যিনা, প্রেম ও বিয়েঃ সমাজ কি বলে

বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যৌন সম্পর্ককে যিনা বলে। আমাদের সমাজ আর পশ্চিমা দেশগুলির সমাজে যিনার খুব বেশী পার্থক্য নেই। পার্থক্য একটাই, আমাদের দেশে গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। পশ্চিমা দেশগুলিতে বিষয়টা খোলামেলা। আসলে আমদের সমাজ হছে মাঝামাঝি কায়দার। আমরা না পেরেছি ইসলামিক জীবন গ্রহন করে যিনা থেকে সমাজকে মুক্ত করতে। না পেরেছি পশ্চিমা দেশের মতন যিনাকে সমাজে উন্মুক্ত করে দিতে। ফলে যেটা হয়েছে, সেটা হল – যিনা ঠিকই চলছে, কিন্তু গোপনে । এই গোপন করার জন্য মাত্র তিনটি কারন কাজ করে।
১। লোকে কি বলবে ।

২। এমন অভিজ্ঞতা আছে জানলে বিয়ের বাজারে দাম কমে যাবে

৩। বিবাহিত হলে স্বামী/স্ত্রী এর কাছে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।

বহুল প্রচলিত একটি কথা আছে – চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড় ধরা। যিনাকারীদের অবস্থা হল তেমন। লক্ষ করুন, উপরের তিনিটি কারন সবই অন্যের চোখে নিজের দোষ ধরা পড়ার ভয়। পশ্চিমা সমাজের মতন যদি আমাদের সমাজে যিনা করাটাকে সাধারন বিষয় হিসাবে দেখা হতো । তাহলে, আমার ধারনা যিনা জিনিসটা আমাদের সমাজেও উন্মুক্ত হয়ে যেতো ।

যিনা কারা করে? আমি ধর্ষনের কথা বলছি না । ধর্ষন, প্রায় খুনের মতনই একটি অমানবিক বিষয় । এখানে আমি বলছি আপোযে যিনা করার কথা। দুই ধরনের লোক এমন করে ।

১। অবিবাহিত বা বিবাহিত, কিন্তু নিত্য নতুন স্বাদ তার ভালো লাগে ।

২। অবিবাহিত , বিয়ে করছে না বা করতে পারছে না ।

পশ্চিমা সমাজে যিনা বিষয়টি উন্মুক্ত হলেও নিত্য নতুন স্বাদ খোজা বা একসাথে বহু সঙ্গী রাখা কাজটিকে কেউ ভালো মনে করে না । বিষয়টা কিছুটা সিগারেট এর মতন। আমাদের সমাজে সিগারেট এর ভালো প্রচলন আছে। সবাই জানে যে এটি একটি খারাপ ও ক্ষতিকারক অভ্যাস । ধুমপায়ী ব্যাক্তিও ধুমপানকে ভালো বলে না। ঠিক তেমনি বহু সঙ্গী থাকাটা পশ্চিমা বিশ্বে ফ্যাশান হয়ে গেলেও, এটাকে কেউ ভালো বলে না। বদভ্যাস হিসাবেই দেখে। আর আমাদের সমাজে এটাকে খারাপ বলবে এটাই স্বাভাবিক । বহু সঙ্গী অভ্যাস্তদের সংখা খুব বেশী না । তাদেরকে এমন বদঅভ্যাস মুক্ত করতে হলে বেশ কিছু পদক্ষেপ দরকার। সেটা আজকের আলোচনা নয়।

আমাদের সমাজে যেটা সবচেয়ে বেশী আকারে ছড়িয়ে আছে, সেটা হল অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের প্রেম । এমন অনেক প্রেম শারিরীক সম্পর্কে রূপ নেয় । বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে বিয়ে হয় না। মেয়েটির বিয়ে হয়ে যায় অন্য একটি অচেনা ছেলের সাথে । ওদিকে ছ্যাকা খাওয়া প্রেমিক কয়েক মাসের মধ্যেই অন্য এক প্রেমিকা খুজে নেয়। শুরু হয় একই রুটিন । সবাই কিন্তু প্রেম করতে, বা একটি মেয়েকে পটাতে জানে না । এমন অনেক ছেলেই শারিরীক চাহিদা মেটাতে পতিতার স্মরনাপন্ন হয়। এই শ্রেনীর ছেলে-মেয়েদের সমস্যা একটাই। অভাবে স্বভাব নস্ট । এরা অবিবাহিত, কাজেই শারীরিক চাহিদা মেটানোর বৈধ কোন পথ নেই। সেজন্যই অবৈধ পথে গমন। এমন লোকের সংখাই বেশী। বিয়ের পরে এরা সাধারনত আর অবৈধ পথে পা বাড়ায় না।

