ কঠোর ভাবে পালনও করি। বিশ্বের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এমন অনেক জাতি রয়েছে যাদের উপরে স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্র ৩০-৪০ বছর চাপিয়ে রাখা ছিল এবং এখনো আছে। জনগন কম বেশী প্রতিবাদ করলেও, বহু বছরেও সে সব জাতি ওই স্বৈরাচার হটাতে সক্ষম হয়নি। এদিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন।
আমাদের দেশে স্বৈরশাশক বেশিদিন টিকতে পারে না। এটিই গনতন্ত্রের সেই অংশ যা আমরা কঠোরভাবে পালন করি। আরেকটি গনতান্ত্রিক বিষয় আমাদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে, সেটি হল বাকস্বাধীনতা। যদিও এটা আগে পরে বিভিন্ন স্বৈরশাশক বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এর পরেও সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান এই দেশে প্রচলিত বাক স্বাধীনতা একেবারে কম নয়।

বাকস্বাধীনতা ও স্বৈরশাশক উতখাত করে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধি বসানো গনতন্ত্রের অংশবিশেষ, এটা সম্পুর্ন গনতন্ত্র নয়। আমি আশা করি না যে আমাদের দেশে একেবারে সঠিক (আদর্শ) গনতন্ত্র থাকবে। কিন্তু গনতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের ধারনাটা তো অন্তত সঠিক হতে হবে। আমার আগের এক লেখাতে (বিশ্বের একমাত্র স্বাধীন ও দেশপ্রেমিক রাস্ট্র) আমি, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের ব্যাপারে প্রচলিত ধারনার বাইরে এক ধারনা দিয়েছিলাম। এবার চেস্ট করব গনতন্ত্রের সম্পর্কে একটা ধারনা দিতে - বরাবরের মতনই প্রচলিত ধারনার বাইরে।

সবার সমান অধিকারঃ গনতন্ত্রের প্রথম কথা হল সবার সমান অধিকার। ৩য় বিশ্বের একটি দেশে এটা নিশ্চিত করা অসম্ভবের চেয়েও বড় কিছু। সমান অধিকারের জন্য সবচেয়ে প্রথম যেটা প্রয়োজন সেটা হল অর্থ ও ক্ষমতা সবারই কাছাকাছি হতে হবে। তা না হলে সমান অধিকার এর কথা সারাদিন বললেও সেট বাস্তবায়ন হবে না। একজন কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়ছে, অন্যজন ফুটপাতে থাকে। একজন ফাইভ স্টারে খাবার খায় অন্যজন ফেলে দেওয়া খাবার খায়। একজন রাস্তা দিয়ে গেলে তার আগে পিছে ৫০ জনের এক বাহীনি থাকে, অন্যজন ফুটপাতেও হাটতে পারে না। একজন শত জমি লোকের দখল করে, অন্যজন আবার সেই দখলদারের সাথে শক্তিতে না পেরে জমি হারায়। এরকম আকাশ পাতাল ব্যাবধানের দুজন মানুষের সমান অধিকার দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। সমান অধিকার দিতে চাইলে প্রথমে এই ব্যাবধান কমাতে হবে। উন্নত দেশে গনতন্ত্রের উন্নত রূপ দেখতে পাওয়া যায়। এর অন্যতম প্রধান কারন হল, অদের জনগনের ব্যাবধান কম। তাই সকলেরই কম বেশী সমান অধিকার রয়েছে।

