মরন খেলা Blue whale নিয়ে ভুল ধারনা


১৯৯৮ সালে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃস্টি করেছিল CIH নামক একটি কম্পিউটার ভাইরাস। কম্পিউটারে সারা বছর এই ভাইরাসটি ঘাপটি মেরে বসে থাকে আর কাজ করে ২৬ এ এপ্রিলে। একেবারে হার্ড ডিস্কের সব ফাইল মুছে যায়। ভাইরাসটি বানিয়েছিল তাইওয়ানের Chen Ing-hau যার সংক্ষিপ্ত রূপই ওই CIH । ভাইরাসটির কারনে ফাইল মুছে গিয়ে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি ডলারের ক্ষতি হয়। যাই হোক, ওই বছরেই একদিন আমাদের বন্ধুদের কাছে শুনতে পেলাম তারা খবর পেয়েছে যে কোন এক নতুন ভাইরাস এসেছে। সেই ভাইরাস নাকি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ওইদিন দরজা জানালা বন্ধ করে সাবধানে থাকতে হবে। নইলে ওই ভাইরাস এসে কম্পিউটার নস্ট করে দিবে। কম্পিউটার ভাইরাস কোন জীবাণু নয়। এটা একটা সফটওয়্যার যা কোন একটি কাজ ব্যাহত করে, কোন ফাইল মুছে দেয়, ইত্যাদি। আর ওটা সফটওয়্যার বলেই একেবারে দিনক্ষন দেখে কাজ করতে পারে। জীবাণু তো আর সন তারিখ বোঝে না। এই জিনিসটা বুঝিয়ে দেওয়ার পরে আমাদের বন্ধুরা বেশ হাসাহাসি  করলো আর বলতে লাগলো - অমুক যেভাবে বলেছিল তাতে তো মনে হচ্ছিল যে ঐ ভাইরাসটি আমাদের আশেপাশে কিলবিল করছে। 


এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে, আমার বন্ধুরা ভাইরাস সম্পর্কে যা শুনেছিলা তা কিন্তু পুরোপুরি মিথ্যা নয়। সামান্য একটু বোঝার ভুল ছিল। এর করন হল, কম্পিউটার জিনিসটা তখন ছিল একেবারেই নতুন। এমনই বোঝার ভুলের কারনে, সম্প্রতি আত্মঘাতী এক খেলা Blue whale নিয়েও বিভিন্ন ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। এটা একটা কম্পিউটার গেম হিসাবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। এই গেম নাকি deep web এ আছে। এটা কে কোনভাবে খুজে পাওয়া যায় না। কেবলমাত্র কেউ লিঙ্ক পাঠালে এটিকে পাওয়া যায়। এই গেমটি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার চ্যালেঞ্জ দেয়। রাশিয়ার ফিলিপ নামের যে লোকটি এই গেমটি বানিয়েছে করে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের কয়েক শত কিশোর-কিশোরী এই গেমের ছোবলে প্রান হারিয়েছে। ভারত এমনকি বাংলাদেশেও এই গেমের কারনে প্রান হারানোর খবর পাওয়া গেছে। এগুলো সবই সত্য কথা কিন্তু এর মাঝে রয়েছে আমাদের বোঝার ভুল।

আমরা কম্পিউটারে গাড়ী চালানো, ফুটবল খেলা, যুদ্ধ করা, দাবা খেলা ইত্যাদি গেম খেলে থাকি। ওগুলো হল কম্পিউটার গেম বা খেলার জন্য বানানো সফটওয়্যার। Blue whale আসলে কোন কম্পিউটার গেম নয় যেখানে আপনি একের পর এক ধাপ পার হয়ে খেলতে থাকবেন। বরং, এটা একটা যোগাযোগের ব্যাবস্থা, যেখানে একজন নির্দেশ দেয় আর আপনি সেই অনুযায়ী কাজ করেন। ওই কাজগুলি না করলে কিছুই আসে যায় না। ওরা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে নতুন শিকার খুজবে। Blue whale একটা চ্যালেঞ্জ, একটা নতুন মরন খেলা। এর জন্য বিশেষ এপ্লিকেশন আছে যাতে যোগাযোগ করা যায়, গ্রুপ বানানো যায়। এতে ম্যেসেজ পাঠানো, ছবি আপলোড করা ইত্যাদি করা যায়। এই একই কাজ ফেসবুকে বা টুইটারেও করা যায়। Blue whale এর সমস্যাট হল, যাদের সাথে যোগাযোগ করা হয় তারা হল খুনী। কোমলমতি, নিঃসঙ্গ, হতাশাগ্রস্থ কিশোর-কিশোরীকে বেছে নিয়ে তাদেরকে আত্মহত্যা করতে উতসাহী করে। এই মরন খেলাটা খেলছে ওরা আর ওদের শিকার ওই কিশোর-কিশোরী। যে আত্মহত্যা করে, সে খেলে না, বরং তার জীবন নিয়ে খেলে অন্য একজন। একটা কম্পিউটার গেমের সাধ্য নেই মানুষকে দিয়ে আত্মহত্যা করাবে। এই আত্মহত্যা করায় ওরা, যারা এই গ্রুপ পরিচালনা করে। তাছাড়া এই এপ্লিকেশনের বাইরেও তারা তাদের শিকারকে ফোন করে এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দেখাও করে। তবে, এই খেলা খেললে মৃত্যু হবেই, এটা ভুল ধারনা। ওই খুনী চক্র শতভাগ সফল হয় না। অনেকেই ওদের নির্দেশ পালন না করে, ওদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।     

