বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যত

আন্দোলন কথাটা শুনলে আমাদের চোখের সামনে প্রতিবাদ, মারামারি, জ্বালানো পোড়ানো ইত্যাদি ভেসে ওঠে। কিন্তু আন্দোলন (movement) কথাটার অর্থ এগুলোর কোনোটাই নয়। একটা নির্দিস্ট লক্ষ্যে বাঁধা পেরিয়ে চলতে থাকাটাই আন্দোলন। সমাজের সবাইকে শিক্ষিত করে তোলাটা হতে পারে সামাজিক আন্দোলন। এর জন্য লাঠি নিয়ে বের হতে হবে না, বরং সবাইকে লেখাপড়া শেখানোর কাজ হাতে নিতে হবে। ইসলামিক আন্দোলন হল তেমনি সবাইকে মুসলমান বানানোর আন্দোলন। এটাকেই আমরা ইসলামিক পরিভাষায় দাওয়াতের কাজ বলে জানি। সবাইকে মুসলমান বানাও। এই চেস্টাটা বিভিন্নভাবে করা যায়। একেক দল এমন চেস্টা একেভাবে করে। কিন্তু মুশকিল হল সেই দল যেভাবে করে ওটাকেই একমাত্র পথ বা মত মনে করে। এজন্য মুসলমানদের মধ্যে রয়েছে এত দলাদলি। কোন দল সমাজ নিয়ে পড়ে আছে, কোন দল পড়ে আছে রাজনীতি নিয়ে। সম্পুর্ন ইসলাম নিয়ে পড়ে আছে এমন দল বাংলাদেশে তো দুরের কথা দুনিয়াতেই বিরল হয়ে গেছে। সবাই পড়ে আছে ইসলামের কোন একটি অংশ নিয়ে।

কোন দেশে ইসলামিক শাসনতন্ত্র প্রতিস্টা করাটা হল ইসলামিক আন্দোলনের একেবারে সর্বশেষ ধাপ। এর আগে সবাইকে মুসলমান বানাতে হবে। কিন্তু আমরা ইসলামিক আন্দোলন বলতে ইসলামিক শাসনতন্ত্র প্রতিস্টা করাটাই বুঝি। ভারতে শতকরা ৮০ ভাগ হিন্দু। ওখানে যদি কোন ইসলামিক দল ইসলামিক শাশন প্রতিস্টা করতে চায় তবে সেটা মোটেও ফলপ্রসু নয়। কারন প্রথমে দরকার মুসলমান এর পরে আসবে ইসলামিক রাষ্ট্র। দুঃখজনক হলেও বাংলাদেশের অবস্থা প্রায় একই রকম। আমাদের দেশে ৯০% মুসলমান হয়েছে সত্য, তবে সেটা নামে মুসলমান। আমাদের ভেতরে অর্ধেকের বেশী নামাজ পড়ে না, বড় একটা অংশ বুঝে বা না বুঝে শিরক ও কুফরী করে। এভাবে আসলে প্রচুর মুসলমান ইসলাম থেকে বের হয়ে গিয়েছেন, যাচ্ছেন। যে মুসলমান অমুক বাবার দরবারে গিয়ে মাথা ঠেকায় তার সঙ্গে মুর্তি পুজারীর কোন পার্থক্য নেই। এভাবে হিসাব করলে দেখতে পাবেন যে আমাদের দেশের আসলে সর্বোচ্চ ১৫% লোক পাবেন যারা মুসলমান। তারা ছোট বড় অনেক পাপ করে, কিন্তু এখনও ইসলামের ভেতরে আছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখছি - আমাদের মতন এমন মডার্ন, নামাজ না পড়া, বাবার দরগায় যাওয়া, মুসলমান একমাত্র বাংলাদেশেই এত বেশী পরিমানে পাওয়া যায়। এমন একটা দেশে ইসলামিক শাশন প্রতিস্টা করার আগে প্রয়োজন সবাইকে মুসলমান বানানো।

দেশে ইসলামিক আন্দোলন করছে তাবলিগী জামায়াত। তবে ওদের আন্দোলন খুবই সীমাবদ্ধ ও অসম্পুর্ন। এর বাইরে আন্দোলন করছে ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলো। দেশে সম্ভবত ৩০টিরও বেশী রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ছড়িয়ে পড়েছে ও আলোচিত হয়েছে জানামায়াতে ইসলাম। কিছুটা ত্রুটিপুর্ন হলেও, দেশে ইসলামিক আন্দোলন বলতে গেলে ওরাই করছে। সবাইকে মুসলমান বানানোটা ওদের মুলমন্ত্র নয়। ওদের মুলমন্ত্র হল ক্ষমতা দখল এবং দেশকে ইসলামিক ধাচে পরিচালনা করা। এর ফলে বিভিন্ন আইন কানুনে এমনিতেই দেশের মুসলমানেরা সঠিক মুসলমান হয়ে যাবে। একজন একজন করে সবাইকে মুসলমান বানানোর চেয়ে একসাথে পুরো দেশকে মুসলমান বানানোটাই ওদের উদ্দেশ্য। সঠিক মুসলমান না হবার কারনে, বা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারনার কারনে, বাংলাদেশের মানুষ দেশকে ইসলামিক বানানোর কথা শুনলে ভয় পায়। মনে করে এতে বোধ হয় তাদে স্বাধীনতার ব্যাঘাত ঘটবে। অথচ এখন যে তারা কেমন স্বাধীন আছে সেটা একবারও ভেবে দেখেনা। আর এ কারনেই পিছিয়ে পড়ছে ইসলামিক আন্দোলন। 

