যেভাবে আমরা মাছি মারা কেরানী তৈরি করি



দেশে বিদেশে বিভিন্ন জাতীর মানুষ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।  সব দিক থেকে বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায় যে বাঙ্গালীর মতন এমন মেধাবী খুব কম জাতিই আছে।  এমন মেধা থাকার পরেও কিন্তু আমরা বিশ্ব দরবারে সেরা হিসাবে পরিচিত হতে পারিনি।   এর কারন হল আমরা এই মেধাকে ভালো কাজে লাগাই না।  আমাদের মেধা দেখা যায় অসত কজে।  এছাড়া আমাদের রয়েছে একতার অভাব।  কোন বিষয়ে এমরা একমত হতে পারি না।  তাই, গুনি কিছু লোকের ভালো কাজ সমর্থনের অভাবে মাঠে মারা যায়। 

সম্প্রতি একটি লঞ্চডুবি হল, যেটা পরে আর পাওয়া যায়নি।  অনেক হতভাগ্য যাত্রীর লাশ মেলেনি।  কাজেই তাদের আপনজনেরা কেউ জানত না যে লোকটি বেচে আছে নাকি মারা গেছে।  আপন জনের শোকে মানুষ দিশেহারা।  এমন সময়ে অনেকে অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন পান।  -- আপনার নাম কি অমুক?  হ্য, আপনার আত্মীয়কে পাওয়া গেছে।  সে অমুক হাসপাতালে চিকিতসার জন্য আছেন।  অবস্থা গুরুতর।  এখনি এই নাম্বারে বিকাশ এর মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা পাঠান।  দিশেহারা লোকটি হয়ত চিন্তা না করেই টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।  পরে দেখা গেল যে সেটা একটা প্রতারনা।

হাজার বছরের বিশ্বের ইতিহাস ঘেটে দেখুন।  সারা দুনিয়ার বিভিন্ন  সেরা (!) প্রতারকের জীবনী পড়ে দেখুন।  এমন অভিনব প্রতারনা কোথাও পাবেন না।   একটি দুর্ঘটনায় নিখোজ লোকের আত্মীয়কে একটি ভুয়া খবর দিয়ে যে টাকা নেওয়া যায় – এমন অদ্ভুত আইডিয়া আর কোন জাতীর মাথা থেকে আসবে বলে আমার মনে হয়না।  আপনারা এই ধরনে আরো অনেক অভিনব প্রতারনার জানেন।   এমন মেধাবী প্রতারকেরা যদি সঠিক শিক্ষা পেত, বা তার মেধাকে সঠিক কাজে লাগাতে পারত তাহলে অবশ্যই এমন কিছু করতে পারত যাতে দেশের মুখ উজ্জ্বল হয়।   অথচ খোজ নিয়ে দেখুন সেই মেধাবী প্রতারক হয়ত নেসায় আশক্ত। 

যারা শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে তাদের মধ্যে অধ্যাবসায়ী বেশী, মেধাবী কম।  শিক্ষিতদের মধ্যে যারা মেধাবী আছে, তারাও তাদের মেধাকে পুর্নাঙ্গ কাজে লাগাতে পারছে না।  প্রথমত শিক্ষা ব্যাবস্থার ত্রুটি মেধাকে নস্ট করে দিচ্ছে।   দ্বিতীয়ত, যাও একটু মেধা অবশিস্ট থাকে , সেটাও ত্রুটিপুর্ন  কর্মজ়ীবনে এসে আরো নস্ট হয়ে যায়।  শেষে পড়ে থাকে কর্তার আদেশ পালন করে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করে যাওয়া এক শিক্ষিত কেরানী,।যার মেধা না হলেও চলে।  যেটা বলছি, সেটা মেনে নিতে আমার নিজেরই কস্ট হয়।  কিন্তু এটাই বাস্তব। 

টেন্ডার বা দরপত্র জিনিসট সবাই চিনেনে।  সাধারনত সরকারী বা বড় কোন প্রতিস্টান কোন একটি কাজ করানোর জন্য আগ্রহী অন্য কোন ব্যাক্তি বা প্রতিস্টানকে আহবান করে।  মনে করি, একটি সরকারী প্রতিস্টহান, নতুন একটি ভবন বানানোর জন্য আগ্রহী ঠিকাদারদের কাছ থেকে দরপত্র আহবান করল।  এই আহবান এর দলিল পত্র, একটি প্যাকেজ আকারে থাকে, যাকে চলতি ভাষায় “শিডিউল” বলা হয়।  এই শিডিউলে কয়েকটি বই ও আনুসাঙ্গিক আরো কাজগ পত্র থাকে।  এতে বিস্তারিত আলোচনা থাকে, ভবনটি কেমন হবে, এতে কি কি থাকবে ইত্যাদি।  এর পরে ওই ঠিকাদারগন যথাযত নিয়ম পালন করে দরপত্র জমা দেয়।  এদের মধ্যে থেকে একজনকে মনোনীত করে তাকে কাজটি দেওয়া হয়। 

