জাকাতের অপব্যাবহার

কোন একটি নিয়ম বা পদ্ধতি অপব্যাবহার করে নিজের সুবিধামতন ব্যাবহার করতে আমরা খুব পারদর্শী। আর সেই পদ্ধতিটি যদি ইসলামের হয় তাহলে তো কথাই নেই। জাকাত কে দিবে, কতটুকু দিবে, কাকে দিবে ইত্যাদি নিয়ম কানুনের আলোচনা আমার এই লেখাতে আসেনি। আমি লিখেছি আমরা কিভাবে জাকাতের অপব্যাবহার করি এবং চেস্টা করলে কিভাবে আমরা জাকাতের গঠনমুলক ব্যাবহার করতে পারি।
সক্রেটিসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল “আপনি আদব কায়দা কার কাছ থেকে শিখেছেন?” উত্তর ছিল - বেয়াদবের কাছ থেকে। অর্থাৎ, বেয়াদব যা করে, উনি তা করেন না। আসলে একটি জিনিস পরিপুর্নভাবে চিনতে হলে তার বিপরীত বিষয়টিও চেনা দরকার। জাকাত হচ্ছে সুদের বিপরীত পদ্ধতি। হ্যা, সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন এমন হয়ছে যে সুদ ছাড়া কোন উপায় নেই বললেই চলে। অথচ সুদ, ইসলামের সবচেয়ে বড় গুনাহের মধ্যে একটি। সুদ আর জাকাত দুটোই আপনারা খুব ভালোভাবে চিনেন। ব্যাবস্থা দুটির মুল আসলে কি সেটা আজ দেখব।

সুদঃ এই ব্যাবস্থায় একজন টাকা ধার নেয় এবং ফেরত দেবার সময় তাকে বেশী টাকা দিতে হয়। সব সময় একজন গরীব ধার নেয়, কোন ধনীর কাছ থেকে। এর উলটো কখনো হয় না। অর্থাৎ, যে ধনী লোকটি টাকা ধার দিল সে সুদ হিসাবে গরীবের টাকা নিজের পকেটে নিতে পারল। বছরে বছরে সুদ বাড়বে আর আরো টাকা ধনীর পকেটে ঢুকবে। এভাবে আস্তে আস্তে গরীবের সব টাকা ধনীর পকেটে ঢোকানোর উদেশ্যেই এই সুদ পদ্ধতি আবিস্কার হয়েছে। ধনী আরো ধনী হবে, গরীব সব হারিয়ে পথের ফকির হবে। ব্যঙ্ক, ক্রেডিট কার্ড সবই এই পদ্ধতির আধুনিক রুপ। সুদের পদ্ধতিতে টাকার প্রবাহ নীচের থেকে উপরে। অর্থাৎ গরীবের কাছ থেকে ধনীর কাছে যায়।

জাকাতঃ এই ব্যাবস্থায়, একটা নির্দিস্ট পরিমান অর্থ সম্পদ থাকলে একজনের উপরে জাকাত ফরজ হয়। এই জাকাত দিতে হয় কোন গরীবকে। এভাবেই বছরে বছরে জাকাত দিলে ধনীর ভান্ডার আস্তে আস্তে কমে যাবে। আর গরীবের পকেটে আরো বেশী টাকা যাবে। জাকাতে পদ্ধতিতে টাকার প্রবাহ হল নীচের দিকে। অর্থাৎ ধনীর কাছ থেকে টাকা গরীবের হাতে আসে। এভাবেই ধনী ও গরীবের ব্যাবধান কমানোর জন্যই রয়েছে জাকাতের পদ্ধতি। এছাড়া জাকাত ইসলামের একটি স্তম্ভ। জাকাত ফরজ - অর্থাৎ অবশ্যই পালনীয়। জাকাত না দিলে কবীরা (বড়) গুনাহ হয়। আর জাকাতকে অস্বীকার করলে কাফের হতে হয়।

বোঝা গেল যে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ছাড়ও জাকাতের মুল উদ্দেশ্য হল ধনী-গরীবের ব্যাবধান কমানো। কিন্তু আমাদের জাকাতের অপব্যাবহারের কারনে সেটা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। অপব্যাবহার কোথায়?

