নীরব বিজ্ঞান - পর্ব ২

আগের পর্বটি এখানে - নীরব বিজ্ঞান - পর্ব ১
সৃস্টিকর্তা বিশ্বাস করা না করা একজনের ব্যাক্তিগত বিষয়। কিন্তু সমস্যাটি হয় তখনই, যখন তারা নিজেদের ধারনার সমর্থনে বিজ্ঞানকে ঢাল হিসাবে ব্যাবহার করে। এদের বোঝাতে সারা বিশ্বেই প্রতিটি ভাষায় বিভিন্ন লেখা রয়েছে। এসব লেখাগুলিতে বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে সৃস্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমানের চেস্টা করা হয়েছে। হায়রে মানব জাতি। সৃস্টিকর্তা আছে কি নেই এটা বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমান করতে হবে। সৃস্টিকর্তাকে এত অসহায় বানিয়ে ফেলেছে। আমার ধারাবাহিক এই লেখাটিতে বিজ্ঞান দিয়ে সৃস্টিকর্তা প্রমানের চেস্টা করা হয়নি। বরং বিজ্ঞান যে কত অসহায় সেটা দেখানো হয়েছে।
ইংরেজীতে দুটি শব্দ রয়েছে। Discover ও Invent । বাংলাতে এই দুটোকেই আবিস্কার বলা হয়। এই দুটির পার্থক্য কিন্তু বিস্তর। কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কারের আগে আমেরিকা ওখানেই ছিল। নিউটন গতি সুত্র আবিস্কারের আগেও কিন্তু গতি ওই সুত্র মেনেই চলত। ডি এন এ এর গঠন প্রনালী আবিস্কারের আগেও কিন্তু ওটা অমনই ছিল। এগুলো সবই Discover । বাংলায় একে আবিস্কার না বলে, (রহস্য) উন্মোচন বলাটা সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। ওদিকে রেডিও আবিস্কারের আগে দুনিয়াতে রেডিও বলে কিছু ছিল না। মোবাইল আবিস্কারের আগে দুনিয়াতে মোবাইল বলে কিছু ছিল না। এগুলো হল Invent । এটাকে বাংলায় আবিস্কার বলে। ইংরেজীতে আরো একটি শব্দ রয়েছে Create (সৃস্টি) এটি কিন্তু Invent (আবিস্কার) হতে সম্পুর্ন আলাদা। রেডিও একটি আবিস্কার , সৃস্টি নয়।

মোট কথা, আগেই অস্তিত্ব রয়েছে এমন জিনিস খুজে পাওয়াটা Discover (উন্মোচন)। আসে পাশে রয়েছে এমন কিছু জিনিস কাজে লাগিয়ে নতুন জিনিস বানানো হল Invent (আবিস্কার)। কোন কিছু ছাড়াই একটা নতুন জিনিস বানানোটাই Create (সৃস্টি)। মানুষের সীমাবদ্ধ কিছু সৃস্টি রয়েছে। যেমন আমরা বলি “মিসির আলি” চরিত্রটা হুমায়ুন আহমেদের একটা সৃস্টি। মোনালিসা চিত্রকর্মটি একটি অপুর্ব সৃস্টি, অমুক কবিতাটা ওমুক লেখকের এক অনবদ্য সৃস্টি , ইত্যাদি। এমন সৃস্টি খুজে পাবেন শিল্প-সাহিত্য জগতে। বিজ্ঞানের জগতে খুজে দেখুন তো কোন সৃস্টি খুজে পান কি না। বিজ্ঞানে আশে আবিস্কার, সৃস্টি নয়। বিজ্ঞান সৃস্টিই বোঝে না - সৃস্টিকর্তা কি বুঝবে?

মানুষ চীর কৌতুহলী। মানুষ সব প্রশ্নের উত্তর খোজে। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় গুন হল, বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীরা অনেক বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষোনা করে, আমাদের অনেক না জানা প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারে। এই প্রশ্ন কিন্তু ৩ প্রকারের হয়। কি, কিভাবে ও কেন। ( What, How , Why)

ঊদাহরন

প্রশ্ন - পানিতে একটি বাটি ফাললে কি হয়?

ঊত্তর - বাটিট হয় ভাসে অথবা ডুবে যায়।

প্রশ্ন - এটা ভাসে বা ডবে কিভাবে?