যাদের স্বভাব এমনিতেই নস্ট তাদের সংখা খুব বেশী নয়। আমাদের বেশীর ভাগ রয়েছে ওই অভাবে স্বভাব নস্ট ক্যাটাগরীতে। কিসের অভাব? বিয়ের অভাব। সঠিক বয়েসে বিয়ে করে না বা করতে পারে না ।এজন্য আমাদের সমাজ ব্যাবস্থা সম্পুর্ন দায়ী । কিছুটা দায়ী অভিভাবকও।

অমুকের ছেলের ২৫ বছর বয়স হয়েছে । এখনো লেখা পড়া করছে । বিয়ে করছে না কেন? কারন, সে তো এখনও লেখা পড়া করছে। লেখাপড়া করে মানুষের মতন মানুষ হবে । বড় চাকরী করবে। এর পরে না হয় বিয়ে । অমুকের ছেলে বি এ পাশ করেছে । এখন একটা ছোট খাটো চাকরি করছে। কিন্তু বিয়ে করতে পারছে না । কারন তার অল্প টাকাতে নিজেরই ভালোভাবে চলে না। বউ চালাবে কিভাবে ? অমুকের অল্প বিস্তর কিছু টাকা আছে। কিন্তু তার তিন বোনকে বিয়ে না দিয়ে নিজে বিয়ে করতে পারছে না । বিয়ের পরের খরচের কথা বাদ দিলেও বিয়ের সময়তেই, যৌতুক, দেনমোহর, বিয়ের অনুস্টান ইত্যাদিতে তো লাখ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায় । হাজার টাকা বেতনের চাকরী করে, কবে লাখ টাকা জমাবে আর কবে বিয়ে করবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।

মুল কথা, আমাদের সমাজে বিয়ে জনিসটা এমন দুর্লভ আর কঠিন করে তোলা হয়েছে যে, এর যোগাড় যন্ত্র করতে অর্ধেকের বেশী আয়ু শেষ হয়ে যায়। বাকী আয়ু শেষ হয় বিয়ের পরবর্তী পরিবার সামলাতে । এই ঘটনার ব্যাতিক্রম দেখতে পাবেন দুটি শ্রেনীতে । অতি উচ্চ আর অতি নিম্ন শ্রেনীতে। তারকাদের জন্য বিয়ে ও বিচ্ছেদ তেমন কোন সমস্যা নয়। আবার বস্তিবাসির জন্যও বিয়ে ও বিচ্ছেদ তেমন কোন সমস্যা নয় । এজন্য এই দুই শ্রেনীর মধ্যে বিয়েটা সহজ । যত গ্যাড়াকলে আছে মধ্যবিত্ত । এরা না পরে বস্তির মতন স্বল্প আয়োজনে বিয়ে করতে। না পারে ধনীর মতন সহজেই বড় আয়োজন করতে । কাজেই কবে সেই সুদিন আসবে, এই অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় । শরীর আর মন তো সেই অপেক্ষা বোঝে না । কাজেই শারীরিক চাহিদা মেটানোর জন্যই বাধ্য হয়ে অবৈধ পথ অবলম্বন করতে হয় ।

দেরীতে বিয়ে করার জন্য, ছেলে মেয়েদের এই অবৈধ পথ অবলম্বন করার পাপের ভাগ কিন্তু অভিভাবকের ঘাড়েও পড়ে । আপনার ছেলে ২৫ বছর বয়স । লেখাপড়া করে । এখন তাকে বিয়ে দিলে কি ক্ষতি হবে ? একটাই ক্ষতি । মানুষ বিভিন্ন সমালোচনা করবে। কিন্তু ওই ছেলেটির জীবন শুধরে যাবে । সে আজেবাজে খেয়াল থেকে মুক্ত হয়ে লেখাপড়া, কাজ কর্মে মনযোগ দিবে । আপনার আশেপাশে দেখুন যারা অল্প বয়সে বিয়ে করেছে তারা হয়ত যেভাবে ধনী বা প্রতিস্টিত হতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু তারা সবাই জীবনটাকে অনেক আগেই ও অনেক সহজেই গুছিয়ে নিতে পেরেছে। সুখে রয়েছে । পক্ষান্তরে যারা জীবনটাকে গোছানোর জন্য বিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে – তারা এখনো গোছাচ্ছে। গোছানো আর শেষ হচ্ছে না

