যেভাবে দেশের উন্নতি হয়


আমাদের প্রায় সকলের মনেই একটি বদ্ধমুল ভুল ধারনা আছে। সেটা হল, দেশের সকল উন্নতি রাস্তা ও দালান কোটাতে গিয়ে ঠেকে। এত বেশী নদী নালা সম্ভবত আর কোন দেশে নেই। একশত বছর আগে নৌকাই ছিল্ একমাত্র ভরসা। স্বাধীনতার আগে, বৈষম্যমুলক সরকার ব্যাবস্থাতে আমাদের এই অঞ্চলের ভাগে খুব বেশী রাস্তা-ঘাট পড়ত না। একটা রাস্তা অনেক বড় কিছু ছিল। আর ব্রিজ তো আরো বড় ব্যাপার। এই ব্রিজের অভাবে এখনো দেশের অনেক জেলাতে রেল লাইন স্থাপন করা যাচ্ছে না। যমুনা ব্রিজ, পদ্মা ব্রিজ, এগুলো হল মানুষের স্বপ্ন।  ব্রিজ নিয়ে স্বপ্ন দেস্খে, এমন দেশ ও জাতি এ দুনিয়াতে আর আছে বলে আমার জানা নেই। এসবের মুল হল, ওই রাস্তার প্রতি আমাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশী উতসাহ। 

যোগাযোগের জন্য অবশ্যই রাস্তার দরকার আছে। সেই পরিমান রাস্তা আমাদের দেশে আছে। সমস্যাটা হল, রাস্তার অবস্থা ভালো না। রাস্তাটা বানানোর সময় দুর্নীতি করে ভেজাল না দিলে এবং অতিরিক্ত মাল বোঝাই ট্রাক না চললে, সেই রাস্তা এমনিতেই ভালো থাকবে। আর দেশে অতিরিক্ত চওড়া নদী আছে মাত্র তিনটি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। ব্রিজ হলে অবশ্যই ভালো হয়। তবে ব্রিজ না হলে, এই তিনটি নদী ফেরীতেও পার হওয়া যায়। সেখানেও সমস্যাটা হলে, অনিয়ম আর দুর্নীতি। ফেরীতে নদী পার হতে আধা ঘণ্টারও কম সময় লাগে। ওদিকে সেই ফেরীতে ওঠার জন্য দশ ঘন্টা বসে থাকতে হয়। ফেরীতে দেরী হবার সাথে অনিয়ম ও দুর্নীতির সম্পর্কটা বোঝাতে এক দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। আমাদের আজকের আলোচনা একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে। 

একটা যমুনা ব্রীজ বা পদ্মা ব্রিজ বানিয়ে হয়ত জাতির স্বপ্ন পুরন হয় কিন্তু খুব একটা বেশী দেশের উন্নতি হয় না। এর চেয়ে বরং বেশী ও সাশ্রয়ী উন্নতি হতে পারে যদি দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়োন্ত্রন করা যায়। তাহলে ফেরীতে ওঠার  জন্য অপেক্ষার সময়টা দুই ঘন্টায় নেমে আসবে। রাস্তায় অতিরিক্ত মাল বোঝায় ট্রাক চলবে না। সর্বপরি নদীটি পার হয়ে যে কাজই করুক না কেন......... সবকিছুতেই সফলতা আসবে, যা দেশের কাজে লাগবে। দুর্নীতি আর অনিয়ম নিয়োন্ত্রন না করা গেলে, সোনা-রূপা দিয়ে ব্রিজ বানিয়েও কোন লাভ নেই। কারন ওই ব্রিজের উপর দিয়ে "দুর্নীতি" পার হবে, "সফলতা" পার হবে না।  তাছাড়া বড় ব্রিজ বানিয়ে ঋণের বোঝা কিভাবে বাড়ে আর কিভাবে সেই বোঝা জনগনের ঘাড়ে চেপে বসে সেসব কথা নাইবা বললাম।  

দেশের উন্নয়নের জন্য জনগনের প্রতি মমতা, সমাজের প্রতি দায়িত্ব, গঠন্মুলক সিদ্ধান্ত ও কর্মদক্ষতা ইত্যাদি অনেক কিছুর প্রয়োজন হয়। এই ব্যাপারে একটি উদাহারন সৃস্টি করেছে যশোরের মণিরামপুরের স্থানীয়রা। তারা নিজেদের উদ্দোগে বানিয়েছে হাজার ফুট লম্বা ভাসমান সেতু। কপতাক্ষ নদীর দুই পাশের, ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা যুগে যুগে নদীটি পার হতে অনেক কস্ট করেছে। স্থানীয়রা ছোটবেলায় সাতরে নদী পার হয়ে স্কূল করতো পরে নৌকার ব্যাবস্থা হবার পরেও অনেক সময় পর্যাপ্ত নৌকা পাওয়া যেতো না কিংবা অনেক সময় লাগতো নদী পার হতে। ব্রিজটা বানানোতে সেই সমস্যাটার খুব ভালো একটা সমাধান হয়েছে। নদীর দুই পাশের ২০ হাজার মানুষের মাঝে যোগাযোগটা আরো সহজ হলো।     



গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের সভাপতি মেহেদী হাসান টুটুল, মাদ্রাসা শিক্ষক আসাদুজ্জামান এবং আরো কয়েক বন্ধু নদীর পাড়ে বসে একদিন গল্প করছিলেন। সেই সময় তারা দেখতে পান নদীতে মেশিন দিয়ে বালি তোলা হচ্ছে। সেই মেশিনটি রাখা হয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যারেলের ওপর ভাসমান অবস্থায়। এ দৃশ্য দেখে ভাসমান সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করেন তারা। বেশ কয়েকটি পর্যায়ে গবেষনার পরে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন তারা। স্থানীয় ৬০ জনের কাছ থেকে 
প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা নিয়ে শুরু করা হয় এই ব্রিজ বানানোর কাজ।  প্লাস্টিকের ড্রামের ওপর লোহার পাত দিয়ে বানানো হয় সেতুটি। নিজেদের পরিকল্পনাতেই ৮৩৯টি প্লাস্টিকের ড্রাম, ৮০০ মণ লোহার অ্যাঙ্গেলবার ও ২৫০টি লোহার সিটের মাধ্যমে লোহার পাত দিয়ে একের পর এক ড্রাম যুক্ত করে তৈরি করা হয় সেতুটি। এলাকাবাসীর সহযোগিতায় ও স্বেচ্ছা শ্রমে এক বছর সময়ের মধ্যে এ সেতু নির্মাণ হয়ে যায়।  এই সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল, ভ্যান, নসিমন প্রাইভেটকার এবং মাইক্রোবাস পারাপার হতে পারবে বলে মত দেন নির্মাতারা। রীতিমতন ফিতে কেটে সেতুটি উদ্ভোদন করার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাশক, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও অন্যান্য গন্য মান্য ব্যাক্তিবর্গ। সেই সাথে উপস্থিত ছিলেন দুই পাড়ের কয়েক হাজার মানুষ।    

এখানে যে বিষয়গুলি লক্ষ্যনীয়, তা হল - 
১ঃ সমাজ উন্নয়নের চিন্তা। গাছ থেকে ফল পড়েতে সবাই দেখেছে। কিন্তু বিজ্ঞানী নিউটন গাছ থেকে আপেল পড়তে দেখে "মধ্যাকর্ষন শক্তি" আবিস্কার করে ফেলেছেন। এর প্রথম কারন হল, তিনি ওই আবিস্কারের চিন্তাতেই থাকতেন। ঠিক একইভাবে উন্নয়নের চিন্তায় থকা এলাকার ওই কয়েকজন নদীর পাশে বসে ভাসমান মেশিন দেখে ভাসমান ব্রিজের পরিকল্পনা করে ফেলে।  
২ঃ এই ব্রিজের নকশা করার জন্য আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার ইতাদি প্রয়োজন হয়নি। 
৩ঃ এই ব্রিজের নকশার অনুমোদনের জন্য কোন সরকারী বড় আমলার পেছনে ঘুরতে হয়নি। কাউকে ঘুষ দিতে হয়নি। 
৪ঃ এই কাজের জন্য কোন টেন্ডারবাজী হয়নি। কোন ঠিকাদার ঘুষ দিয়ে এই কাজটি নেয়নি। 
৫ঃ টাকা আত্মসাধ করে, রডের বদলে বাশ ব্যাবহার করে এই ন্রিজ নানানো হয়নি।
৬; কজের পরে বিল আটকে থাকেনি। 
৭ঃ নিজেদের পরিশ্রম যুক্ত থাকায় ও সরকারী মাল না হবার কারনে এই ব্রিজের প্রতি এলাকাবাসী যত্নশীল হয়ে এটিকে দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখবে। 

এই ব্রিজটি আমাদের জন্য একটি শিক্ষা। আমারা সবাই এভাবে এলাকাভিত্তিক উদ্যোগ নিয়ে ছোট ছোট উন্নয়নমুলক কাজ নিজেরাই করতে পারি। এমন করলে, একদিকে যেমন আমাদের দেশপ্রেম বাড়বে, দেশের প্রতি কর্তব্য বাড়বে, অন্যদিকে আমাদের সমাজ থেকে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে।   

Comments