উত্তরঃ পানিতে ফেলার পরে বাটিটি যতখানি স্থান দখল করে বা যতখানি পানি অপসারন করে ততটুকু পানির ওজন যদি ওই বাটি থেকে বেশী হয় তবে বাটিটী ভাসবে। অন্যথায় ডুবে যাবে (আবিস্কারক - আর্কিমিডিস)

প্রশ্নঃ বাটি আর পানি এই নিয়ম মেনে চলে কেন?

উত্তর - বিজ্ঞানে এর উত্তর নেই

প্রশ্নঃ সুর্য উদয় হলে বা অস্ত গেলে কি হয়

উত্তরঃ দিন রাত হয়

প্রশ্নঃ দিন রাত হয়

ঊত্তরঃ পৃথিবী গোল এবং নিজের অক্ষে লাটিমের মতন ঘুরে। এই ঘোরার মধ্যে যখন যেই অংশ সুর্যের দিকে ফেরানো থাকে সেই আলোকিত অংশ দিন বাকি অঙ্ঘকার অংশ রাত।

প্রশ্নঃ পৃথিবী এভাবে ঘোরে কেন? (দাড়িয়ে থাকলেই তো পারে)

উত্তর - বিজ্ঞানে এর উত্তর নেই

আপনি বিজ্ঞানের সমস্ত বই তালাশ করে দেখুন। এই “কেন” প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানে নেই। বিজ্ঞান “কি” এবং “কিভাবে” এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে কিন্তু “কেন” প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না।

-কি হয়

-কিভাবে হয়

-কেন হয়

-কে করে

এই চারটি প্রশ্নের মধ্যে প্রথম দুটির উত্তর দিয়েই বিজ্ঞান সবজান্তার ভাব নেয়। ৩য় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। আর ৪র্থ প্রশ্নটা তো বোঝেই না, উত্তর দিবে কি?

পানির একটি মাছকে ডাঙ্গায় এনে রাখলে কিছুক্ষন পরে মারা যায়। কিভাবে মারা যায়? নিঃশাসের অভাবে। মাছ বাতাসে নিঃশাস নিতে পারে না। তার ফুসফুস (ফুলকা) অন্যভাবে বানানো যা আমাদের ফুসফুস এর থেকে আলাদা প্রযুক্তিতে তৈরি। ওটা পানিতে কাজ করে, আর আমাদেরটা বাতাসে। ফুসফুস এই দুই ধরনের হয়। সবকিছু নাকি এমনি এমনি হয়েছে। তাহলে এমনি এমনি তৈরি হওয়া জিনিসের আবার দুটি মডেল হল কেন? আমরা সংবিধান, আইন আদালত, থানা পুলিশ ইত্যাদি দিয়েও সম্পদ সঠিক বন্টন করতে পারি না। ওদিকে কোন কিছু ছাড়াই যে প্রানীর যেমন ফুসফুস লাগবে সেই প্রানী ঠিক তেমন ফুসফুস পেয়ে গেল কেন? একটুও এলোমেলো হল না।

আসলে এই কেন প্রশ্নের উত্তর সে দিতে পারবে যে ওই কে প্রশ্নের উত্তর যানে। আল্লাহ, ডাঙ্গার ও পানির প্রানীর জন্য আলাদা ফুসফুস বানিয়ে যার সেটা দরকার তাকে সেটাই দিয়েছেন।

বিশ্বে কত সংখা রয়েছে, কত অংক রয়েছে, কত অংক বই রয়েছে। সবকিছুর মুলে কিন্তু ওই দশটি অক্ষর। ০,১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯। এই অক্ষরের বাইরে কোন সংখা নেই কোন অংক নেই। পার্থক্য শুধু সাজানোতে। ২৩৪৩ ও ৬৫৫ দুটি আলাদা সংখা। এগুলো সবই ওই দশটি অক্ষর থেকেই নেওয়া হয়েছে। পার্থক্য শুধু সাজানোতে। সাজানোর কারনে সংখা ও অংক তৈরি হয়। কিন্তু মুল উপাদান ওই দশটি অক্ষর।