শিডিউলের যে প্যাকেজ, যাতে প্রকল্পটির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য থাকে, সেটা কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ইংরেজীতে হয়।   এই শিডিউল কি কেউ পড়ে দেখেছেন?  এগুলো সেই মান্দাতার আমলের ইংরেজীতে লেখা।  নতুন প্রজন্মের ইংরেজী শেখা তরুনেরা এটা পরে অনেকেই বুঝবে না।  সেই ১৯৬৪ সালের, আর ২০১৪ সালের শিডিউলের ভাষা একই।  সম্ভাবত, বাংলাদেশে কখনোই, নতুন করে এমন একটা শিডিউল কখনো বানানো হয়নি।  ওই আগের লেখাটাই একটু কাট, ছাট করে কপি  করে কাজে লাগানো হয়েছে, হচ্ছে।

দু এক বছর আগের ঘটনা।  আমার মামা, (ঠিকাদার) এমনই কাজগপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলেন।   আমাকে দেখে, ওখান থেকে একটি বই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।   ইংজীতে লেখা।  হয়ত  মনে করেছিলেন , ভাগিনা বিদেশ থেকে এসেছে,  ইংরেজ খুব ভালো বুঝবে। ওদিকে, আমি দু এক পাতা পড়ে আসলে তেমন ভালো বুঝতে পারছিলাম না।   কিন্তু একটি মজার জিনিস দেখতে পেলাম।  প্রতিটি প্যারাতে, এক একটি পয়েন্ট বলা আছে, আর শেষে লেখা আছে “See Instruction book for details”  অন্তত  ২৫ বার এই লেখাটা আমি পেয়েছি।  আমি মনে করলাম, Instruction book  দেখলে হয়ত ভালো বুঝতে পারব।   খুজতে থাকলাম সেই Instruction book ।   আমাকে খুজতে দেখে তিনি বললেন, কি খোজো?  আমি বললাম Instruction book ।   তিনি বললেন ওইটাই তো Instruction book ।   অর্থা আমার হাতের বইটিই  Instruction book ।   এবার অবস্থা বুঝুন – Instruction book বইয়ের মধ্যেই ২৫ যায়গায় লেখা আছে - Instruction book  দেখুন।   অর্থা এই বইটি যারা বানিয়েছে, তারা জানেই না, কি বানাচ্ছে আর বইয়ের ভেতরে কি লিখছে।  অন্য কোন বই থেকে কপি করে বসিয়ে দিয়েছে।  সেই সাথে ওই বাক্যটিও বার বার এসে গেছে।  বইটি বানানোর পরে একবার পড়েও দেখেনি।  মাছি মারা কেরানী তো সবাই চিনেন। একজন কেরানীকে,  একটি দলিল কপি করতে বলা হয়েছে।  বহু পুরাতন, ওই মুল দলিলের একটি পাতায় একটা মরা মাছি লেপ্টে ছিল।   কেরানীও নতুন দলিলের ওই পাতাই একটা মাছি মেরে লেপ্টে দিলেন।   এটাই হল মাছি মারা কেরানী।   যেটা করতে বলা হয়েছে সেটা না জেনে , না বুঝে করে।

এখন কথা হচ্ছে একজন কেরানী কেন এইভাবে কাজ করে।   না বুঝে কাজ করার দরকার কি?  তাকে মাছি মারতে হয় কেন? এর কয়েকটা কারন আছে।

