ভাষা আন্দোলনের না জানা কথা


যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, পাঠ্যবইতে নিজেদের দল বা আদর্শের স্বপক্ষের ইতিহাস ঢুকিয়ে দেবার প্রবনতা সবারই কম বেশী আছে। ইতিহাস হল মৃত মানুষের গল্প। কাজেই জীবিত মানুষেরা যেটা লিখে রাখবে সেটাই ইতিহাস। এই লিখে রাখা ইতিহাস, সত্য হোক বা নাই হোক, সেটা প্রতিস্টিত হয় মিডিয়ার গুনে। তবে, ইতিহাস প্রতিস্টা করার সবচেয়ে বড় উপায় হল পাঠ্যবই। যে প্রশ্নের উত্তর লিখে, নম্বর পেয়ে পাশ করা যায়, সেটা ভুল না শুদ্ধ, সম্পুর্ন নাকি অসম্পুর্ন, এই চিন্তা কারো মাথায় আসে না। ওটাই প্রতিস্টিত হয়ে যায়। এটা জানে বলেই, নেতারা পাঠ্যবইতে নিজের পছেন্দের ইতিহাস ঢুকায়। আর আমরাও পরীক্ষায় পাশ করার জন্য, বইতে যা লেখা আছে সেটা দেখে চোখ বুজে মুখস্ত করি। তার অর্থ বোঝার চেস্টা করি না। প্রশ্ন তো করিই না। 

