বাংলাদেশের মহাকাশ জয় ও বোধশক্তির ক্ষয়



এক তৃতীয়াংশ নিরক্ষর জনসংখার দেশে, স্যাটাইলাইট জিনিসটা খায়, নাকি মাথায় দেয়, সেটা জানেনা অর্ধেকেরও বেশী মানুষ। বাকীরা জানে, এটা এক ধরনের রকেট, যা আকাশে থাকে। যারা আরেকটু বেশী জানে, তারা জানে এই স্যাটালাইট ব্যাবহার করে টিভির অনুষ্ঠান, মোবাইল ফোনের কথা, ইন্টারনেট ইত্যাদি পাওয়া যায়। হ্যা, এটুকু জানলেই চলবে। তবে জিনিসটা যারা ভালোভাবে জানে, তারা মুখে কুলুপ এটে বসে রয়েছে। মাইরের ভয় সবারই আছে। 

আমাদের দেশে স্যাটালাইট কি কাজে লাগে, এত বড় কাজের জিনিস ছাড়া এতকাল কিভাবে চলেছে, এতে কত টাকা খরচ হচ্ছে, এই খরচা করে কি দেশ ও জাতীর আদৌ কোন কল্যান হয় কিনা। এমন প্রোজেক্টে কাদের পকেট ভারী হয় – এসব দুর্বোধ্য আলোচনার ভেতরে নাইবা গেলাম। যেটা নিয়ে কথা বলছি সেটা হলে......... আমদের মিডিয়া ও জনগনের উল্লাস। 

দেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে হেডলাইন হয়েছে - বাংলাদেশ মহাকাশ জয়। পত্রিকায় সংবাদ এসেছে দেশের কত বড় অর্জন হয়েছে, উন্নতির পথে আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। জনগনের তো গর্বে বুকের ছাতি চওড়া হয়ে গেছে। অনেকে তো যথারীতি এটাকেও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বানিয়ে দিয়েছেন। অচেনা লোকের কথা বাদই দিলাম, আমার বন্ধু মহলের অনেকেই ফেসবুকে এই স্যাটালাইটকে “দেশের অর্জন” বলে আনন্দ প্রকাশ করছে। এরা প্রায় সলকেই, উচ্চ শিক্ষিত। আমাদের বোধ শক্তি লোপ পেয়েছে সেটা জানতাম, তবে এতটা লোপ পেয়েছে সেটা বুঝতে পারিনি। 


উন্নত দেশের কথা বলছি না। আমাদের পাশ্ববর্তি দেশ ভারতের কথা বলছি, যেখানে এখনও সকলের জন্য বিশুদ্ধ খাবার পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করা যায়নি। তারা ১৯৭৫ সালে প্রথম স্যাটালাইট উতক্ষেপন করেছিল। যে জিনিসটাকে আমরা আজকে অর্জন বলছি, ৪৩ বছর আগে সেটা কত বড় অর্জন ছিল?  স্যাটালাইটের মালিক হওয়া বা আকাশে পাঠানোটা কোন অর্জন নয়। অর্জন হল – জিনিসটা বানানো। ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ওই স্যাটালাইট বানিয়েছিল (যদিও এতে রাশিয়ার কারিগরি সহায়তা ছিল)। এর পরে ১৯৮১ সালে তো একবারে সম্পুর্ন দেশীয় প্রযুক্তিতে স্যাটালাইট বানিয়ে সেটাকে গরুর গাড়িতে পরিবহন করেছে। ভারত তাদের প্রথম রকেটটিও সাইকেলে পরিবহন করেছে। সাইকেল বা গরুর গাড়ী এগুলো কোন বিষয় নয়। বিষয়টি হল, তারা তখন থেকে মহাকাশ গবেষনা করে, তখন থেকে স্যাটালাইট আর রকেটা বানায়, যখন তাদের গ্রামে গঞ্জে ভালো রাস্তাঘাটও নেই। এমন করে বলেই, ভারতের ৮৮ টি স্যাটালাইট রয়েছে। কয়েক বছর আগে, সবচেয়ে কম খরচে মঙ্গল গ্রহে রকেটা পাঠিয়ে দৃস্টান্ত স্থাপন করেছে, ভারত। এটাকে অর্জন বলে, এটাকে মহাকাশ জয় বলে। 