শিক্ষা ব্যাবস্থাঃ এর একবার এক শিক্ষক বন্ধুর বাসায় দেখেছিলাম সে ছাত্রদের পরীক্ষার খাতা দেখছে।  এক ছাত্রের খাতা আমাকে দেখালো।  সে একটি প্রশ্নের উত্তর খুব সুন্দরভাবে লিখছে তার পরেও শিক্ষক তাকে শুন্য দিল।  অবাক হয়ে কারন জিজ্ঞেস করলাম।  সে দেখালো, ওই লেখাতে কমপক্ষে দশবার একটি চিত্রের বর্ননা দেওয়া আছে “দুই নম্বর চিত্র দেখ”।  অথচ কোথাও ওই চিত্রটি নেই।  তার মানে, সে নকল করেছে, অথবা অন্য কারোর খাতা দেখে লিখেছে।  কি লিখেছে সেটা নিজেই জানে না।  জানলে, “২ নম্বর চিত্র দেখ” কথাটা লিখতে গেলে এই চিন্তা মাথায় আসত, চিত্রটা তো কোথাও নেই।  ওই প্রশ্নের জন্য শুন্য পেলেও ছাত্রটি কিন্তু পরীক্ষাতে পাশ করেছে।  একদিন এভাবেই ডিগ্রীধারী হবে।  না জেনে ও না বুঝে লেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করবে অনেক বছর ধরে।  এ তো গেল নকল করা ছাত্রের কথা।   ভালো ছাত্ররা, বাজারের বিখ্যাত  গাইড পড়ে পরীক্ষা দেয়।  গরু রচনা আর বাবার কাছে টাকা চেয়ে পত্র, এই সামান্য জিনিসটিও মুখস্ত করতে হয়।   পরীক্ষায় লেখা “বাবার কাছে টাকা চেয়ে পত্র”  লাখো ছাত্রের একই হয়।  কারন সবাই একই বই মুখস্ত করেছে।  এরা যদি কোন কেরানী হয়, তাহলে সে মাছি মারা ছাড়া আর কি করবে ?

অযোগ্য লোকঃ  সবাই নয়, কিন্তু অনেকেই যোগ্যতা না থাকার পরেও বিভিন্ন কায়দায় চাকরী পায়।  চাচা, মামা ইত্যাদি ছাড়াও আরেকটা জোর আছে, সেটা হল রাজনৈতিক জোর।  এই জোরে, যোগ্য লোককে পেছনে ফেলে একজন অযোগ্য লোক  পদোন্নতি পায়।   এর পরে তার পদবীর প্রভাব খাটিয়ে অনেক অযোগ্য লোককে চাকরী দেয়।  এভাবেই মাছি মারা কেরানীতে একটা অফিস ভরে যায়।  যে কয়েকজন যোগ্য লোক আছে তারা বিভিন্ন চাপে পরে যথাযত পদবী পায় না।  পেলেও, তারা তাদের মেধার সঠিক ব্যাবহার করতে পারে না।  কারন মেধাহীন লোকেরাই দলে ভারী। 

ইতিহাসঃ  আমরা দুবার স্বাধীন হয়েছি।  একবার ব্রিটিশের কাছ থেকে একবার পাকিস্তানের কাছ থেকে।  এর পরেও তাদের রেখে যাওয়া পদ্ধতি আমরা ত্যাগ করতে পারিনি।  ব্রিটিশেরা আমাদের চাষীদের দিয়ে নীল চাষ করাতো, আর শিক্ষিতদের দিয়ে করাতো কেরাণীর কাজ।  বড় কর্মকর্তাদের কাজ তারা নিজেরাই করত।  কাজেই মাছি মারা কেরানীই তাদের দরকার ছিল।  মেধাবী লোক তাদের দলে ঢুকে গেলে তাদের জন্য সেটা ছিল হুমকী স্বরুপ।  এজন্য, লেখা পড়ার পদ্ধতি সহ, অন্য সকল পদ্ধতিই তারা তৈরি করেছিল এমন মেধাহীন শিক্ষিত বানানোর জন্য।  এই পদ্ধতি কিন্তু তাদের দেশ ব্রিটেনের পদ্ধতির চেয়ে সম্পুর্ন আলাদা ছিল।  ইংরেজরা চলে যাবার পরে পাকিস্তানও একইভাবে আমাদেরকে কেরানী বানিয়ে রেখেছে।  বড় বড় সব পদে পাকিস্থানীরাই ছিল।  এটা স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলি কারনের মধ্যে একটি।   দেশ স্বাধীন হবার পরেও কিন্তু আমরা সেই পদ্ধতিই ধরে রেখেছি।  মেধাহীন শিক্ষিত বানাচ্ছি ও তাদরকে মাছি মারা কেরানী বানাচ্ছি।

