কোন নেয়ামত অস্বীকার করবে ? (পর্ব ৩)

(পর্ব ১ - এখানে) (পর্ব ২ - এখানে) বলছিলাম মানুষের মস্তিস্কের সঙ্গে কম্পিউটার এর সাদৃশ্যের কথা। কম্পিউটার এর সাথে মানুষের কার্যকলাপে আরো কিছু সাদৃশ্য আছে। যেমন সফটওয়্যার। আপানার কম্পিউটার এর সাথে প্রিন্টার এর সংযোগ লাগালেই সেটা কাজ করে না। আপনাকে ওই প্রিন্টারের জন্য সফটওয়ার ইনস্টল করতে হবে। সেই সফটওয়ার এ প্রিন্টার কিভাবে পরিচালনা করতে হবে সেটা তো দেওয়া আছেই, সেই সাথে প্রিন্টারটিকেও চেনানো আছে ওই সফটওয়ারে। অর্থাৎ, ওই সফটওয়্যার ছাড়া কম্পিউটার ওই প্রিন্টেরটিকে চিনেই না। শুধু ওই প্রিন্টার নয়, আপনার কম্পিউটার এর কী-বোর্ড, মাউস, মনিটর, ইত্যাদি সবকিছু কম্পিউটার চিনে ও ব্যাবহার করতে পারে শুধুমাত্র সফটওয়ারের কারনে। তবে এসব সফটওয়্যার উইন্ডোজের সাথে এমনিতেই আসে বলে আপনাকে এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। এসব সফটওয়ারে ত্রুটি বা সমস্যা থাকলে আপনার ভালো যন্ত্রাংশই যঠিকভাবে কাজ করবে না।

আমাদের দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো কম্পিউটার এর যন্ত্রাংশের মতন। এর জন্য আমাদের মস্তিস্কে সফটওয়্যার রয়েছে, রয়েছে ড্রাইভার। আপনার কোমরের নিচে যে লম্বা দুটি খুটি রয়েছে সেগুলো যে আপনার পা, সেটা চিনতে আমাদের মস্তিস্কে ড্রাইভার রয়েছে। এই পা কিভাবে কাজ করবে সেটার জন্যও রয়েছে আলাদা সফটওয়ারে। জানি বিষয়টি অবিশ্বাস্য লাগছে। হয়ত ভাবছেন, অঙ্গ প্রতঙ্গের আবার ড্রাইভার কি, সফটওয়্যার কি? একটু সবুর করুন, দেখিয়ে দিচ্ছি। 

Body integrity identity disorder নামক একটি বিরল রোগ আছে। এই রোগী মনে করেন তার যে কোন একটা অঙ্গ না থাকলে ভালো হোত। এখানেই শেষ নয়, সে আপ্রান চেস্টা করে ওই অঙ্গটি কেটে ফেলতে। অনেক সময় চিকিতসকের পরামর্শে অঙ্গটি কেটে ফেলে, পঙ্গু হয়ে, সুখী জীবন যাপন করে। এটা কিন্তু একটা মানসিক রোগ। বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে যে রোগীর মস্তিস্কের বিশেষ কোন অংশ কাজ করে না যার ফলে এমন সমস্যা তৈরি হয়। এটা কিছুটা সফটওয়্যার বা ড্রাইভারে মতন। অন্তত রোগীদেরকে দেখলে তেমনই মনে হয়। 

ছবির এর লোকটির নাম ডেভিড। সে অস্ট্রেলীয়ার সিডনীর অধিবাসী, পেশায় একজন মুরগী ফ্যাক্টরির কর্মী। সে আনেক আগে থেকেই তার ডান পা কেটে ফেলতে চাইছিল। তার কাছে মনে হোত, ওই পা টা ওখানে থাকার নয়। পা টা বাড়তি। কোন ডাক্তার তার সুস্থ পা কাটতে রাজী হয়নি। ছয় বছর আগে, যখন তার বয়স ২৮ ছিল তখন সে ইচ্ছে করে শুখনো বরফ (এক প্রকার গ্যাস) এর মধ্যে তার পা কয়েক ঘন্টা ডুবিয়ে রাখে। এতে তার পা ঠান্ডায় জমে এতটাই ক্ষতগ্রস্থ হয় যে কেটে ফেলা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না । আসল পা কেটে ফেলে , নকল পা লাগিয়ে ডেভিড এখন মহাখুশি। সে বলেছে যে পা জমে যাওয়ার কস্ট সহ্য করার সুফল সে পেয়েছে। সুফলটা হল - পা কেটে ফেলতে পেরেছে। সে সত্যই খুশি। ডেভিডের মতিন এমন হতভাগ্য রোগী সারা বিশ্বে আরো আছে যারা তাদের হাত, পা ইত্যাদি কেটে ফেলতে চায় ও কেটেছেও। তবে তাদের সংখা খুব কম। 

