পুলিশ কারা হয়

প্রায় দেড়শো বছর আগে, ব্রিটিশের নির্বাসন বা জেলখানা ছিল অস্ট্রেলিয়া। বন্দীদের ধরে নিয়ে ওখানে রাখা হোত। এখনও তার ধংশাবশেষ আছে সেখানে। ধীরে ধীরে সাধারন লোক গিয়ে বসতি স্থাপন করের সেখানে। এভাবে কোন দখল করা দ্বীপে বসতি শুরু করারটা ছিল ব্রিটিশদের একটা কায়দা। অনেক দ্বীপেই ওরা এই পদ্ধতিতে বসতি স্থাপন করেছে। প্রথমে কয়েদীদের ওখানে ছেড়ে দেয়। এর পরে ধীরে ধীরে সাধারন লোকেরা সেই দ্বীপে আসতে শুরু করে। আর এভাবেই তারা অস্ট্রেলিয়া দেশটি বানিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া একটি স্বায়ত্ব শাশিত (স্বাধীন নয়) দেশ। ওরা এখনো ব্রিটিশকে কর দেয়। ব্রিটিশের রানী ওদের রানী। ওদের মুদ্রার উপরেও ব্রিটিশ রানীর ছবি থাকে।

অস্ট্রেলীয়ার পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল ওই জেলখানা থেকেই। ১২ জন ভদ্র ব্যবহারকারী আসামীকে নিয়ে গঠন করা হয় অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ বাহিনী। এর পরে ধীরে ধীরে সেই বাহীনিটি আজ শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী। এখন অস্ট্রলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশ বিষয়ক স্নাতক কোর্স আছে। এই কোর্স করেই তবে পুলিশ হওয়া যায়। আরেকটি মজার ব্যাপার হল, পুলিশ হওয়ার জন্য – বয়স ও উচ্চতা কোন ব্যাপার নয়। স্থানীয় তরুণ প্রজন্ম মজা করে এও বলে - স্কুলের সবচেয়ে বোরিং টাইপের ভদ্র ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে পুলিশ হয়। 

যাই হোক, আমার এই লেখাটার বিষয় হল, পুলিশ কারা হয়। আমাদের দেশের পরিবেশে কারা কিভাবে পুলিশ হয় এবং পুলিশ হয়ে তারা কি করে সে সম্পর্কে নতুন করে বলার কিচু নেই । কিভাবে যোগ্য লোককে পেছনে ফেলে অযোগ্য লোক সুযোগ পায়, কিভাবে কোন কোন খাতে কিভাবে বানিজ্য হয় সেটা সবাই জানে। দুর্নীতি চ্যাম্পিয়ন আমাদের এই দেশে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ হচ্ছে পুলিশ। পুলিশের ঘুষ নেওয়াটা আমাদের এমনভাবে সয়ে গেছে যে এখন আর চাইতে হয় না। ঝামেলা মেটাতে চাওয়ার আগেই দিয়ে দেই। উন্নত বিশ্বের পুলিশ ও তার কার্যকলাপ দেখলে কিছুটা বোঝা যায়, পুলিশ আসলে কাদের হওয়া উচিত। আমি স্বচোক্ষে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ দেখেছি। তাই তাদেরটা বলছি। 

ছাত্রাবস্থায় প্রথম যে রেস্টুরেন্ট এ কাজ করি সেই রেস্টুরেন্ট এর মালিক তার গাড়ীটি রাস্তায় পার্ক করে রেখে নিজের রেস্টুরেন্ট এ বাবুর্চীর কাজ করত। তার গাড়িটি সাধারনত একই যায়গায় প্রত্যেক দিন পার্ক করা থাকত। রাস্তার টহল পুলিশ এক সপ্তাহে তিনবার ওই গাড়িতে জরিমানা করেছে। জরিমানার কারন হল, গাড়ির দরজা ঠিকমতন লক করা ছিল না, জানালার কাচ কিছুটা নামানো ছিল, ইত্যাদি। দুইবার ফাইন লিখে কাগজটি গাড়িতে রেখে চলে গেছে। কিন্তু তৃতীয়বার ফাইন লেখার সময় ঘটনাক্রমে ওই গাড়ীর মালিক দুজন পুলিশকে দেখে ফেলেছে। দৌড়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করে দিল। ঝগড়ার বিষয় হল - তোমরা কোন সাহসে একই কারনের জন্য দুই তিনবার ফাইন কর? এক পর্যায়ে লোক্টি পুলিশকে অকথ্য ভাষায় গালি দিল। ওই দুজন পুলিশ নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে চলে গেল। ভাবখানা এমন – এই লোকটি কি পাগল হয়ে গেছে নাকি !!। ফাইনের কাগজ কিন্তু ঠিকই দিয়ে গেছে। ৫-৭ দিন পরে সেই দুজন পুলিশের সঙ্গে আবার লোকটির রাস্তায় দেখা। পুলিশ দুজন তাকে দেখে জিজ্ঞেস করছে – কি কেমন আছ? তোমার রাগ কি কমেছে ?