রাজনীতিঃ দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা জনসংখা, দুর্নীতি ইত্যাদীর মতন বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়ছে রাজনীতি।   যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলই চেস্টা করে সারা জীবন ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার।  আমাদের দেশের ইতিহাসে যতবার সরকার বদল হয়েছে, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই, ক্ষমতাশীল ব্যাক্তি বা দলকে, টেনে হিচড়ে গদি থেকে নামাতে হয়েছে।  ভদ্রলোকের মতন, মেয়াদ শেষ হলে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে, এমন উদাহরন বাংলাদেশে খুবই কম।  ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অনেক কিছু করতে হয়, যার একটা হল দলীয়করন।  সরকারী বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন পদে নিজেদের দলের লোককে বসাতে হয়।  সেই লোকটি দলের জন্য কতখানি কাজে দিবে সেটাই হল ঐই পদে বহাল থাকার যোগ্যতা।  লোকটি আসলে কতখানি মেধাবী, কতখানি স, কতখানি কর্মদক্ষ , সেটা কোন ব্যাপার নয়।  এজনই আমরা সব সময়ই দলীয় অযোগ্য লোকের ভীড় পাই।  এসব লোকের অধীনে মাছি মারা কেরানীই থাকে।

বদভ্যাসঃ  এত কিছুর পরেও আমাদের সরকারী অফিসগুলোতে প্রচুর মেধাবী লোক আছে।  কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে, তারা তাদের মেধা ব্যাবহার করতে পারে না।  অনেক বছর আগে টেলিভিশনে “ইত্যাদি” অনুস্টানে  দেখছিলাম,  ঘুষ খাওয়ার বিষয়ে কৌতুক।  একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করছে, আপনি কেন ঘুষ খান?  অনেকে বলছে , ঘুষ মজাদার, অনেকে বলছে ভিটামিন আছে ইত্যাদি।  সব শেষে একজনকে জিজ্ঞেস করছে - আপনি তো ধনী। টাকা পয়সা, গাড়ী বাড়ীর অভাব নেই। আপনি কেন ঘুষ খান?  লোকটি উত্তর দিল – আমি তো এমনি এমনি খাই।  অর্থা বদভ্যাস।  আমাদের অফিসগুলোতেও বদভ্যাসের কারনেই এই মাছি মারা পদ্ধতি চলছে।   অনেকে এর বাইরে কিছু জানে না।  যারা জ়ানে তারা কর্তার ভয়ে কিছু করতে পারে না।   এই লেখার মাঝে  শিডিউলের বই এক কথা বলেছিলাম।   কপি না করে, নিজের মেধায়,  ইংরেজীতে তেমন বই লেখার মতন লোক সারা বাংলাদেশের কোন সরকারী অফিসে নেই?  অবশ্যই আছে, হাজার হাজার আছে।  কিন্তু তারা তাদের মেধা কাজে লাগাতে পারছে না।  তারা নিজেরা নতুন কিছু লিখলে সেটা বড় কর্তারা গ্রহন করবেন না, মেনে নিবেন না।  কারন, সেটা ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করে বড় কর্তাকে গ্রহন করতে হবে (অযথা ঝামেলা)।  তাছাড়া বড় কর্তার জ্ঞানের বহরও প্রশ্নবিদ্ধ হবার আশঙ্কা রয়েছে।  এছাড়াও রয়েছে ঝুকি।  কারন উনারও তো বড় কর্তা রয়েছে।   এত ঝামেলা করার চেয়ে, যেমন আছে তেমন রেখে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।   একই লেখা সবাই কপি করে করে কাজ চালাও , মাছি মারা কেরানী হও,  আর সবশেষে বড় কর্তার সাক্ষর নিয়ে আস।  একই লেখা দেখে বড় কর্তাও চাইলে নিশ্চিন্ত মনে , না পড়েই সাক্ষর করতে পারেন।

শিক্ষাব্যাবস্থা, রাজনীতি, পরিবেশ সবকিছুই আমাদেরকে একই যায়গায় আটকে রেখেছে।  পদ্ধতিটাই এমন হয়ে গেছে যে, মেধা খাটিয়ে কোন কাজ করার সুযোগ নেই।  শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা হয়েছে মেধাহীন কর্মচারী, ওদিকে মেধার সর্বোচ্চ ব্যাবহার করছে অসাধু ব্যাক্তিরা।  শিক্ষিত, কর্মচারী সমাজে নিজের মেধা খাটাতে না পারলে দেশ ও জাতীকে সামনে এগুতে পারবে না । এর জন্য সব কিছু ঢেলে সাজানোর দরকার। সবচেয়ে প্রথমে দরকার আমাদের বোধদয়।        

Comments