হিল্লা বিয়ে ও এর অপব্যাবহার

অনেক আগে থাকেই ইসলামে প্রচলিত হিল্লা বিয়ে নিয়ে অনেক ধরনের সমালোচনা শুনে আসছি। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবি এটাকে নিষিদ্ধ করার আহবান জানিয়েছেন অনেক আগে থেকেই। ইদানিং আবার ফেসবুক ও বিভিন্ন ব্লগে ইসলামে এলার্জী ওয়ালা লোকেরা বিভিন্ন কায়দায় এটাকে সমালোচনা করছে। বলা হচ্ছে যে এটি একটি মধ্যযুগীয় পদ্ধতি যা কিনা নারী অধিকারের পরিপন্থী। তারা কি বলে তাতে কিছু যায় আসে না ঠিকই। কিন্তু এটা শুনে আমরা চুপ থাকলে সাধারন মুসলমানেরা না বুঝেই এটাকে আমাদের দুর্বলতা ভাববে। অনেকেই ভাববে যে, তাই তো এমন মধ্যযুগীয় পদ্ধতি ইসলামে আছে, এটা তো আসলেই বর্জন করা দরকার। এভাবে ইসলামের প্রতি আস্থা কমে যাবে। আগেই বলেছি, আমি ইসলামের নয় বিজ্ঞানের ছাত্র। আমার সাধ্যমতে আমি ইসলামের সমালোচনার জবাব দেই। ইসলামের ছাত্ররা এটা আরো ভালো পারবেন। আশা করব তারা এই ধরনের যে কোন সমালোচনার জবাব দিতে আরো বেশী ততপর হবেন।
হিল্লা বিয়ে কিঃ একজন তার স্ত্রীকে, রাগ হয়ে বা ভুল করে তিন তালাক দিয়েছে। এখন সে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে চায়। এজন্য সেই স্ত্রীকে অন্য একজন পুরুষের সাথে (অস্থায়ী) বিয়ে দিতে হবে। তারা দুজনে একান্তবাস করতে হবে। এর পরে তারা তালাক দিয়ে বিচ্ছিন্ন হবে। এখন এই মহিলা আগের স্বামীকে আবার বিয়ে করতে পারবে।

এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গল্প উপন্যাস আছে। সেখানে নারীর অসহায়ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। কিভাবে স্বামীর রাগের কারনে ১০ বছরের স্বপ্নের সংসার থেকে নারীটি পর হয়ে গেল। কিভাবে ভাড়া করা এক লম্পটকে অস্থায়ী বিয়ে করে তার সাথে রাত্রিযাপন।করতে হয়। কিভাবে সমাজের প্রতিটি মানুষ তার দিকে তাকায়। কিভাবে পুরোনো স্বামীর ঘরে ফিরে মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করে ইত্যাদি। অমন যে হয় না তা নয়। কিন্তু এগুলো সবই ইসলামের নিয়মের অপব্যাবহার। এছাড়া অজ্ঞতার কারনে এর প্রতিবাদও কেউ করে না।