সিডনী শহরে যারা নতুন আসে, তাদের কাছে পুলিশের গাড়ী ও ট্যক্সি দেখতে একই রকম লাগে। অবশ্য কয়েক মাসে পরে চট করে বুঝে ফেলা যায় কোনটা পুলিশের গাড়ী। আমার এক বন্ধু তেমনিই নতুন এসেছিল সিডনী শহরে। একটা ট্যাক্সি ধীরে ধীরে যাচ্ছে। হাত ইশারা করে থামিয়ে দ্রুত উঠে পড়ল পেছনের সিটে। এর পরে বলল – অমুক যায়গায় চল। পরক্ষনেই চোখে পড়লে গাড়ির সামনে বসা দুজন পুলিশ ও তাদের গাড়ির ভেতরে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। বুঝতে পারল, এটা তো পুলিশের গাড়ী। সরি বলে গাড়ি থেকে নেমে যাচ্ছিল। তখন পুলিশ তাকে থামিয়ে বলল – অসুবিধা নেই, চল তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি। 

ইংরেজী নববর্ষের আগের দিন, ৩১ ডিসেম্বর রাতে সারা শহর জুড়ে উতসবের আমেজ থাকে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবচেয়ে ব্যাস্ত থাকে পুলিশ। যেখানে সেখানে মদ খাওয়া ও মাতলামী করাটা ওই রাতের এক প্রকারে – জনগনের অধিকার বলা যেতে পারে। সবাই মাতাল। এখানে সেখানে মজা করে বেড়াচ্ছে। তবে বেশীরভাগ লোক জড় হয় সিডনী অপেরা হাউজের আশে পাশে যেখানে রাত ৯টা ও রাত ১২ টায় আতশবাজী ফোটানো হয়। এমনি এক দিনে, ওই অপেরা হাউজ ট্রেন স্টেশনে এক মাতালকে দাড় করিয়ে কয়েকজন পুলিশ তার আইডি কার্ড দেখতে চাইল। মাতাল তো মহা বিরক্ত। এতটাই মাতাল যে, পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে পারছে না। অনেক চেস্টা করার পরে রাগে সামনে থাকা পুলিশকে লাথি দিল। এই লাথিটি দিয়ে সে নিজেই বেসামাল হয়ে পড়ে গিয়েছিল। অন্যান্য পুলিশ তাকে দ্রুত শরে ফেলল, নইলে হয়ত পড়ে এগিয়ে তার মাথা ফাটতে পারত। লোকটি মেঝেতে বসে রইল। পুলিশ তার মানিব্যাগের ভেতরে তার আইডি কার্ড দেখে বলল – এট তো কাছেই। এর পরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল। আসলে ওই মাতালের অবস্থা খারাপ দেখে পুলিশ তাকে বাসায় পৌছে দিতে চেয়াছিল। এজন্যই আইডি কার্ড দেখতে চেয়েছে। আইডি কার্ডে ঠিকানা দেখে বুঝেছে, এর বাসা কাছেই। তাই তাকে রেখে চলে গেছে। পুলিশকে গালি দিলে তার বিরুদ্ধে কোন আইনী ব্যাবস্থা নেওয়া যায় না, তবে মারলে তাকে শাস্তি দেওয়া যায়। বিশেষ উতসবের দিনে মাতালকে প্রশ্রয় দেওয়া হলেও সবসময় মাতালকে প্রশ্রয় দেয় না পুলিশ। 