আমাদের স্যাটালাইট হয়েছে, কেনা স্যাটালাইট। বাংলাদেশ টাকা দিয়েছে, অন্য দেশ বা প্রতিষ্ঠান সেই স্যাটালাইট বানিয়ে আমাদের নাম লিখে দিয়েছে। টাকা খরচ করলে, এমন সবাই করতে পারে। এর ভেতরে কোন কৃতিত্ব নেই, নেই কোন অর্জন। আমাদের দেশের গবেষকেরা (বিদেশী সহায়তায় হলেও) যদি নিজেরা স্যাটালাইট বানাতে পারতো, সেটা হতো অর্জন, সেটা হতো কৃতিত্ব। আমাদের বিষয়টি হল এরকম -  আমি নিজের রান্নার প্রশংশায় পঞ্চমুখ, অথচ খাবার কিনে এনেছি রেস্টুরেন্ট থেকে।

দেশের সঠিক কৃতিত্ব বা অর্জন, সব সময়ই আড়ালে থেকে যায় অথবা সঠিক পৃস্টপোষকতার অভাবে আলোর মুখ দেখতে পারে না। অনেক আগে, আমদের দেশের এক গবেষক, পাট কাঠি থেকে পার্টিকেল বোর্ড (পার্টেক্স) বানিয়েছিলেন। এই কৃতিত্বটা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে তেমন বড় কোন অর্জন আমরা করতে পারিনি। জিনিসটা বিশ্ববিখ্যাত হবার কথা ছিল। সম্প্রতি এক গবেষক, পাট থেকে পরিবেশ বান্ধব পলিথিন বানিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, এই প্রজেক্টও নাকি কি একটা সমস্যায় পড়ে গেছে। প্রায়ই খবরে দেখা যায়, অখ্যাত কোন তরুন বা যুবক বিশেষ ধরনের ব্যাটারী, বিশেষ ধরনের মোটর সাইকেল, বিশেষ ধরনের কোন যন্ত্র আবিস্কার করেছে। এমন প্রতিটি আবিস্কারই কার্জকর নয়। তবে, এর ১০% কার্জকর হলেও, এবং সঠিক পৃস্টপোষকতা পেলে সেটা বাংলাদেশের অর্জন হয়ে উঠবে। 

সঠিক কৃতিত্ব ও সঠিক অর্জন বোঝার মতন বোধ শক্তি আমাদের লোপ পেয়েছে। যে তালে বাদ্য চলে, আমরা সেই তালেই নাচি। সবার মাথায় তো সকল রকমের বুদ্ধি থাকে না। যারা গবেষক, তাদের মাথায় রাজনীতির বুদ্ধি কম থাকাটাই স্বাভাবিক। এমন উঠতি গবেষকেরা যদি তাদের আবিস্কারের নামটা একটু বুদ্ধি করে দিতেন, তাহলে তাদের প্রজেক্ট সফল হতো। বঙ্গবন্ধু ব্যাটারী, বঙ্গবন্ধু পলিথিন, বঙ্গবন্ধু মোটর সাইকেল ইত্যাদি নাম দিলে ওই প্রজেক্ট বিফল হওয়া তো দুরের কথা, মানুষ ওটাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বলে বিখ্যাত করে ছাড়বে। বঙ্গবন্ধু সেতু, বঙ্গবন্ধু স্যাটালাইট ইত্যাদি হতে পারলে, বঙ্গবন্ধু মোটর সাইকেল ও বঙ্গবন্ধু ব্যাটারী ইত্যাদি হতে দোষ কি ?  

------
দ্রস্টবঃ দেশের জনগণ যখন স্যাটালাইটের আনন্দে আন্তহারা, তখন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়ে গেল। আমাদের দেশের কি লাভ-ক্ষতি হবে সেটা তো দুরের কথা, এমন একটি জরুরী বিষয়ে কিছুই জানে না জনগন। আমরা, স্যাটালাইটের ধোয়াতেই আচ্ছন্ন।                 

Comments

  1. ভাই! বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি লেখা চাই। কোটা বিষয়।

    ReplyDelete

Post a Comment