বরাবরের মতন, আমার স্বভাববসত, বোঝানোর জন্য একটি গল্প বলছি। এক লোকের একটি গরু হারিয়ে গিয়েছে। কয়েকদিন খোজার পরে না পেয়ে শেষে সে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে যে, সে যদি গরুটি ফেরত পায় তবে সেই গরু বিক্রী করা সব টাকা সে মসজিদে দান করবে। আল্লাহর কি রহমত, লোকটি একদিন পরে গরুটি ঠিকই খুজে পেয়েছে। কিন্তু এতে তার মন খুব খারাপ। গরু বিক্রী করা সব টাকা মসজিদে দিতে হবে। কি করা যায়। অবশেষে এক হুজুরের কাছে গিয়ে সমাধান চাইলেন। হুজুর এক দিন চিন্তা করে তাকে একটি চমতকার সমাধান দিলেন। হুজুরের পরামর্শ মতন লোকটি ওই গরুটি ও একটি মোরগ বিক্রী করার জন্য বাজারে নিয়ে গেল। একটি সাইনবোর্ড ঝুলালো “অপুর্ব সুযোগ। এই গরুটির মুল্য মাত্র ৩০০ টাকা, কিন্তু এই দামে গরুটি পেতে হলে ২০ হাজার টাকা দিয়ে এই মোরগটি কিনতে হবে”। মোট মুল্য কিন্তু ঠিকই আছে শুধু মোরগের ও গরুর দাম অদল বদল করে দেওয়া হয়েছে। একজন ক্রেতা এভাবে ২০,৩০০ টাকা দিয়ে মোরগ ও গরুটি কিনে নিল। আর আমাদের গল্পের নায়ক গরুর বিক্রয়মুল্য ৩০০ টাকা মসজিদে দান করে, মুরগীর বিক্রয়মুল্য বাকী ২০ হাজার টাকা নিজের কাছে রেখে দিল। কি চমতকার সমাধান। কথার বরখেলাফও হল না, মসজিদে অনেক টাকাও দিতে হল না।

আমাদের সমাজে প্রচলিত হিল্লা বিয়েটা আসলে উপরের গল্পের মতনই। এতে চালাকী করে ইসলামের এক পদ্ধতিকে অপব্যাবহার করা হয়। নামটিও ভুল। কথাটি “হিল্লা” নয় “হালালা”। সংক্ষেপে বিষয়টি আলোচনা করছি। ইসলামের ছাত্ররা আমার ভুল পেলে অবশ্যই ধরিয়ে দিবেন। মানুষকে ভুল জানিয়ে পাপী হতে চাইনা।

ইসলামে বিয়ের পদ্ধতিঃ অন্যান্য অনেক ধর্মে বিয়ে জনিসটা সামাজিকতা। কিন্তু ইসলাম ধর্মে বিয়ে হল একটা চুক্তি (contact) । ব্যাবসা, বানিজ্য, জমি বেচা কেন ইত্যাদির যেমন চুক্তি হয় তেমনি বিয়েটাও একটা চুক্তি যেখানে একজন নারী ও একজন পুরুষ আজীবন একে অপরের সাথে থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। বিয়েতে নারী পুরুষ উভয়ে মৌখিকভাবে রাজী আছে (কবুল) এটা বলবে । দুইজন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হবে। এবং কনের দাবী করা দেনমোহর তাকে স্পর্শ করার আগে পরিশোধ করতে হবে। আমাদের দেশে, এখানেও আছে ঝামেলা। সমাজে মান মর্জাদা বাড়ানোর জন্য দেনমোহর কোটি টাকা ধার্য্য করা হয় যা স্বামী বেচারা কখনো দিতে পারে না।, বাসর ঘরে গিয়ে বউয়ের কাছে ক্ষমা চায় আর এভাবে বিয়েটাই ত্রুটিপুর্ন থেকে যায়। নিয়ম হল, স্বামীর সাধ্যমত টাকা ধার্য্য করে সেটা তখনই পরিশোধ করা। দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম যখন নাজিল হয়েছিল তখন চুক্তির জন্য দলিল লেখালিখির তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। মুখের কথাতেই শত একর জমি কেনা বেচা হয়ে যেত। তাই তখন মুখের কথাতেই বিয়ে হয়ে যেত। এখন সব চুক্তির মতন বিয়েতেও দলিল লাগে। মুখের কথাতে যেমন জমি বেচা কেনা কেউ মানে না তেমনি মুখের কথায় বিয়েও কেউ মানে না।

ইসলামে তালাক এর পদ্ধতিঃ তালাক হচ্ছে বিয়ে বিচ্ছেদের চুক্তি। মুখে বিয়ের মতন মুখে তালাক পদ্ধতিও ইসলামে প্রচলিত। তিনবার তালাক বললেই তালাক হয়ে যায়। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে যে, আপনি যেখানে মুখে মুখে বিয়ে মেনে নেন না সেখানে মুখে বলা তালাক কেন মেনে নিবেন? যে সমাজে বা দেশে মুখে বলা বিয়ে প্রচলিত সেখানে বিখে তালাক গ্রহনযোগ্য। আমাদের সমাজে বিয়ের মতন তালাকও লিখিত (দলিল) হতে হবে। অনেক বলতে পারেন যে মুখে বলা তালাক তো ইসলামেরই নিয়ম, এটাকে অমান্য করব কিভাবে? হ্যা, ঠিক কথা। কিন্তু মুখে বলা বিয়েও তো ইসলামের নিয়ম। সেটা অমান্য করেন কেন?

দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি ইসলামের এই মুখে বলা বিয়ে বা তালাকের বিরোধী নই। কিন্তু মুখে বলা পদ্ধতি বানানো হয়েছে সঠিক মুসলমানদের জন্য যারা সত্যবাদী ও যাদের মুখের কথার মুল্য আছে। এই পদ্ধতি আমাদের এই সমাজে চলছে না, বা প্রযোজ্য নয়। এই পদ্ধতি সঠিক ভাবে পালন করার মতন সঠিক মুসলমানও আমরা নই। এজন্যই আমরা সবখানে এর অপব্যাবহার দেখতে পাই। আর একটি কথা। আমরা মনে করি যে , ইসলাম মতে, তালাক দেবার একছত্র অধিকার শুধু স্বামীর থাকে। আসলে স্ত্রীও এই অধিকার পেতে পারেন তবে তার জন্য বিষয়টি বিয়ের চুক্তিতে আগেই উল্লেখ করতে হবে।

হালালা বিয়েঃ আগেই বলেছি আমরা হিল্লা বিয়ে বলে যেটা চিনি সেটা ইসলামে নেই। সেটা আসলে ইসলামে প্রচলিত এক পদ্ধতির অপব্যাবহার মাত্র। তাহলে সঠিক পদ্ধতিটা কি?

লাল মিয়া ও ফুলবানু যখন বিয়ে করেছিল তখন মনে করেছিল যে সারা জীবন একসাথে থাকবে। কিন্তু তাদের মধ্য বনাবনি হল না। তাদের মধ্য বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ফুলবানু এখন কিন্তু অবিবাহিত (স্বামীহীন) এক নারী। এখন সে তার পুর্ব স্বামী লাল মিয়া বাদে যে কোন পুরুষকে বিয়ে করতে পারে। এভাবেই একদিন ফুলবানু, ধলা মিয়াকে বিয়ে করে। নতুন এই দম্পতিও ঠিক করে যে তারা এক সাথে সারা জীবন থাকবে। এর পরে ফুলবানু ও তার ২য় স্বামী ধলা মিয়া সুখে শান্তিতে বাস করতে লাগল।

গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু যদি কোনদিন দুর্ভাগ্যবসত ফুলবানু ও ধালা মিয়ার বনাবনি না হয়। যদি তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তবে ফুলবানু আবার স্বামীহীন হবে । এই অবস্থায় সে ধলা মিয়া ছাড়া যে কোন পুরুষকে (৩য়) বিয়ে করতে পারে। এই সময়ে ফুলবানু তার প্রথম স্বামী লাল মিয়াকেও বিয়ে করতে পারে।

মোট কথা, বিয়ের মতন তালাকটাও স্থায়ী। তালাকের পরে স্ত্রী অন্য এক জনকে স্থায়ীভাবে বিয়ে করবে এবং ঘর সংসার করবে। যদি কোন দিন সেই নতুন সংসারেও বিচ্ছেদ ঘটে তবে অন্য যে কোন পুরুষের মতন পুর্বের স্বামীও ওই নারীকে বিয়ে করতে পারবে।

গরু ও মোরগের ওই গল্পের মতন বিয়ের বিষয়টাকে চালাকী করে নিজের ফায়দা লুটতেই আমাদের সমাজে হিল্লা বিয়ে (অস্থায়ী বিয়ে) প্রচলিত রয়েছে। এটি ইসলামিক পদ্ধতি নয়। এ বিষয়ে জনসচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে।

Comments