পুলিশের টহল দেবার গাড়িতে সবসময় একটি পুরুষ ও একটি নারী পুলিশ থাকে। কারন কোন নারী অপরাধীকে ধরতে, বা তল্লাশি করতে নারী পুলিশ কাজে লাগবে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ পুলিশটিই গাড়ি চালায়। একবার এক মাতাল রাস্তা দিয়ে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছিল। যাকে দেখে তাকেই গালি দেয়। রাস্তার সবাই লোকটির গালি শুনেও না শোনার ভান করছে। ঘটনাক্রমে স্থানটিও পুলিশ স্টেশনের পেছেন গাড়ীর গ্যারেজের কাছে। ঠিক সেই সময়, একটি পুলিশের টহল গাড়ি এসে থামল। নারী পুলিশটি গাড়ি থেকে বের হল। মাতালটি তাকে দেখে গালি দেওয়া শুরু করল। গালিটি মেয়েদের জন্য খুব অপমানজনক। তাই মেয়েটি রাগে, ক্ষোভে প্রচন্ড শক্তিতে কান্না মিশ্রিত চিৎকার করে ওই মাতালটিকে একটি ধমক দিল। মাতাল দমবার পাত্র নয়। সে আরো গালি দিচ্ছে। মেয়েটির সাথের পুরুষ পুলিশটি তখনও গাড়ি থেকে বের হয়নি। সেই লোকটিও মাতালকে একটা ধমক দিল। তাতেও কাজ হল না। মাতাল চিৎকার করেই যাচ্ছে। একেবারে চোখের সামনে দুইজন পুলিশ মাতালের কাছে অসহায় হয়ে রয়েছে। ঠিক তখনই পুরুষ পুলিশটি বুদ্ধি করে একটি কাজ করল।

কাজটি হল, গাড়ির দরজাটি মাতালের পথের সামনে এমনভাবে খুলে দিল যাতে মাতালের যাবার পথ বন্ধ হয়ে যায়। মাতাল তো মাতালই। একেবারে তাল সামলাতে না পেরে গাড়ির দরজায় ধম করে একটা গুতা খেলো। ব্যস, মাতাল তো রেগে আকেবারে আগুন। কি আমাকে দরজা দিয়ে গুতা দিস। সে পুলিশকে মারতে তেড়ে এলো। তখন পুলিশ তাকে খপ পরে ধরে ফেলে তার হাত পেছনে নিয়ে মাটিতে শুইয়ে ফেলল। এর পরে কি হয়েছিল সেটা আর আমি দেখিনি। কারন এর পরে মাত্র দুটো জিনিস হয়ে পারে। এক, লোকটিকে ওভাবে কয়েক মিনিট মাটিতে শুইয়ে আটকে রেখে দিবে। যদি সে শান্ত হয়, তাকে ছেড়ে দিবে। সে শান্ত না হলে, তাকে পুলিশ স্টেশনে আটকে রাখবে। সকালে নেশা কেটে গেলে তাকে ছেড়ে দিবে। 

এই ঘটনাটিতে আমার চোখের সামনে পুলিশের পেশাদারিত্বের ননুনা দেখতে পেলাম। মাতালের দেওয়া ওই গালিটি শুনে ওই মেয়েটি হয়ত অন্য সময় হলে ওই মাতালের গালে চড় বসিয়ে দিত। কিন্তু এখন সে সেটা করতে পারে না। কারন, সে ডিউটিতে রয়েছে। পুলিশের পোষাক রয়েছে তার গায়ে। আর পুলিশকে গালি দেবার জন্য জনগনকে ছোয়া যায় না। জনগন যদি পুলিশকে মারতে আসে, তখন জনগনকে ধরা যায়। তাও আবার ধরে মারা যায় না। আটকে রাখা যায় মাত্র। আর সবচেয়ে বড় কথা হল – ব্যাক্তিগত আক্রোশ থেকে কাউকে ছোয়ার অধিকার পুলিশের নেই। 