আমাদের দেশের সাধারনত একজন মধ্যবিত্ত ব্যাক্তিই জাকাত দেবার মতন যথেস্ট ধনী। অনেক হয়ত মনে করেন, জাকাত তো বড়লোকের জিনিস। এটা আমার জন্য নয়। অথচ জানেন না যে তিনি নিজেই জাকাত দেবার উপযুক্ত। অর্থাৎ জাকাত তার উপরে ফরজ। অনেকে আছেন, ইচ্ছে করেই কম পরিমানে জাকাত দেন। কারন বেশী পরিমানে জাকাত দিলে মানুষ তার গোপন সম্পদের পরিমান জেনে যাবে। তাই কম পরিমানে জাকাত দিয়ে দায়টা সারেন আর কি। তাছাড়া, ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পড়ে আছে আর এক টাকাও জাকাত দেয় না - এমন লোক তো প্রচুর আছে।

যারা সঠিক পদ্ধতিতে জাকাতের পরিমান নির্ধারন করেন, অর্থাৎ সঠিকভাবে যাকাত দেন তারাও কিন্তু অপব্যাবহারের উর্ধে নন। তাদের অপব্যাবহার অভ্যাসগত। জাকাত আর খয়রাত যে এক জিনিস নয় এটা বেশীরভাগ মানুষই বুঝতে চায় না। বাধ্য হয়ে যেমন সুদের কিস্তি দিতে হয় তেমন বাধ্য হয়েই গরীবকে টাকা দেওয়াটা জাকাত। জাকাত কোন দান নয়, এই কথাটা আমরা মুখে বলি ঠিকই কিন্তু কাজের সময় ঠিকই জাকাতকে খয়রাতের কাতারে নামিয়ে নিয়ে আসি।

জাকাতের মৌসুমে বড় করে সাইন বোর্ড দেখা যায় - “এখানে জাকাতের কাপড় পাওয়া যায়” ।

জাকাতের কাপড় কি জিনিস? এটা হল সবচেয়ে নীম্নমানের কাপড়। অর্থাৎ খয়রাত দেবার কাপড়। জাকাত মানে হল - সবাইকে এমন খয়রাতি কাপড় দিতে হবে, নইলে ভিক্ষের মতন ৫০-১০০ টাকা ধরিয়ে দিতে হবে। ব্যাস হয়ে গেল জাকাত। আমাদের জাকাত দেবার পদ্ধতিটি আসলে একটি মৌসুমী ভিক্ষা ছাড়া আর কিছুই না।

তাহলে জাকাতের গঠনমুলক পদ্ধতিটি কেমন? আগেই বলেছি জাকাতের উদ্দেশ্য হল ধনী-গরীবের ব্যাবধান কমানো। ধরুন, আপনার জাকাত হয়েছে ১০,০০০ টাকা। আপনি এই টাকা দিয়ে কাপড় কিনে বা নগদ অর্থ দিয়ে ১০০ জন গরীবকে জাকাত দিচ্ছেন। অর্থাৎ প্রত্যেক গরীব ১০০ টাকা করে পেল। এভাবে ১০০ জনকে জাকাত না দিয়ে - মাত্র এক জনকে সব টাকা দিন।

আপনার এলাকাতে খুজে দেখুন। আপনি চেনেন এমন কোন গরীব লোক, যে পরহেজগার ও সৎ চরিত্রের। যাকে মোটামুটি সবাই ভালো লোক বলে জানে। তেমন কাউকে আপনার জাকাতের সব টাকা দিয়ে দিন যেন সে ওই টাকা কোন ব্যাবসা বা গঠনমুলক কাজে লাগাতে পারে। দরকার হলে ১০ জন প্রতিবেশী একত্রে হয়ে সবার জাকাতের টাকা জড়ো করে, কয়েক লক্ষ টাকা ওই লোকটিকে দিন। তাকে এমন ব্যবস্থা করে দিন, যেন পরের বছর সে নিজেই জাকাত দিতে পারে। আপনার মহল্লাতে যদি এভাবে জাকাত দেবার পদ্ধতি চালু থাকে তবে মাত্র ৭ বছরেই এলাকাতে ধনীর সংখা দ্বিগুন হয়ে যাবে। কিভাব?

যদি আপনার এলাকাতে ১০০ জন জাকাত দিতে পারেন তবে হিসাবটা নীচের মতন হতে পারে

বছর ১ - জাকাত দিচ্ছে ১০০ জন। নিচ্ছে ১০ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১১০।

বছর ২ - জাকাত দিচ্ছে ১১০ জন। নিচ্ছে ১১ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১২১ ।

বছর ৩ - জাকাত দিচ্ছে ১২১ জন। নিচ্ছে ১২ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১৩৩

বছর ৪ - জাকাত দিচ্ছে ১৩৩ জন। নিচ্ছে ১৩ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১৪৬

বছর ৫ - জাকাত দিচ্ছে ১৪৬ জন। নিচ্ছে ১৪ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১৬০

বছর ৬ - জাকাত দিচ্ছে ১৬০ জন। নিচ্ছে ১৬ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১৭৬

বছর ৭ - জাকাত দিচ্ছে ১৭৬ জন। নিচ্ছে ১৭ জন ] এখন জাকাত দেবার মতন মোট লোক ১৯৩ ।

এখন জাকাত দিতে পারে ১০০ জন । ৭ বছর পরে পারবে ১৯৩ জন - প্রায় দ্বিগুন ।

কেবলমাত্র এভাবে জাকাত দিলেই আমরা ধনী-গরীবের ব্যাবধান কমাতে পারব। ১৫ - ২০ বছর পরে এলাকাতে আর কোন গরীবই থাকবে না। আর খয়রাতি পদ্ধতিতে জাকাত দিলে গরীব সব সময় গরীবই থাকবে।