একই রোগের আরেকটি ধাচে ভুগছেন ইংল্যান্ডের এক মহিলা ক্লোওই হোয়াইট। তিনি ছোটবেলা থেকেই চাইতেন হইল চেয়ারে থাকতে। অনেকবার পঙ্গু হবার চেস্টা করেছেন। তিনি কিন্তু কোন অঙ্গ কেটে ফেলতে চান না, তিনি চান তার মেরুদন্ডের কোন হাড় ভাঙ্গতে যাতে তিনি সোজা হয়ে দাড়াতে না পারেন এবং হুইল চেয়ারে কাটাতে হয়। বহু ডাক্তারের কাছে তিনি গিয়েছেন, কেউই তার কোমড়ের হাড় ভাঙ্গতে রাজী হয়নি। ইংল্যান্ডের বাইরে অন্য কোন দেশের এক ডাক্তার অবশ্য রাজী হয়েছিলেন কিন্তু সেটা অনেক ব্যায়বহুল হওয়াতে মহিলাটি সেটা করতে পারেননি। তিনি ভাল হাটতে পারেন। তবুও দিনের বেশীরভাগ সময় হুইল চেয়ারে কাটান। তিনি মনে প্রানে পঙ্গু হতে চান এবং হতে পারলে খুব সুখে থাকবেন। 

ওদের দুজনের কথা অবিশ্বাস্য লাগছে? আপনার নিজের কথাই ধরুন। কালকে সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি দেখেন আপনার তিনটি পা। তখন কি করবেন? কতটা তিব্রভাবে চাইবেন ওই অতিরিক্ত পা টি শরীর থেকে আলাদা করতে। ঠিক তেমনই অনুভব করেছে ডেভিড। সখ করে নিজের পা নস্ট করেনি সে। ঠিক তেমনই তিব্রভাবে পঙ্গু হতে চায় ক্লোওই। এর বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। স্নায়ু ও মস্তিস্কে নিউরনের কথা বলা হয়। সহজভবে জিনিসটা বললে এটা সফটওয়ারের গোলযোগ। আমাদের সবার মস্তিস্কে আমাদের শরীরের একটি মানচিত্র (map) দেওয়া আছে। আমরা আমাদের শরীরটাকে খুব ভালো চিনি। দেওয়ালের ছোট একটা গর্তের ভেতর দিয়ে আমি ঢুকতে পারব কিনা সেটা জানতে আপনি একবার ওই গর্তের দিকে আরেকবার আমার শরীরের দিকে তাকিয়ে মেপে নিবেন। কিন্তু আপনি যদি নিজে ওই গর্ত দিয়ে ঢুকতে চান তাহলে আপনাকে নিজের শরীদের দিকে একবারও তাকাতে হবে না। আপনি এমনিতেই জানেন ওই গর্তে আপনি ঢুকতে পারবেন কিনা। আপনি নিজের শরীরের আকার, আকৃতি খুব ভালোভাবে চিনেন। এটাই আপনার শরীরের মানচিত্র। ওই লোকটির ক্ষেত্রে, তার মস্তিস্কে শরীরের ম্যাপটা ভুল রয়েছে। ওই ম্যাপে, ডান পায়ের হাটুর নিচে আর কিছু নেই। এই সামান্য ত্রুটির জন্য এই ভয়ঙ্কর অবস্থা। নিজের পা কে শরীরের বাড়তি অংশ বা বোঝা মনে হয়। কেটে ফেললেই মুক্তি। মহিলাটির ক্ষেত্রেও সফটোয়ারের ত্রুটি। তার মস্তিস্ক ওই শরীরটাকে পঙ্গু শরীর বলে চিনে। কাজেই হাটা চলা জিনিসটাকে মেনে নিতে পারে না, অসহ্য লাগে। হুইল চেয়ারে থাকলে, মস্তিস্ক সেটাকে স্বাভাবিক হিসাবে দেখতে পায়। এটাও কিন্তু খুব সামান্য ত্রুটি কিন্তু কত বড় দুর্ভোগ। দাত না থাকলে যেমন বোঝা যায় দাতের কত প্রয়োজনীয়তা। ঠিক তেমনি এসব রোগীদেরকে দেখলে বোঝা যায় আমাদের সুস্থ শরীর কত বড় একটা নেয়ামত। একটু এদিক সেদিক হলে কি ভয়ঙ্কর অবস্থা হোত। আমাদের প্রতিটি যন্ত্রাংশ (অঙ্গ) ঠিক আছে সেই সাথে এর সফটওয়ারও ঠিক আছে। আলহামদুলিল্লাহ।

