ইতিহাসের পাতিহাঁস


ইতিহাস কি? ইতিহাস হল, মৃত মানুষের গল্প। অনেকদিন আগে মারা গেছেন, এমন লোকজনের গল্প হল ইতিহাস। এই গল্প কারা লেখে ? নিশ্চই জীবিত মানুষেরা।  তারা মৃত মানুষের কাছ থেকে কোন তথ্য নিতে পারে না। তারা তথ্য নেয় অন্য কোন জীবিত মানুষের কাছ থেকে। সেই তথ্য কতটা সঠিক, সেটা নিরভর করে তথ্যদাতা ব্যাক্তিটির উপরে। 

বাংলায় সবচেয়ে প্রচলিত ইতিহাস হল, নবাব সিরাজ উদ দৌলা ও তার পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের ইতিহাস।  নাটক সিনেমা শুরু হবার অনেক আগে, যাত্রা-পালা ইত্যাদিতে বহু বছর ধরে চলে আসছে এই ইতিহাস। পাঠ্যবই ও ইতিহাসের বইতে শত বছর ধরে স্থান করে নিয়েছে নবাব সিরাজ উদ দৌলা ও তার ইতিহাস। কুখ্যাত হলেও, বিশাল পরিচিতি আছে, মীর জাফরের। পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর ও অন্যান্যরা বিশ্বাস ঘাতকতা করে কিভাবে সিরাজ উদ দৌলাকে হারিয়ে দেয়, কিভাবে তাকে হত্যা করে, এর বিস্তারিত বর্ণনা আছে ইতিহাসে। আমরাও এসব পড়ে আবেগী হয়ে যাই, পলাশী যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য মীর জাফর ও অন্যান্য বিশ্বাস ঘাতককে দায়ী করি, গালি দেই।

বিশ্বে এমন কোন দেশ বা জাতি নেই যেখানে বিশ্বাস ধাতক নেই। বেইমান ও বিশ্বাস-ঘাতক এক কথা নয়। বেইমান কথাটির অর্থ - যে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস ঘাতক - যে বিশ্বাস অর্জন করে ধোকা দেয়। এই বিশ্বাস ঘাতক সব সময়ই খুব কাছের লোকেরা হয়। কারন, মানুষ কাছের লোককে বিশ্বাস করে, তারাই ধোকা দেয়। সকল নেতার আশেপাশে বিশ্বাস ঘাতকেরা থকে।, রাস্ট্রনেতা তো বটেই, এলাকার পাতিনেতার আশেপাশেও বিশ্বাস ঘাতকেরা ঘুরঘুর করে।   

আপনি নেতা নন, কোন চাকরী অথবা ব্যাবসা করেন। আপনার আশে পাশেও বিশ্বাস ঘাতক রয়েছে। এখন তারা আপনার বন্ধু সেজে রয়েছে। কখনো সুযোগ পেলে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে , আপনাকে বিপদে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবে। এই জিনিসটা এখন বুঝতে পারেন। কিন্তু ১২ বছর বয়সে যখন স্কুলে পডতেন, তখন এসব বুঝতেন না।  সিরাজ উদ দৌলার অবস্থাও ছিল তেমন। পলাশীর যুদ্ধের সময়, সিরাজ উদ দৌলার বয়স ছিল, ২০ এর আশে পাশে। এমন একজন কিশোর এটা বুঝতেই পারত না যে, কাছের লোকরা ক্ষতি করতে পারে। তাছাড়া বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা এই তিনটি রাজ্য মিলে তার রাজত্যের আয়তন হয় ৪ লক্ষ ৮১ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা কিনা বর্তমান বাংলাদেশের তিন গুনেরও বেশি। এত বড় রাজ্য, একজন কিশোর সামলাতে পারবে কিভাবে ?  আমরা ইতিহাস পড়ে মুখস্ত করে ফেলেছি। পলাশী যুদ্ধে বিশ্বাস ঘাতকতার জন্য, পরাজয়ের জন্য, মীর জাফরেকে দায়ী করছি। কিন্তু আসল ঘটনা হল - সিরাজ উদ দৌলার আপারগতা, তার ব্যর্থতা। চোর তো চুরি করিবেই, কিন্তু গৃহকর্তাকে সাবধান থাকিতে হবে।   

ইতিহাসের আরেকটি জোরালো অংশ হল - প্রচার। যেটা প্রচার হয়ে যায়, মুখে মুখে রটে যায় - সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ভারতবর্ষের ইতিহাসে, প্রচারের কারনে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠা হল - তাজমহল। শুধু ভারতেই নয়, আশে পাশের দেশগুলিতেও তাজমহলকে একটি ভালবাসার চিহ্ন হিসাবে চেনে।  এটি আসলে একটি সমাধি। সম্রাট শাহ-জাহান, তার রানী মমতাজের জন্য এই স্থাপত্যটি তৈরি করান। এটি বিশ্বের সাতটি সেরা আশ্চর্য বস্তুর একটি। আসুন, এই ভালোবাসার গভীরা যাই।