ইসলামে রাজনীতি আছে কিনা এমন প্রশ্নও তোলেন কেউ। কেউ আবার আরো এক ধাপ এগিয়ে এটাও বলেন যে ইসলামে গনতন্ত্র আছে। আরে ভাই, জামার হাতা আছে, পাঞ্জাবীরও হাতা আছে । এই যুক্তি দেখিয়ে কেউ যদি বলে পাঞ্জাবীর ভেতরে জামা আছে, তাহলে কেমন হবে? ইসলামিক শাসনতন্ত্র ও গনতন্ত্র এ দুটো সম্পুর্ন ভিন্ন জিনিস। এর একটার ভেতরে আরেকটা থাকে না। আর, ইসলামের রাজনীতি কেমন? এটা ছড়িয়ে পড়া ও টিকে থাকার ও ছড়িয়ে পড়ার রাজনীতি। ক্ষমতা দখল করতে হবে না, সেভাবে টিকে থাকতে পারলে ক্ষমতা এমনিতেই দখল হয়ে যাবে। শুনতে খারাপ লাগলেও এর উদাহরনটা ভাইরাসের সাথে দেওয়া যায়। ভাইরাস মানুষের শরীরে ঢোকে তাকে মেরে ফেলার জন্য নয়। ওই শরীরে সে টিকে থাকে, বংশবিস্তার করে ছড়িয়ে পড়ে। এর পরে ভাইরাস আক্রান্ত মানুষটি এমনিতেই মারা যায়। ঠিক তেমনি ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে পারলেই বড় বড় অপশক্তি এমনিতেই মারা পড়ে। এজন্যই তারা ইসলামকে ভয় পায়। ইসলামে রাজনীতি আছে। হয়ত এটা একমাত্র ধর্ম যাতে রাজনীতি আছে এবং এই কারনেই বিশ্ব জুড়ে ক্ষমতাশীলদের চক্ষুশুল এই ইসলাম।

রাসুল (সা) এর নবুয়তের প্রথম দিকে, কেউ ইসলাম গ্রহন করলে তাঁকে মারধর করা হোত, অত্যাচার করা হোত । এমন কেন হোত? রাসুল (সা) নতুন এক নিয়ম (ধর্ম) নিয়ে হাজির হলেন। যার সেটা পছন্দ হবে সে মানবে, যার পছন্দ হয় না মানবে না। এখানে মারধর করার কি আছে? একজন লোক ইসলাম বিশ্বাস করলে কাফেরদের কি এমন ক্ষতি হয়ে যায়? ওরা মারতো কেন? এই জিনিসটা বুঝতে পারলেই ইসলামের রাজনীতি ও ভাইরাসের ব্যাপারটা বুঝতে পারা যাবে। রাসুল (সা) যখন নবুয়ত পান তখন তার কাছের কিছু লোক ও কিছু নীম্ন গোত্রের লোক ছাড়া তেমন কেউ ইসলাম গ্রহন করেনি। এই লোকগুলোকে মুক্তভাবে ইসলাম পালন করতে দিলে হয়ত ইসলাম ওখানেই সীমাবদ্ধ হয়ে হয়ে যেত। রাসুল (সা) ও তার কয়েকশত অনুসারী ইসলাম পালন করতেন। এর পরে তারা মারা গেলে কয়েক পুরুষের মধ্যেই মানুষ ইসলাম ভুলে যেতো। ইসলাম প্রতিষ্ঠা হোত না। আল্লাহর কুদরতে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়েছে ওই মাইরের কারনেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে , মারলো কেন? 