এই Blue whale এপ্লিকেশন আছে deep web এ, এই কথা সত্য। কিন্তু deep web জিনিসটা কি? deep web  হল সেই সকল ওয়েব পেজ যেটা সবাই দেখতে পারে না। আপনার কাছে পাসওয়ার্ড বা অন্য কোন সুরক্ষিত লিঙ্ক থাকতে হবে। যেমন আপনার ইমেইল একাউন্ট, আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এগুলো সবই deep web এ থাকে। এগুলো শুধুমাত্র আপানি অথবা কোন অনুমোদিত ব্যাক্তি দেখতে পারে। সবাই দেখতে পারে না। Blue whale এর এপ্লিকেশনও এমনভাবে রাখা। যে শিকার তাদের পছন্দ হয়, সেই শিকারের কাছে ওরা এর প্রবেশাধিকার দেয়। 

তারা আসলে কিভাবে আত্মহত্যা করায়? প্রথমে তারা নিঃসঙ্গ, হতাশাগ্রস্থ কিশোর-কিশোরীকে বেছে নেয়। তাকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে এক একটি কাজ করাতে করাতে তার স্বভাব, দুর্বলতা, হতাশার কারন ইত্যাদি জেনে নেয়। বাবা-মা, সেরা বন্ধু, আপনজন, এদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার চ্যালেঞ্জ দেয়। একা থাকতে বলে, নিজের শরীর কাটা ছেড়া করতে বলে। জীবনের উপরে অনীহা তৈরি করে দেয়। বিপদজনক কাজ করার চ্যালেঞ্জ দেয় - যেমন ছাদের রেলিং এর উপর দিয়ে হাটা। এর সাথে তাকে দিয়ে অনেক অন্যয় করায়, যেমন চুরি, ছিনতাই...ইত্যাদি। এগুলোর সবই ছবি তুলে তাদের কাছে পাঠাতে হয়। অনেক সময় নিজের নগ্ন ছবি তুলে পাঠাতে বলে। কখনো এমন কোন গোপন পাপ করায় যেটা জানাজানি হবার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। এভাবেই তার অনেক গোপন ছবি যখন হাতে চলে আসে তখনই শুরু হয় ব্লাকমেইল। অমুক কাজ কর, নইলে এগুলো সবাইকে দেখিয়ে দিব...... ব্যাস, আর কোন উপায় থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে আপনজনকে হত্যার হুমকীও দেওয়া হয়। এমন করে বিভিন্ন কায়দায় একটি কিশোর-কিশোরীকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। 

আমাদের বোঝার ভুলটি হল, সব দোষ ওই গেম বা সফটওয়ারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমরা আসলে ওসব খুনীদেরকে আড়ালে যাবার সুযোগ করে দিচ্ছি। Blue whale জিনিসটা কিছুই না। এটি একটি দল বা যোগাযোগের মাধ্যম মাত্র। এই দলে মিশে বা এই মাধ্যমে যোগাযোগ করে তারা কি করে, সেটাই হল আসল কথা। অনেক ছেলে মেয়ে ফেসবুকে পরিচিত হয়, হোয়াটসেপে ম্যেসেজ পাঠায়, মোবাইলে কথা বলে এগুলো সবই যোগাযোগের মাধ্যম। এভাবেই তারা প্রেম করে। সেই প্রেমের দোষ-গুন কি ঐ ছেলে মেয়েদের নাকি নাকি দোষ-গুন ওই ফেসবুক আর মোবাইলের? আজকে Blue whale থেকে আমরা সবাইকে সবধান করছি, কিন্তু ওই সংবদ্ধ খুনী চক্রর কাছ থেকে কাউকে সাবধান করছি না। ওই খুনীদের কি Blue whale লাগে নাকি? তারা ফেসবুক, টুইটার, মোবাইল...... যে কোন মাধ্যমেই তাদের শিকারকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

এই খুনী চক্রর বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক করে তুলতে হবে। তাদেরকে ধরতে যথাযত ব্যাবস্থা নিতে হবে। তবে যে জিনিসটা আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশী জরুরী সেটা হল বাবা-মা এর দেওয়া - সময়। বাবা বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত থেকে লাখ লাখ টাকা রোজগার করে আনে। মা সারাদিন সংসার সামলে হয়রান। তারা ছেলে মেয়েদের সকল প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশী দেন। এভাবে তারা মনে করেন, ছেলে মেয়েরা কত সুখে আছে। কিন্তু যে 
জিনিসটা তারা ছেলে মেয়েদেরকে দেন না, সেটা হল - সময়। এই সময় না দেওয়ার জন্যই বাবা মায়ের সাথে ছেলে মেয়েদের দুরত্ব বেড়ে যায়। তারা কি করে বা করছে সেটা বাবা মায়েরা জানেই না। আর এই সুযোগটাই নেয় ওই খুনী চক্র। যে পরিবারে বাবা মা ও ছেলে মেয়েদের মধ্যে দুরত্ব কম, সেই পরিবারে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতন এমন নিঃসঙ্গ ও হতাশাগ্রস্থ কিশোর-কিশোরী নেই। 


>>>>
কোন অচেনা লোকেকে নির্দেশনা দিয়ে আত্মহত্যা করানোটা প্রায় অসম্ভব। বিশ্বের বিভিন্ন যায়গায় হয়ত এমন বিচ্ছিন্ন বেশ কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু যেমন ঢালাওভাবে  Blue whale এর প্রচারনা ও আতঙ্ক চলছে সেটা আমার কাছে মিডিয়ার বাড়াবাড়ি (ক্ষেত্রবিশেষে ভুয়া) বলেই মনে হয়। 

Comments

Post a Comment