২৫ বছর বয়সের দুই বন্ধু । দুজনেই ছাত্র । একজন এই বয়সেই বিয়ে করল । অন্যজন বিয়ে না করে জীবন গোছাতে শুরু করল । ১০ বছর পরে এই দুই বন্ধুর অবস্থা দেখবেন । দেখবেন বিবাহিত বন্ধুর ১-২ টি সন্তান আছে । তার নিজের চাকরি বা ব্যাবসা গুছিয়ে নিয়েছে । সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। ওদিকে অবিবাহিত বন্ধুটি হয়ত কিছুটা বেশী টাকা কামাই করেছে কিন্তু এখনো অগোছালো । মেসে থাকে, হোটেলের খাবার খায়, রাত জেগে টিভি দেখে, মাঝে মাঝে নেশা করে আর জৈবিক চাহিদার ব্যাপার তো আছেই । এটা কিন্তু সুখের জীবন নয় ।

বিয়ে আসলে বয়সের ব্যাপার । যখন বয়স হবে, তখনই বিয়ে করতে হবে । এতে করে শরীর, মন , সুখ, ধর্ম সবই বজায় থাকবে । আমরা তো সমাজ পরিবর্তন করতে পারব না । কিন্তু নিজের ঘর তো পরিবর্তন করতে পারি। অভিভাবকের যদি শুভ বুদ্ধির উদয় হয় এবং তারা বিষয়টি বুঝে সঠিক বয়সে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেন তবে আমরা একটি গোছানো, সুখী সমাজ পাব।

ছোট একটি ঘটনা বলে শেষ করব । ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়াসি দ্বীপে এক উপজাতি রয়েছে । তাদের সমাজে মরদেহ সতকার করার পদ্ধতি প্রচুর ব্যায়বহুল । এই আয়োজনকে একটি মেলার সাথে তুলনা করা চলে । ১০-১২ টি গরু জবাই করে সারা গ্রাম খাওয়াতে হয় । উল্লেখ্য, গরুর দাম বিশ্বে সবচেয়ে বেশী, সম্ভাবত ইন্দোনেশীয়াতে । বাংলাদেশের ১ লক্ষ টাকার নীচে সেখানে কোন গরু পাওয়া যায় না । মোটকথা একজন মারা গেলে, তার কবর দিতে ১৫-২০ লক্ষ টাকা খরচ হয়ে যায় । এটা তাদের ধর্মীয় পদ্ধতি । কাজেই “আমি গরীব” এটা বলে পার পাওয়া যায় না । এজন্য ওই উপজাতী সমাজে এখনো মমি করার ব্যাবস্থা চালু আছে । লাশ, মমি করে রেখে দেয়, যাতে না পচে । এমন লাশ রাখার জন্য, মাচার মতন বিশেষ এক ঘর আছে (নীচে ছবি দেখুন)। তারপর ৫-১০ বছর ধরে টাকা যোগাড় করে । এর পরে কবর দেয় । অনেক সময়, কয়েকটি পরিবার মিলে টাকা জমিয়ে একসাথে কয়েকটি মৃতের কবর দেবার আয়োজন করে।  এই পদ্ধতিটি শুধুমাত্র ওই উপজাতীদের জন্য । পুরো ইন্দোনেশিয়াতে নয় ।


আমাদের দেশের বিয়ের ব্যাপারটা কিছুটা এমন হয়ে গেছে । কেউ মারা গেলে, যেমন দেরী না করে কবর দিতে হয় । তেমনি, কারো উপযুক্ত বয়স হলেই, দেরী না করে বিয়ে দিতে হয় । টাকার জন্য বা জীবন গোছানোর জন্য অপেক্ষা করাটা হাস্যকর । আসুন, সঠিক বয়সে বিয়ে দিয়ে ছেলে-মেয়েদের যৌবনকে মমি বানানো থেকে রক্ষা করি।

Comments