ইসলামে জন্ম নিয়োন্ত্রন


জন্ম নিয়োন্ত্রন ইসলামে ঢালাওভাবে জায়েজ নয়, বিশেষ কারনে জায়েজ। আমাদের আশেপাশের তো দেখা যায়, ইসলামিক ব্যাক্তি সহ সবারই ২-৩ জন সন্তান আছে। এদের সবারই কি ঐ বিশেষ সমস্যাগুলি আছে? দেশের সব লোকের তো একসাথে ওই সমস্যাগুলো থাকতে পারে না। এটা দিবালোকের মতন সত্য, মানুষ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে পরিবার ছোট রাখার জন্যই জন্ম নিয়োন্ত্রন করে। বিশেষ সমস্যা বা কারনগুলি শুধুমাত্র বিশেষ ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। সারা দেশের লোক পরিবার ছোট রাখতে জন্ম নিয়োন্ত্রন করে । তাদের আর কোন বিশেষ কারন নেই।


অর্থাৎ- সেই প্রশ্ন গুলো কিন্তু থেকেই গেল।

- ইসলামে জায়েজ নয় এমন কাজ (জন্ম নিয়োন্ত্রোন) করে আমরা কি পাপ করছি?

- এই পাপ করা বাদ দিলে তো আমার ঘরে ১০-১২ জন ছেলে মেয়েতে ভরে যাবে। আমি এত বড় সংসার কিভাবে চালাব?

- জন্ম নিয়োন্ত্রনে বাধা দিয়ে আমার সংসার বড় বানিয়ে দিয়ে ইসলাম আমার জীবন সহজ করছে নাকি কঠিন করছে?

আসুন, প্রশ্নগুলোর উত্তর খুজে দেখি। জন্ম নিয়োন্ত্রন করাটা তো অনেক পরে, “জন্ম নিয়োন্ত্রন” কথাটাই অনইসলামিক ও অবাস্তব। কেউ কি কোনদিন “মৃত্যু নিয়োন্ত্রন” বলে কোন কথা শুনেছেন? জন্ম ও মৃত্যু দেবার মালিক আল্লাহ, এর কোন নিয়োন্ত্রন হয় না। একজনের যখন জন্মানোর কথা তখন জন্মাবে, যখন মরার কথা তখন মরবে। এর আবার নিয়োন্ত্রন কি?

জন্ম ও মৃত্যু এই দুটি হল দুনিয়াতে প্রবেশ ও প্রস্থান। একটি ৫ বছরের শিশু যখন প্রশ্ন করে – বাচ্চাটি কোথা থেকে এল? তখন তাকে কিন্তু আমরা আসল কথাটি না বলে অন্য কিছু বলে বুঝ দিয়ে রাখি। অনেকে এও বলে যে হাসপাতালে বাচ্চা কিনতে পাওয়া যায়। কারন, বাচ্চা কিভাবে হয় , সেই প্রক্রিয়াটি ৫ বছরের শিশুকে বললে সে বুঝতেই পারবে না। ওই প্রক্রিয়া বোঝার মতন ক্ষমতাই শিশুটির নেই। সৃস্টির বিশাল রহস্যের ব্যাপারে আমাদের জ্ঞানও ওই ছোট শিশুটির মতন। কিভাবে একজন মানুষকে দুনিয়াতে পাঠানো হয় সেটা বোঝার মতন ক্ষমতা আমাদের নেই। শিশুটি যেমন জানে যে হাসপাতালে বাচ্চা কিনতে পাওয়া যায়। আমরাও তেমন জানি যে নারী-পুরুষের মিলনে বাচ্চা জন্ম হয়। আমরা জানি, কয়েক ফোটা পানি থেকে একজন পরিপুর্ন মানব শিশু তৈরি হয়। আসলে এর পেছনে কি জটিল প্রক্রিয়া আছে, কি বিশাল সৃস্টি রহস্য আছে, সেটা আমরা জানিই না। সেটা জানলে আমরা “জন্ম নিয়োন্ত্রন” কথাটাই বলতাম না। জন্ম নিয়োন্ত্রন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা এই নিয়োন্ত্রন করার চেস্টা করি মাত্র। কত মানুষ এত চেস্টা করেও একটি সন্তান লাভ করতে পারছে না। আবার কত মানুষ ইচ্ছা না থাকলেও সন্তান লাভ করছে। তাছাড়া, জন্ম নিয়োন্ত্রনের সামগ্রী সব সময় কাজ করে না। জন্ম বন্ধ করার একমাত্র সম্পুর্ন কার্যকর পদ্ধতি হল – অস্ত্রপচার করে বন্ধা হয়ে যাওয়া। এটা আসলে ইচ্ছে করে প্রতিবন্ধী হয়ে যাবার মতন একটা ব্যাপার। এটা কোন নিয়োন্ত্রন নয়। এটা হল ধংশ করা।