মস্তিস্কে স্মৃতি ধারন করার জন্য যে বস্তু আছে তাঁকে নিউরন (neuron) বলে। আপনি প্রতিবার নতুন কোন স্মৃতি রাখলে এই নিউরনের নতুন সংযোগ তৈরি হয়। আবারো বলছি, মনে রাখবেন - আপনার প্রতিটি নতুন স্মৃতির জন্য নতুন নিউরন সংযোগ তৈরি হয়। আগের লাইনটি পড়ার পরে আপনার মস্তিস্কেও নতুন কিছু নিউরন সংযোগ তৈরি হয়েছে, কারন ওই লাইনটি আপনি মনে রাখার চেস্ট করেছেন। কি? আপনি মনে রাখতে চেস্টা করেন নি? কোন সমস্যা নেই, কি মনে রাখতে চেস্টা করেননি, সেটা জানতে আপনি পেছনের লাইনে যাবেন, তখনই মনে রাখবেন। এতেও আপনার নতুন নিউরন সংযোগ তৈরি হবে। অর্থাৎ আমার এই লেখাটা পড়তে পড়তে আপনি কত হাজার নতুন নিউরন সংযোগ যে তৈরি করে ফেলেছেন, আল্লাহই জানেন। 
মস্তিস্কে নিউরন
এই নিউরন সংযোগ জিনিসটা হয়ত অচেনা মনে হচ্ছে। সহজভাবে বলছি। আপনার বাসায় বৈদ্যুতিক সংযোগ দেখুন। মেইন সুইস থেকে শুরু হয়ে প্রত্যেক ঘরে তার দিয়ে এই সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আপনার বাসার মতন প্রতিটি বাসাতে এই সংযোগ এসেছে রাস্তার ট্রান্সফর্মার থেকে। রাস্তায় সেই সংযোগ এসেছে বিদ্যুৎ অফিস থেকে। এভাবেই সারা দেশের, সারা বিশ্বের বৈদুতিক সংযোগ দেওয়া আছে। প্রতিটি নতুন সংযোগে আসে বিদ্যুতের সাপ্লাই, চলে নতুন কোন বৈদ্যতিক যন্ত্র। সারা বিশ্বের বৈদুতিক এই নেটওয়ার্ক কতটাবিশাল, কতটা জটিল তা আমাদের কল্পনাতেও আসবে না। আপনার মাথার ভেতরে ওই স্বল্প পরিসরে ওই চেয়েও বড় ও জটিল নেটওয়ার্ক বানানো আছে। এটাই নিউরন সংযোগ Neural network। এই সংযোগ বিদ্যুতের মতন নয়, এটা আসলে বিদ্যুতেরই সংযোগ। আমাদের মস্তিস্ক, তথ্য আদান প্রদান করে বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে। আর এগুলো সবই রয়েছে আমাদের ওই ছোট মস্তিস্কে যেটা মাখনের মতন নরম, যার ৭০% ই পানি। 