এ ব্যাপারে একেবারে বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রায় সব প্রবাসীদের। আমি নিজ়েও এর বাইরে নই। ছাত্র অবস্থায়, বিদেশে আমার প্রথম কাজ ছিল এক রেস্টুরেন্টে প্লেট ধোয়ার কাজ। তখন, এক প্রকারের হতাশা কাজ করত। লেখা পড়া শিখে শেষ পর্যন্ত কাজের বুয়ার কাজ করতে হচ্ছে। নতুন কাজ শিখছি তাই প্রথম দু এক সপ্তাহ কাজ করতে গেলেই আমার পুরো পোষাকে পানি, তেল, ঝোল, খাবারের এটো ইত্যাদি লেগে থাকত। সে এক নোংরা অবস্থা আর কি। এমনই এক দিনে হটাত রেস্টুরেন্টের মালিক আমাকে কিছু টাকা ও জমা বই ধরিয়ে দিয়ে বললে, কাছের ব্যাঙ্কে টাকাটা জমা দিতে। আমি বললাম "পোষাকটা পরিবর্তন করে যাই"। ঊনি বললেন "দরকার নেই"। একে তো বিদেশে, তার উপরে আবার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার ব্যাঙ্ক - একেবারে চকচকে। আমি এসেছি অন্যের টাকা জমা দিতে, আমার তো এই ব্যাঙ্কে একাউন্ট নেই। ওদিকে সিকিউরিটি দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দিবে তো? যাই হোক কিছু চিন্তা ভাবনা করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। টাকা জমা দেবার জন্য অপেক্ষা করছি। আসেপাশে তাকিয়ে দেখি একজন সাদা চামড়ার লোক লেবারের পোষাক পড়া, পা থেকে মাথা পর্যন্ত সিমেন্ট এর দাগ। সেও ব্যাঙ্কে এসেছে। তাকে দেখে আমি সাহস ফিরে পেলাম। এর পরে টাকা জমা দিয়ে চলে এলাম। এরপরে আমি বিভিন্ন সময়ে অনেকবার খেয়াল করে দেখেছি যে, নোংরা কাজের পোষাক পড়ে কোন লেবার এসেছে নাকি কোট টাই পড়ে অফিসের বড় স্যার এসেছে - এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। লোকটি কি করতে এখানে এসেছে এটাই মুল বিষয়। এটাকে সমান অধিকার বলে। এই সমান অধিকার সম্ভব হয়েছে অর্থ ও ক্ষমতা কাছাকাছি হবার কারনে। একজন লেবার অনেক ক্ষেত্রে অফিসারের চেয়ে বেশী রোজগার করে। এছাড়া আইন সবার জন্য সমান তাই ক্ষমতাও সবার সমান। এমন সমান অধিকার কোন দেশে থাকলে- তারপরে সেখানে গনতন্ত্র চলে। তা না হলে সারা জীবন ধরে চলে গনতন্ত্রের অপব্যাবহার।

সঠিক নেতা চেনার ক্ষমতাঃ গনতান্ত্রিক দেশে যেহেতু জনগনের ভোটে নেতা নির্বাচিত হয় সেহেতু জনগনের সঠিক নেতা চেনার ক্ষমতা থাকাটা খুবই জরুরী। এই বিষয়ে আমরা খুবই দুর্বল। নিএর এলাকাতেই দেখুন। সংসদ নির্বাচনে দুইজন ভোটে দাড়িয়েছে। একজন এলাকার নামকরা একজন সৎ শিক্ষক অপরজন কোন এক দলের সন্ত্রাস ও দুর্নীতিবাজ নেতা। এক্ষেত্রে সবাই কিন্তু ওই দুর্নীতিবাজকেই নির্বাচিত করবে। এখানে জনগনের অজুহাত হল শিক্ষক হলেন নরম স্বভাবের লোক। এমন লোক দিয়ে কাজ হয় না। লক্ষ্য করুন, আমরা নিজেরাই কিন্তু ইচ্ছে করেই খারাপ লোককে নির্বাচিত করছি। আবার এই খারাপ লোক যখন তার স্বভাবসুলভ সন্ত্রাস ও দুর্নীতি করে তখন আবার আমরাই বলছি "নেতারা দেশটাকে নস্ট করছে"। এমন নস্ট লোককে নেতা বানিয়ে দেশ নস্ট করার সুযোগ কিন্তু আমরাই করে দিয়েছি। আমাদের নেতা চেনার এই মানষিকতার পরিবর্তন না হলে সঠিক গনতন্ত্র কখনো আলোর মুখ দেখবে না।