তখনকার অমুসলিম আরবের একটা শাশনব্যাবস্থা ছিল। সেই ব্যাবস্থাতেই ক্ষমতাশীনেরা দেশ শাশন করত। আরবের নেতারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এক এক করে যদি অনেক লোক রাসুল(সা) এর ধর্মে বিশ্বাস করে তাহলে তো নতুন এক ব্যাবস্থা চালু হবে। সেই ব্যাবস্থাতে রাসুল (সা) নিজেই হবেন নেতা। এভাবে তো আরবের ক্ষমতাশীনেরা ক্ষমতা হারাবে। অমুসলিম নেতারা এই ঝুকি নিতে চায়নি। তাছাড়া, রাজনীতির প্রথম সুত্র হল - ঝুকিমুক্ত থাকা। এজন্যই তারা ইসলামকে অঙ্কুরেই বিনস্ট করতে চেয়েছে। তারা যত অত্যাচার করেছে, তত মুসলিমের দল ভারী হয়েছে। এর পরে নেমেছে যুদ্ধে। এক একটা করে যুদ্ধ করে আর মুসলমানেরা আরো শক্তিশালী হয়। অবশেষে ক্ষমতা ঠিকই দখল করে, রাসুল (সা) ঠিকই আরবের নেতা হন। ইসলামকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে বলেই ইসলাম এত ছড়িয়ে পড়েছে। আজ এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, এবং যেভাবে মুসলমানদের সংখা বাড়ছে তাতে আগামী ৫০ বছরের মধ্যে খৃস্টানকে ছাড়িয়ে এটা বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মে পরিনত হবে। এইজন্যই তো ইহুদী খ্রিস্টানেরা ইসলামের পেছনে লাগে। 

জামায়াতে ইসলাম মানেই ইসলাম নয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইসলামের সবচেয়ে কাছাকাছি আছে তারা। ৩০ বছর আগের দলটির কথা চিন্তা করুন। সেই সময় দেশের বড় দলগুলি জামায়াতে ইসলামকে কোন দল হিসাবেই গন্য করত না। সাধারন লোকেদের কাছেও জামায়াতের তেমন গ্রহনযোগ্যতা ছিল না, কারন ইসলামিক দল ছাড়াই দেশে এমনিতেই ইসলামের অনুকুল পরিবেশ ছিল। ইসলামিক দলের কি দরকার? জামায়াত ছিল একেবারে পেছনের কাতারে। এর পরে পালাক্রমে বড় দুটি দল এর সাথে মিত্রতা করেছে, তাদেরকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে, আবার তাদের কাছেই মার খেয়েছে। এভাবেই দলটি তৃতীয় অবস্থানে চলে এসেছে। জামায়াত যাদের সাথে মিত্রতা করবে, তারাই ক্ষমতায় যাবে এওন একটা পরিস্থিতি ছিল ১৫ বছর আগে। কিন্তু গত ৫ বছরে দলটির উপরে চলেছে নির্যাতন। একটি দল ধংশ করতে যা করা লাগে, তার সবই করা হয়েছে। প্রথম সারির নেতারা ফাসির মঞ্চে, দ্বিতীয় সারির নেতারা রিমান্ডে গিয়ে হয়েছে পঙ্গু, তৃতীয় সারির নেতারা জেলে, চতুর্থ সারির নেতারা পলাতক। এর উপর রয়েছে দলটি নিষিদ্ধ করার আইনি চেস্টা। এর পরেও কিন্তু দলটি চলছে। মজার ব্যাপার, আক্রে ছোট হলেও, ক্ষমতার দিক থেকে জামায়াত এখন দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে বলা যায়। এটা কিন্তু হয়েছে মাত্র দু এক বছর আগে। আরবের নেতাদের সেই উদাহরনের মতন, জামায়াতকে যত দমিয়ে রাখতে চাচ্ছে, ততই এদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া, সন্ত্রাসী নামে বদনাম হয় জামায়াতের ওদিকে প্রত্রিকায় ছবি দেখা যায় অন্য দলের। মন্দির ভাঙ্গায় বদনাম হয় জামায়াতের, ধরা পড়ে অন্য দল। পেট্রোল বোমা হামলার বদনাম হয় জামায়াতের, ধরা পড়ে অন্য দল। জনগন নিরুপায় হতে পারে কিন্তু বোকা নয়। এজন্যই বিভিন্ন কারনে জামায়াতের প্রতি জনগনের সমর্থনও বাড়ছে। 

৩০ বছর আগে দেশে যে পরিস্থিতি ছিল তাতে ইসলামিক আন্দোলনের তেমন কোন প্রয়োজনীয়তা ছিল না, এবং এর ভবিষ্যতও তেমন উজ্জ্বল ছিল না। তবে এখন ইসলামিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। দমন করতে করতে জামায়াতকে সেই সাথে ইসলামিক আন্সোলনকে দেশে শক্তিশালী বানিয়ে দিয়েছে। এমন দমন চলতে চলতে এক সময় জামায়াত থাকুক আর না থাকুক, ইসলামের বিজয় হবে। যেই বিজয় আসত ৭০ বছর পরে সেই বিজয় আসবে ১০-২০ বছরের ভেতরেই। ইসলামের বিজয়কে এমন গতি দেবার জন্য দমনকারীদের প্রতি মুসলমানদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত

Comments