কম্পিউটার গেম এ রয়েছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial intelligence) । গেম তো সফটওয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই গেমে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা দেওয়া আছে বলেই কম্পিউটার এর সাথে দাবা খেলা যায়। এই ধরনের কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা অমেক আগে থেকেই আছে । তবে প্রায় ১৫-২০ বছর আগে এর সাথে যুক্ত হয়েছে Neural network নামক এক প্রযুক্তি। হ্যাঁ, উপরের প্যারাতে যা বলেছি সেই একই জিনিসই সফটওয়ারে প্রয়োগ। এতে কি কাজ হয়? এতে গেম অভিজ্ঞ হয়। Neural network প্রযুক্তি রয়েছে এমন একটি দাবা খেলার গেম আপনি যত বেশী খেলবেন গেমটি তত বেশী অভিজ্ঞ হবে। অর্থাৎ এই গেমটি এই খেলাগুলো মনে রেখে, পরবর্তিতে ওই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে। আপনার কাছে থেকে খেলা শিখেই একসময় আপনার চেয়ে অনেক ভাল খেলবে। আধুনিক প্রায় সব গেমেই এই প্রযুক্তি রয়েছে। একজন ইচ্ছে করলে আর অম্নি গেমটিতে ওই প্রযূক্তি ঢুকে গেল তেমন নয়। লক্ষ লক্ষ লাইন কোডিং লিখে এমন এক গেম তৈরি করতে হয়। তাও আবার ২০ বছর আগে এমন গেম দুনিয়াতে ছিলই না। ওদিকে দেখুন সৃস্টির শুরু থেকেই এমন জিনিস দুনিয়াতে ছড়িয়ে রয়েছে। একটা বোকা প্রানী, গরু। এই প্রানীটি যে দরজা দিয়ে তার ঘরে ঢোকে সেই দরজার পাশে কয়েকটি বস্তা রেখে দিন। এমনভাবে রাখবেন যেন ঘরে ঢুকতে গেলেই গরুটি ওই বস্তাতে গুতা খায়। দু-একদিন পরে দেখবেন গরুটি ওই ঘরে এমনভাবে বস্তাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকছে যেন গুতা না লাগে। অর্থাৎ, গরুটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এবং সমস্যার সমাধান করতে শিখেছে। এটাই ওই Neural network এর প্রযুক্তি। গরু-ছাগলের ই এগুলো আছে, মানূষ তো দুরের কথা।
Tianhe-2
একটা কম্পিউটার ক্ষমতাবান সেটা নির্ভর করে প্রধানত দুটি জিনিসের উপরে। এক, সেটা কত দ্রুত ডাটা প্রসেস করতে পারে। দুই, এর স্মৃতি ধারন ক্ষমতা কত বড়। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান সুপার কম্পিউটার তৈরি করেছে চীন দেশে। প্রায় ৪০ কোটি ডলার ব্যায়ে নির্মিত এই কম্পিউটার এর নাম Tianhe-2। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে মানুষের মস্তিস্কের ডাটা প্রসেস ক্ষমতা ও মানুষের স্মৃতি ধারন ক্ষমতা ওই কম্পিউটার এর লক্ষ গুন বেশী। ছবিতে ওই কম্পিউটার এর অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। এটি রাখতে বিশেষ ধরনের স্থানের দরকার হয়। বেশ ভাল পরিমানে বিদ্যুৎ লাগে এটি সচল রাখতে। সব যন্ত্রাংশ একসাথে মেলালে, সাইজে এটি একটি ৪-৫ তলা বিল্ডিং এর সমান হবে। ঝাকি লাগলে ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। ওদিকে মানুষের মস্তিস্ক মাত্র এক কেজি ওজনের মাখনের মতন। এর অধিকাংশই পানি। একটি মোবাইল ফোন এর মতন বিদ্যুৎ লাগে এটিতে। আর এই মস্তিস্ক মাথার ভেতরের রেখে যত ইচ্ছা লাফালাফি করেন। ঝাঁকি লাগলে নস্ট হয় না। সবচেয়ে বড় কথা - এটি সারাজীবন চলে।   (চলবে......)

Comments

  1. সুবাহানাল্লাহ!
    আপনাকে আল্লাহ আরও অনেক জ্ঞান দান করুন। জাযাকাল্লাহ খায়ের ।

    ReplyDelete

Post a Comment