অভ্যাস ছাড়া আরো একটি কারনে এই কাজটা করতে পারি না। সেটা হল অহঙ্কার। অমুক ভালো মানুষ হলেও, আজকে ঝাড়ুদারের কাজ করে। সবাই তাকে জাকাত দিয়ে ধনী বানিয়ে দিলে তো কাল থেকে সে আমাদের কাতার চলে আসবে । এটা আমরা মেনে নিতে পারিনা। ওদিকে গলির মোড়ের গরীব বখাটে ছেলেটি অবৈধ উপায়ে ধনী হয়ে আমাদের মাঝে আসলে আমরা তাকে ঠিকই মেনে নেই।

এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়।

এই পদ্ধতিতে তো অল্প কিছু লোককে আমরা ধনী বানাচ্ছি ঠিকই কিন্তু অনেক গরীব লোককে তো বঞ্চিত করছি। তাদের কি হবে?

- তাদেরকে কি দিতেন বলে ধারনা করেছিলেন? ২০০ টাকা? একটা গামছার মতন দেখতে শাড়ী? হ্যা, এগুলোকে দান খয়রাত বলে। এই দানের জন্য জাকাতের টাকায় হাত দিতে হবে না। সাধ্য মতন কয়েকজনকে দান খয়রাত করুন। একবারে নয়, অল্প অল্প করে সারা বছর করুন। যা পারেন। তাছাড়া যেই লোকটিকে আজ গামছার মতন শাড়ীটি না দিয়ে বঞ্চিত করছেন, - সেই লোকটিকেই আবার ৩-৪ বছর পরে বড় পরিমানে জাকাত দিয়ে তার জীবনটাই পালটে দিচ্ছেন।

আরো একটি প্রশ্ন থাকতে পারে

জাকাতের এমন আজগুবি পদ্ধতি তো এই প্রথম শুনলাম। ইসলামে এমন পদ্ধতি আছে নাকি?

- এজন্য আমি আগেই সুদ ও জাকাতের পার্থক্য বলেছি। জাকাতের উদ্দেশ্য বলেছি। জাকাতের উদ্দেশ্য হল ধনী- গরীবের ব্যাবধান কমানো। ইসলামে এই পদ্ধতির কথা বলা নেই ঠিকই। কিন্তু ইসলামে যা আছে সেটা এমনই। ইসলামিক রাস্ট্রে, রাস্ট্রিয়ভাবে জাকাত গ্রহন ও বন্টন হয়। রাস্ট্র সেই টাকা দিয়ে শাড়ি ও লুঙ্গি কেনে না, দারিদ্র বিমোচনের পদক্ষেপ নেয়। রাসুল (সা) আমলেও তেমনই হোত।  ধনী গরীবের পার্থক্য ঘোচাতে হলে এই পদ্ধতির বিকল্প নেই।
দেশের সবাই যদি ঠিক মতন জাকাত দিত এবং উপরে বর্নীত পদ্ধতিতে দিত তাহলে ২০ বছরেই দেশ দারিদ্র মুক্ত হয়ে যেত। এটা আসলে একটা স্বপ্নের মতন। এর সঠিক প্রয়োগ এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও গনসচেতনতা। আমাদের দেশে এর বাস্তবায়ন আসলে কখনোই সম্ভব নয়।

Comments

  1. সুন্দর লিখেছেন ভাই। কিন্তু আপনার ''জাকাতের এমন আজগুবি পদ্ধতি তো এই প্রথম শুনলাম। ইসলামে এমন পদ্ধতি আছে নাকি? ইসলামে এই পদ্ধতির কথা বলা নেই ঠিকই। কিন্তু ধনী গরীবের পার্থক্য ঘোচাতে হলে এই পদ্ধতির বিকল্প নেই। তাছাড়া এই পদ্ধতি ইসলামের বিপক্ষে যায় না।'' একথাগুলো কিন্তু পরস্পরবিরোধী হয়ে গেলো। একথা ইসলামবিরোধীও হয়ে গেলো? ইসলামে সরকারীভাবে যাকাত আদায় এবং বিতরণের এমন পদ্ধতি ছিলো; সরকারী যাকাত আদায়কারীদের এবং ভোগকারীদের খাত অনুযায়ী তাদের মাঝে যাকাত বিতরণ করার ফলেই না আরবে আর গরীব খ্যজে পাওয়াই ভার হয়ে গিয়েছিলো?

    যাকাত থাকবে আর যাকাত আদায় ও বিতরণের বিধান থাকবেনা--এটা কী বললেন আর ইসলাম তবে পরিপূর্ণ বিধান হয় কেমনে?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি ওই অংশটুকু বদলে দিয়েছি।

      Delete

Post a Comment