১। মমতাজ ছিলেন শাহ-জাহানের ৬ নম্বর স্ত্রী
২। মমতাজ ১৪ তম সন্তান জন্ম দেবার জটিলতায় মারা গেছেন
৩। মমতাজের আগের স্বামীকে হত্যা করে, শাহ-জাহান তাকে বিয়ে করেন। 
৪।  মমতাজের মৃত্যুর পরে শাহ-জাহান, তার ছোট বোনকে বিয়ে করেন। 

এর মধ্যে কি কোন ভালোবাসা খুজে পেলেন? অথচ, এমন প্রচার হয়েছে, তাজমহল এখন ভালবাসার প্রতিক।    

ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করার সবচেয়ে ভাল উপায় হল - পাঠ্য পুস্তকে ঢুকিয়ে দেওয়। সেই কথাটি লিখে আপনি পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে পাশ  করেছেন, সেই কথা ঠিক নাকি বেঠিক সেই চিন্তাটাই আপনি কোনদিন করবেন না। আর এভাবেই ওই ইতিহাস প্রতিস্টিত হয়ে যায়। আমাদের এমনই একটি প্রতিষ্ঠিত, অসম্পূর্ণ  ইতিহাস আছে, সেটা হল - ভাষা আন্দোলন। 

১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত, দীর্ঘ ৯ বছর ধরে ভাষা আন্দোলন হয়েছে। উধুভাষিরা চেয়েছে তাদের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করতে, আমরা চেয়েছি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে। দির্ঘ এই আন্দোলনের মাঝে ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলে গুলিতে নিহত হয়, সালাম, বরকত, রফিক ও আরো অনেকে। এরও ৪ বছর পরে বাংলাকে দ্বিতীয় রাস্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।

এই জিনিসটি আমরা যেভাবে জানি তা হল - পাকিস্থানীরা আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। উরদুকে রাস্ট্রভাষা ঘোষণা দেওয়া হল। এর পরে বাংলার দামাল ছেলেরা মিছিল বের করল। সেই মিছিলে গুলিতে নিহত হল, সালাম বরকত.....। এর পরে রাস্ট্রভাষা বাংলা হয়।  ভাষা আন্দোলন বলতে আমরা ওই একটি দিনকেই চিনি।  দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলন আমরা জানিই না।  বিস্তারিত জানতে পড়ুন - ভাষা আন্দোলনের না জানা কথা

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধ মানেই জন জীবন বিপন্ন হওয়া। সকল দেশই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য, রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে কথা, রাজনীতি, দলাদলি, সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বাংলাদেশে। আমাদের ভাব দেখে মনে হয়, একমাত্র আমরাই যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছি। আমাদের দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে এত বেশি কথা হবার কারন হল - ইতিহাস। আসল ঘটনা ও আমাদের জানা ইতিহাসের মধ্যে পার্থক্য আছে। এই ব্যাপারে, এর চেয়ে বেশি কিছু বললে, বড় বিপদের সম্ভাবনা আছে।   

ইতিহাসে একদিকে যেমন গৌরবের অধ্যায় থাকে, আরেক দিকে তেমনি লজ্জিত হবার অধ্যায় থাকে। একজন সাধারন ব্রিটিশ নাগরিক, একদিকে তাদের বিশ্ব ব্যাপী রাজত্বের ইতিহাস পড়ে গর্ব বোধ করে, অন্যদিকে তাদের অত্যাচারের ইতিহাস পড়ে লজ্জিত হয়।  এই একই জিনিস অন্যান্য জাতির জন্যও কম-বেশি সত্য। এজন্য কথা প্রচলিত আছে - আপনি যদি আপনার নিজের ইতিহাস জেনে কিছুটা লজ্জিত না হন, তাহলে আপনি ইতিহাসটা পুরোপুরি জানেন না। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বাহিনী জিতে গেলে, একই যুদ্ধের অন্যরকমের হতিহাস লেখা হতো। যারা জয়ী হয়, তারাই ইতিহাস রচনা করে, ইতিহাস প্রতিস্টা করে।  গল্পটা সত্য হলেও, বর্ণনা হয় এক্ পক্ষ থেকে। অপর পক্ষের বর্ণনা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আমরা ইতিহাস বলে যা জানি, সেটা সব সময় অসম্পুর্ন। 

Comments