একবার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের দাবী আদায়ের জন্য রাস্তা অবরোধ করেছিল। প্রায় শ খানেক ছাত্র, শহরের একটি ব্যাস্ত রাস্তায় বসে রয়েছে। তাদেরকে অনেক রকমের হুমকী দিয়েও সরানো গেল না। অবশেষে পুলিশ এলো। পুলিশ অনেক হুমিকী দিল। কেউ সরল না। কারন সবাই জানে, পুলিশ আর যাই করুক, মারতেও পারবে না, ধরতেও পারবে না। তখন আরো পুলিশ আনা হলো। এবার প্রত্যেক বসে থাকা ছাত্রের পেছনে এক এক জন করে পুলিশ গিয়ে দাড়াল। যতগুলো ছাত্র, ততগুলো পুলিশ। ছাত্ররাও, বিভ্রান্ত – এরা এক একজন আমাদের পেছনে দাঁড়ানো কেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই কারনটা বোঝা গেল। ওই দারানো পুলিশেরা সবাই একসাথে একটু একটু করে সামনে সরে আসছে। একেবারে গায়ে ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে দেখে প্রত্যেক ছাত্র সামান্য একটু সরে বসল। আবার আরেকটু সামনে এগুচ্ছে। ছাত্ররা আরেকটু সরছে। এভাবে এক ঘন্টার ভেতরে ইঞ্চি ইঞ্চি করে সরিয়ে রাস্তা থেকেই সরিয়ে ফেলেছে সব ছাত্রদেরকে। মারামারি, লাঠি চার্জ, কাদানি গ্যাস ইত্যাদি কিছুই লাগল না। ছাত্ররা করেছে সন্ত্রাসমুক্ত আন্দোলন। পুলিশও করেছে সন্ত্রাসমুক্ত প্রতিরোধ। 

আরেকটি জিনিস অস্ট্রেলিয়ার পুলিশের ভেতরে আছে। সেটা হল ছদ্যবেশ। আমি এমন অনেক ছদ্যবেশী পুলিশ দেখেছি। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না, এমন যায়গায় ছদ্যবেশী পুলিশ রয়েছে। রাস্তার ভিক্ষুক, ক্লাবের ড্যান্সার, স্কুলের টিচার, ট্রেনের সহযাত্রি, অন্ধ পথিক, রাস্তায় গান গেয়ে ভিক্ষা করে এমন যে কেউই হতে পার ছদ্যবেশী পুলিশ। 

আমার লেখাটি পরে অস্ট্রেলিয়ার পুলিশকে ফেরেশতা ভাবাটা ঠিক হবে না। বিচ্ছিন্ন অনেক ঘটনাতে তাদের বিভিন্ন ত্রুটি ধরা পরেছে। অনেক ঘটনাতে, ভুল করে, সহকর্মীর গুলিতে পুলিশ নিহত হয়েছে। পুলিশকে আক্রমন করবে, এটা ভেবে নিরাপরাধ মানুষ পুলিশের গুলিতে খুন হয়েছে। কোন নালিশ নিয়ে পুলিশের কাছে গেলে চোরের চেয়ে বাদীকে বেশী জেরার মুখে পড়তে হয়। নালিশ করে তেমন ফলও হয় না। অনেক সময়, নিরিহ লোককে ঘাটায়। ভারতীয় বংশোদ্ভুত এক ডাক্তারকে জঙ্গী সন্দেহে কয়েক মাস আটকে রেখে ব্যাপক হয়রানী করেছে। লোকটির খালাতো ভাই ইংল্যান্ডের একজন সন্দেহভাজন জঙ্গী। তার কাছে সে মোবাইলের ম্যাসেস চালাচালি করেছিল। এটাই ছিল তার অপরাধ। 

তবে যত ত্রুটিই থাকুক। কয়েকটি জিনিস পুলিশ মেনে চলে। ভদ্র ব্যাবহার করে, মানুষ যেমন ব্যাবহারই করুন না কেন। ঘুষ জিনিসটা চিনেই না। ব্যক্তিগত আক্রোশ মেটায় না। যত বড় অপরাধী হোক না কেন – তাকে পেটায় না। পুলিশের কাজ হল অপরাধীকে ধরে কোর্টে হাজির করা। তাকে পেটানো নয়। পুলিশ যে মানুষের বন্ধু হতে পারে সেটা উন্নত বিশ্বের পুলিশ দেখলে বোঝা যায়। আর আমাদের দেশের পুলিশের অবস্থা হল – যার এমন বন্ধু আছে, তার আর শত্রুর দরকার নেই। 

Comments

  1. বাংলাদেশ পুলিশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

    ReplyDelete
  2. আমাদের দেশের পুলিশের অবস্থা হল – যার এমন বন্ধু আছে, তার আর শত্রুর দরকার নেই।

    ReplyDelete

Post a Comment