এমন মাত্র তিনটি উপাদান দিয়ে আমাদের মহাবিশ্ব তৈরি। ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এই তিনটি একভাবে সাজানোর ফলে লোহার পরমানু তৈরি করে অন্যভাবে সাজানোর ফলে স্বর্নের পরমানু তোইরি করে। এই তিনটি উপাদান দিয়েই সকল পদার্থের পরমানু তৈরি। শুধু সাজানোটা ভিন্ন। পদার্থ পরমানুর সমস্টি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেহের কোষও পরমানু দিয়ে তৈরি। এক খন্ড লোহায় রয়েছে কোটি কোটি লোহার পরমানু। এক খন্ড স্বর্নে রয়েছে তেমনি কোটি কোটি স্বর্নের পরমানু। এই সকল পরমানু বিন্ন হলেও এগুলো সবই একই জিনিস ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে বানানো। শুধু সাজানোটা ভিন্ন। আপনি যদি লোহার পরমানুর সাজানোটা স্বর্নের মতন করতে পারেন তবে সেটা স্বর্ন হয়ে যাবে। গবেষনাগারে এভাবে স্বর্ন তৈরি করা যায় যদিও তার খরচ বাজারের স্বর্নের চেয়ে বেশী পড়ে।

অংকে যেমন সংখা সাজানোর একটি নিয়ম আছে। পরমানুর ক্ষেত্রে তেমনি ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন সাজানোর একটি নিয়ম রয়েছে। একটি সুত্র রয়েছে। 2n^2. । এটাকে ব্যখ্যা করে আলোচনাকে আর কঠিন করতে চাই না। ওটা আমাদের না বুঝলেও চলবে। মোট কথা মহাবিশ্বে যা আছে সবই পরমানু। আর এই পরমানুর মুল উপাদান এই ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন। এই তিনটি উপাদান একটি সুনির্দিস্ট নিয়ম (সুত্র) মেনে বিভিন্ন পরমানুতে বিভিন্নভাবে সাজানো থাকে। লোহা ও স্বর্নে সাজানোটা আলাদা হলেও একই নিয়ম অনুসরন করে সাজানো থাকে। অন্য পদার্থের পরমানুর ক্ষেত্রেও তাই। সবখানে ওই সুত্র মেনে সাজানো। এমনি এমনি হওয়া মহাবিশ্বেতো পরমানুগুলো এমন নিয়ম বা সুত্র মেনে সাজানো থাকবে কেন? এটা তো ইচ্ছে খুশি মতন সাজানো থাকার কথা।

যে কোন পদার্থ তাপ বাড়ালে আয়তনে বাড়ে আর তাপ কমালে আয়তনে কমে বা সংকুচিত হয়। পানিও তাই। পানিকে ঠান্ডা করলে তা সংকুচিত হয়। কিন্তু ঠান্ডা করতে করতে ৪ ডিগ্রীর নীচে নামলে হটাত করে আয়তন বাড়তে থাকে। পানি ঠান্ডা ঝয়ে বরফ হয় ০ ডিগ্রী তাপমাত্রায়। এই বরফ পানির চেয়ে আয়তনে বেশী, ফাপা আর এ কারনেই বরফ পানিতে ভাসে। বরফ যদি এই নিয়ম না মেনে চলত তবে তা পানিতে না ভেসে, ডুবে যেত। শীত প্রধান দেশে শীতের মৌসুমে নদী নালা হ্রদ এমনকি সমুদ্র এর অংশ বরফ হয়ে পানিতে ভেসে থাকে। এই বরফের নীচে থাকে পানি যেখানে নির্বিঘ্নে জলজ প্রানী বসবাস করে। বরফ না ভেসে ডুবে গেলে পুরো নদী না হ্রদটিই বরফ হয়ে যেত আর এতে এই শীতের মৌসুমেই বিশ্বের অর্ধেক জলজ প্রানী মারা যেত। জলজ প্রাণী রক্ষায় বরফ হটাত আয়তনে বেড়ে ভেসে থাকার এই নিয়ম অনুসরন করে কেন? এমনি এমনি হওয়া এই দুনিয়াতে তো জলজ প্রানী রক্ষার এই সুকৌশলী কায়দাটা থাকারই কথা নয়।

এভাবে কোন “কেন” প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। বিজ্ঞান এখানে অসহায় ও নীরব। অনেকে হয়ত ভাবতে পারে যে বিজ্ঞান এখন পারে না হয়ত ভবিশ্যতে পারবে। কখনোই পারবে না। কারন এই পরররযন্ত কোন ঃকেনঃ প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারেনি। বিজ্ঞান এসব প্রশ্নের উত্তর খোজেই না। কিভাবে হয় সেটা জেনেই খুশি। বিজ্ঞানের চর্চাকারী যারা এই “কেন” প্রশ্নের উত্তর খোজে তারা সৃস্টিকর্তা বিশ্বাস না করে আর কোন উপায় খুজে পায় না। যেসব বিজ্ঞানীরা নাস্তিক তারা এটা বুঝেও না বোঝার ভান করে।

Comments