পরিবার তন্ত্রঃ এই জিনিসটি আমাদের দেশের মতন ভারতেও কিছুটা রয়েছে। সেই মান্দাতার আমলের পদ্ধতি, রাজার ছেলে রাজা হবে - যোগ্য হোক আর না হোক। আমরা এই আধুনিক সমাজ়ে বাস করে গনতন্ত্রের বুলি আওড়াচ্ছি আবার অন্যদিকে কিন্তু রাস্ট্রপ্রধান বানানোর জন্য ওই দুই পরিবারের বাইরে চিন্তা করতে পারছি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজ়িবর রহমানের কন্যা ও শহিদ জিয়াউর রহমান এর স্ত্রী - এদের বাইরে আমরা কিন্তু কাউকেই রাস্ট্রপ্রধান বানানোর কথা চিন্তা করতে পারি না। এদের পরে আসছে এদের দুইজনের ছেলেরা। কিছুতেই এই দুই পরিবারের বাইরে আমরা যেতে পারছি না। এরশাদ এর পতনের পরে বহু চেস্টা করেও কখনো আবার ক্ষমতায় যেতে পারেনি। কারন দেশের জনগন এরশাদকে হাড়ে হাড়ে চিনেছে। তাকে কখনোই আবার ক্ষমতায় বসাবে না। কিন্তু ওই দুই পরিবারকে কিন্তু জনগন চিনতে পারছে না। জনগন ঘুরে ফিরে অদলবদল করে তাদেরকেই ক্ষমতায় আনছে। এর পেছনে দায়ী উক্ত দুই পরিবারের প্রতি আমাদের প্রেম ও আমাদের মনের গহীনে বাস করা "রাজার ছেলা রাজা হবে" এই মানষিকতা। দেশে ৩০০ টি আসনে উক্ত দুই পরিবার এর প্রার্থীদের সাথে প্রতিযোগীতা করে অন্য দলের প্রার্থীরা অথবা সতন্ত্র প্রার্থীরা। আমাদের ওই পরিবার প্রেম না থাকলে বেশির ভাগ আসনেই অন্য কোন দল বা সতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হতো। আমরা পেতাম দেশে নতুন কোন শাশক, নতুন কোন ব্যাবস্থা। অদল বদল করে ওই দুই পরিবার আর কত? এতকিছুর পরেও আমাদের কি কখনোই শিক্ষা হবে না?

জনগন সর্বময় ক্ষমতার উতসঃ জানি না এই কথাটি কে আবিস্কার করেছে। আপনি গনতন্ত্রের সংগা, ইতিহাস, বিশ্লেষন ও বানী ইত্যাদি ঘেটে দেখতে পারেন। এই কথাটি কোথাও নেই। যদি থাকেও, এটি একটি ভুল কথা। গনতন্ত্র, জনগনের দ্বারা পরিচালিত, জনগনের জন্য, জনগনের স্বার্থে। কিন্তু জনগন ক্ষমতার উতস নয়। ক্ষমতার উতস হল জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আপনি আমি জনগন, আমাদের ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা রয়েছে আমরা যাদের নির্বাচন করেছি। আমাদের ক্ষমতা নেই দেখেই আমরা একজন ক্ষমতাবান লোক নির্বাচিত করি। আমাদের ক্ষমতা নেই বলেই রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দেশের জনগন জিম্মি।

পরিশেষে, আমাদের দেশে ও সমাজে গনতন্ত্রের মুল উপাদানগুলিরই অভাব রয়েছে। সঠিক গনতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীর পরিবেশের বড় অভাব। সাধারন জনগনের বোধদয় না হলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। অনেক দোকানে যেমন লেখা থাকে "বাকী চাহিয়া লজ্জা দিবেন না"। আমাদের দেশের চলমান গনতান্ত্রিক পরিস্থিতিতেও এটি বলতে হচ্ছে - গনতন্ত্র বলিয়া লজ্জা দিবেন না।

Comments