বোঝা গেল যে জন্ম ও মৃত্যু নিয়োন্ত্রন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা এর চেস্টা করি মাত্র। হ্যা, এই চেস্টা করাটা ইসলামে হারাম। জন্ম বা দুনিয়াতে পাঠানো ব্যাপারে ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর কাছে। সেই জন্মকে নিয়োন্ত্রন করার চেস্টা করার অর্থ হল আল্লাহর সাথে পাল্লা দেওয়া (নাউজুবিল্লাহ)।

এই সামান্য ব্যাপারটি কোরআন ও হাদিস নিয়ে রিসার্চ করার আগেই বোঝা যায়। এক কথায় – জন্ম নিয়োন্ত্রন হারাম। একটি হারাম কাজ প্রতিকুল পরিবেশে বা বাধ্য হয়ে করার অনুমতি থাকে। উদাহরন স্বরূপ- কোন অসুস্থ ব্যাক্তির রোগ মুক্তির জন্য যদি কোন অভিজ্ঞ ডাক্তার এমন কোন ওষুধ দেয় যাতে হারাম কিছু (যেমন মদ, হারাম পশুর চর্বি) মিশ্রিত আছে এবং সেটাই যদি একমাত্র চিকিতসা হয় তাহলে সেই ব্যাক্তির জন্য সেটা খাওয়া যায়েজ। তেমনি বিভিন্ন প্রতিকুলতায় বা বাধ্য হয়ে জন্ম নিয়োন্ত্রনের চেস্টা করাটাও গ্রহনযোগ্য। কোন কোন পরিস্থিতিতে এমন করা যায়েজ সেটার একটা তালিকা আবু সাইফ ভাই দিয়েছেন। তালিকাটা আরো দীর্ঘ হতে পারে। কিন্তু আমরা সেসব খুটিনাটি আলোচনায় না গিয়ে আমাদের মুল সমস্যায় ফিরে আসি।

এটা স্পস্ট যে এই হারাম জন্ম নিয়োন্ত্রন কোন বিশেষ কারন ছাড়াই আমাদের দেশে ঢালাওভাবে করা হচ্ছে। যার কাছে পরামর্শের জন্য যাবেন , সে বলবে জন্ম নিয়োন্ত্রন হারাম। অথচ নিজেই সেটা করছে। আর যে ইসলামের নিয়ম মানছে, জন্ম নিয়োন্ত্রন করছে না, তার বড় সংসারের অভাব আর দুর্দশাও সবার চোখে পড়ে। মানুষ তাহলে কি করবে? ইসলামের নিষেধ মেনে দুর্দশা ঘাড়ে নিবে নাকি ইসলামের নিষেধ অমান্য করে সুখী পরিবার গড়বে? এটাই আমাদের মুল সমস্যা। জন্ম নিয়োন্ত্রন নিয়ে যত প্রশ্ন ওঠে তার মুল কারনও এটি।

আল্লাহ দুনিয়া বানিয়েছেন। সেই দুনিয়াতে মানুষকে পাঠিয়েছেন। দুনিয়াতে মানুষ কি অনেক বেড়ে গেছে? এক গবেষনায় বেরিয়েছে যে আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের সমান সাইজের একটি ৪তলা দালান বানাতে পারলে , সারা দুনিয়ার মানুষকে ওই দালানে রাখা যাবে। টেক্সাস এর আকার বাংলাদেশের প্রায় ৪গুন। অর্থাৎ, ৪টি বাংলাদেশে সমান সাইজের ৪তলা দালানের ভেতরে সারা দুনিয়ার মানুষ রাখা যাবে। বাকী দুনিয়া খালি পড়ে থাকবে। এত বড় দালান বানানো সম্ভব নয়। তুলনা করার জন্যই বলা। এই তুলনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে দুনিয়ার জনসংখা আসলে মোটেই বেশী নয়। জনসংখা বেশী মনে হয় কারন আমরা সমানভাবে সব যায়গায় থাকি না। কোন ছোট যায়গায় কোটি লোকের বসবাস, আবার বড় যায়গায় কয়েক হাজার লোক থাকে। আল্লাহ দুনিয়া বানিয়ে, এখানে মানুষকে পাঠিয়েছেন। মানুষ সেই দুনিয়াকে ভাগ করে দেশ বানিয়েছে। বানিয়াছে সীমানা। এক দেশ হতে সহজে যাওয়া যায় না। বাংলাদেশে ১৫ কোটি লোকের বসবাস, ওদিকে বাংলাদেশের ৫০ গুন বড় দেশে অস্ট্রেলিয়াতে লোকসংখা মাত্র ২ কোটি। মানুষ চাইলেও সমানভাবে ছড়িয়ে ছটিয়ে থাকতে পারছে না। এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া কঠিন। আরো কঠিন সেখানে স্থায়ীভাবে থাকা। বরিশাল থেকে যেভাবে সহজে লঞ্চে উঠে ঢাকায় যাওয়া যায়, সেভাবে অন্য কোন দেশে সহজে যাওয়া গেলে জনসংখার সমস্যা থাকত না। হ্যা, রিজিকের মালিক আল্লাহ। কিন্তু সেই রিজিক তিনি সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে রেখেছেন। আমাদের সমাজে যেমন অল্প কিছু মানুষ প্রচুর সম্পদ দখল করে বসে ক্ষমতাবান হয়েছে । ঠিক সেভাবেই বিশ্বের অনেক দেশ এভাবে ক্ষমতাবান হয়েছে বড় যায়গা দখল করে।