আন্তঃজাতিক ভাবে স্বীকৃত, মাতৃভাষা দিবসে, মহান ভাষা সৈনিকদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, অত্যান্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, আমরা নিজেরা ভাষা আন্দোলনের সম্পুর্ন ইতিহাস জেনে বা বুঝে উঠতে পারিনি। আর সেটা পারিনি বলেই আমরা মাতৃভাষা দিবসে সারা রাত মাইকে বাংলা অথবা হিন্দি গান বাজিয়ে সকালে গিয়ে বিভিন্ন ইট পাথরের স্থাপনার উপরে কোটি টাকার ফুল রেখে আসি। কেউ জানেও না ওই ভাষা শহিদগনের কবর কোথায়, তাদের পরিবার কেমন আছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার যেমন সুযোগ সুবিধা বা অন্তত স্বীকৃতি পায়, সেটাও তারা পায় না। আমরা পাথরে ফুল রেখেই খুশি। 
ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে যেটা আমরা জানি তা হল –  পাকিস্থানের জনৈক নেতা, সম্ভবত জিন্নাহ, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষনা দেন। “উর্দুই হবে একমাত্র রাস্ট্রভাষা”।  বাঙ্গালী, বিশেষ করে ছাত্ররা এর প্রতিবাদ করে। সেই প্রতিবাদ মিছিলে ২১ এ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ সালে, পুলিশের গুলিতে নিহত হন সালাম, বরকত, রফিক সহ আরে অনেকে। এর পরে রাস্ট্রভাষা বাংলা হয়। এর সাথে আরো কিছু আবেগপ্রবন কথাও শোনা যায়। পাকিস্থানীরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। বীর বাঙ্গালী সেটা প্রতিহত করেছে।  
আমাদের জানাটা ভুল নয়, কিন্তু অসম্পুর্ন। আর একারনেই, এখানে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে না। 
- উর্দুকে রাস্ট্রভাষা ঘোষনার আগে, পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা কি ছিল?
- রাস্ট্রভাষা যখন বাংলা হয়ে গেল, তখন কি লাহোর করাচী ইত্যাদি এলাকাতে কি বাংলা চলেছে?
- উর্দুকে রাস্ট্রভাষা বানাতে চাইলে মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয়। তাহলে, উর্দু বাদ দিয়ে বাংলাকে রাস্ট্রভাষা বানাতে চাইকে মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া হয় না কেন? 
- ভারত এতগুলো ভাষা নিয়ে দিব্যি কোন ঝামেলা ছাড়াই টিকে আছে। ওদিকে আমাদের মাত্র দুটি ভাষা নিয়ে দন্দ হল কেন?
আমরা যদি এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুজতাম তাহলে সম্পুর্ন ইতিহাস জানতে পারতাম। যাই হোক, সংক্ষেপে ইতিহাসের ওই অজানা দিকটি বলছি যাতে এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। 
রাস্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে প্রতিবাদ মিছিল - ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২
১৫ই আগস্ট ১৯৪৭ সালে, ইংরেজরদের কাছ থেকে স্বাধীন হয় ভারতবর্ষ। ঠিক তার আগের দিন, ১৪ই আগস্ট, ভারতের দুটি আলাদা অংশ যোগ করে “পাকিস্থান অধিরাজ্য” নামক এর নতুন রাষ্ট্র বানিয়ে দিয়ে যায়। এই পাকিস্থান অধিরাজ্যের পুর্বের অংশটিই বর্তমান বাংলাদেশ। পাকিস্থান কিন্তু সম্পুর্ন স্বাধীন নয়, বরং ইংরেজদের আয়ত্বে, স্বায়ত্ব শাশিত এক দেশ ছিল। 
ইংরেজদের প্রায় দুইশ বছরের শাশনামলে, এই ভারতবর্ষের রাস্ট্রভাষা (Official Language) ইংরেজী ছিল। মানুষ ওটাই বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছিল। এমনকি, ১৯৪৭ এ ইংরেজরা চলে যাবার পরেও ইংরেজী বাদ দিয়ে দেবার উপায় ছিল না, কারন স্বায়ত্বশাশিত ওই দেশ পাকিস্থানের রানী ছিলেন, ব্রিটিনের রানী এলিজাবেথ (১৯৫৬ সাল পর্যন্ত) 
তবুও, ইংরেজদের সরাসরি শাশন না থাকায়, দেশটির ক্ষমতাশীন নেতারা নিজেদের ভাষাকে রাস্ট্রভাষা বানানোর জন্য ততপর হয়ে উঠল। সমগ্র পাকিস্থানে তখন লোকসংখা ছিল প্রায় ৭ কোটি যার মধ্যে সাড়ে চার কোটিই ছিল বাঙ্গালী। অর্থাৎ বাংলা ভাষায় কথা বলার লোক ছিল বেশী। স্বাভাবিক ভাবে, বাংলাই হবে রাস্ট্রভাষা।  কিন্তু সমস্যা হল, রাস্ট্রিয় ক্ষমতায় ও সরকারী উচ্চ পদে যারা বসে ছিল, তারা সবাই উর্দুভাষী। কাজেই ওরা চেয়েছে ওদের ভাষাটি প্রতিষ্ঠা করতে। এর শুরু হয়েছে একেবারে প্রথম থেকেই, ১৯৪৭ সালে। অনেক রাজনীতি হয়েছে এই নিয়ে। বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা নাম দিয়ে বাদ দিতে চেয়েছে, অথচ এর প্রতিবাদ করেছে মুসলিম বাঙ্গালী নেতারাই। বাংলাকে রাস্ট্রভাষা করার প্রথম আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৭ সালেই। আরবী কিংবা উর্দু হরফে বাংলা লেখার উদ্ভট আইডিয়াও দিয়েছে ক্ষমতাশীনেরা। সংসদে, উর্দুই হবে রাস্ট্রভাষা, এমন বিল পাশ হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু বাঙ্গালীর আন্দোলন থেমে থাকেনি। এভাবে বছরে পর বছর বিভিন্ন মিটিং, মিছিল, রাজনীতি, প্রতিরোধ চলেছে। এমনই এক মিছিলে ১৯৫২ সালে ২১এ ফেব্রুয়ারী, শহিদ হয় সালাম, বরকত, রফিক ও আরো অনেকে। এতে আন্দোলন আরো চাঙ্গা হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালে ২৯ এ ফেব্রুয়ারী সংসদে বিল পাশ করে, বাংলাকেও রাস্ট্রভাষার (Second official language) স্বীকৃতি দেওয়া হয়। 
নতুন যা জানা গেল, তা হলঃ
- দাবী মেনে নেবার পরেও, বাংলা কখনোই পাকিস্থানের প্রধান রাস্ট্রভাষা হয়নি। হয়েছিল দ্বিতীয় ভাষা। যেমন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান রাস্ট্রভাষা বাংলা আর দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি। 
- বাংলাকে দ্বিতীয় রাস্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয় অমর ২১ এ ফেব্রুয়ারির, দীর্ঘ ৪ বছর পরে । 
- সালাম, বরকত ওরা শহিদ হওয়াতে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায়নি।  স্বীকৃতি পেয়েছে টানা নয় বছরের আন্দোলনের কারনে। তবে এই আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ত্যাগ স্বীকার করে, জীবন উতসর্গ করেছে ওই শহিদেরা। আর এ কারনেই তারা বরনীয় ও স্মরনীয়।
- মুখের ভাষা কেড়ে নেবার কোন ব্যাপার এখানে নেই। এখানে ব্যাপারটা হল, সন্মান, মর্যাদা ও স্বীকৃতি। দুইশ বছর ধরে ইংরজীকে রাস্ট্রভাষা বানিয়েও ব্রিটিশেরা আমাদের মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে পারেনি। আসলে মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়া যায় না। ঊর্দুভাষী ও বাংলাভাষী উভয়েই নিজের ভাষাকে রাস্ট্রভাষা বানাতে চেয়েছে। তবে, বাঙ্গালীর দাবী ন্যায় সঙ্গত ছিল, কারন তারা সংখায় বেশী। ন্যায়সঙ্গতভাবে, বাংলা প্রথম ভাষা, ও উর্দু দ্বিতীয় ভাষা হবার কথা ছিল। কিন্তু বাঙ্গালীর দাবী মেনে নেবার পরেও, তার উল্টোটি হয়েছে। উর্দুই প্রধান ভাষা থেকে গেছে, কারন ক্ষমতা ছিল উর্দুভাষীদের হাতে।
ইংরেজরা ক্ষমতাবলে ইংরেজীকে প্রধান রাস্ট্রভাষা বানিয়ে রেখেছিল, পাকিস্থানীরা উর্দুকে প্রধান রাস্ট্রভাষা রেখেছিল। আমরা বাংলাকে প্রধান রাস্ট্রভাষা বানানোর সুযোগ পাই ১৯৭১ সালে, যখন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।     
সুত্রঃ Language movement
সুত্রঃ Domination of Pakistan

    
    

Comments

Post a Comment