মোট কথা, আল্লাহ আমাদেরকে এই গোটা দুনিয়াতে থাকতে দিয়েছেন । কিন্তু আমরা বন্দি হয়ে আছে ছোট এক দেশে। আমাদের জনসংখা বাড়বে আর আমরা এই দেশে বন্দি হয়ে থাকব। আমরা সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে থাকতে পারলে পরিবার ছোট করার চিন্তাই মাথায় আসত না। বাংলাদেশে ২টি সন্তান যথেস্ট। চীনে একটির বেশী সন্তান হলে জরিমানা। ওদিকে পশ্চিমা দেশগুলোতে সন্তানের জন্য বিভিন্ন ভাতা দিয়ে মানুষকে উতসাহিত করে বেশি সন্তান উতপাদন করতে। আমি নিজে এমন অনেককে দেখেছি যার ৪-৫ টি বাচ্চা রয়েছে। বাচ্চাদের ভাতাতেই তার সংসার চলে যায়, নিজেকে কিছু করতে হয় না। আমাদের অর্থ সম্পদ সঠিক ভাবে বন্টন হয় না। যায়গা সঠিক ভাবে বন্টন হয় না। কাজেই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বড় সংসার চালানো যায় না। আমাদের হাত পা বাধা। আমাদের পরিবার ছোট করার চেস্টা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

ইসলামের নিয়ম কানুন বানানো হয়েছে ইসলামিক সমাজ, ইসলামিক দেশ তথা ইসলামিক দুনিয়ার জন্য। চোরের হাত কেটে দেওয়াটা ইসলামের নিয়ম। বাংলাদেশে কিন্তু এই নিয়ম চালানোর উপায় নেই। কারন অনেক মানুষের দারিদ্রতা এত বেশী যে বাধ্য হয়ে চুরি করতে হয়। ইসলামিক নীতিমালা সঠিকভাবে পালন করে যে দেশে, সেই দেশে কাউকে চুরি করতে হবে না। এজন্যই, যে চুরি করে তার এত বড় শাস্তি। ইসলামিক নীতিমালা পালন করা দুনিয়াতেও কাউকে পরিবার ছোট করার চিন্তা করতে হবে না। কাউকে জন্ম নিয়োন্ত্রন করতে হবে না। আমারা এমন নিয়োন্ত্রন করি কারন আমরা না পারছি দুনিয়াতে ছড়িয়ে যেতে, না পারছি দুনিয়াকে ইসলামিক বানাতে। তাই বাধ্য হয়ে , জন্ম নিয়োন্ত্রন করতে হচ্ছে। আমাদের হাত পা বাধা।

উপসংহারঃ জন্ম ও মৃত্যুর মালিক আল্লাহ। মানুষ এটা নিয়োন্ত্রন করতে পারে না, চেস্টা করে মাত্র। এই নিয়োন্ত্রন করার চেস্টা করাটাই হারাম । কিন্তু বিশেষ কারনে এমন করা যায়েজ আছে। আল্লাহর দুনিয়াতে মানুষ ইচ্ছেমতন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে পারলে জনসংখা কোন সমস্যা হোত না। আমারা ১৫ কোটি লোক, একটি ছোট দেশে বন্দি হয়ে আছি। এখানে লাগামহীনভাবে জনসংখা বাড়ালে আমাদের দারিদ্রতাই বাড়বে। আমাদের জন্য জন্ম নিয়োন্ত্রন যায়েজ কিনা সেই ফতোয়া কোন ইসলামী বিশেষজ্ঞ দিতে পারবেন। তবে, আমার মতন বিশেষভাবে অজ্ঞ ব্যাক্তির কথা হল – পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাপে পড়ে, বাধ্য হয়েই আমরা, জন্ম নিয়োন্ত্রন এর মতন হারাম কাজ করছি। এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

Comments